যে ছবিটি আজকের আলোচ্য তার মাদার প্রিন্ট বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। হারিয়ে যাওয়া ছবির মধ্যে এটাও এখন তালিকাভুক্ত। জানি না কবে উদ্ধার হবে! অতি উত্তম ভক্তরাও এ ছবির কোনও ক্লিপিং আজ দেখতে পাননি।
যাই হোক, ১৯৫৮ সালের উত্তম কুমার নামক যে ম্যাজিক, সারা বাংলাদেশ মায় ভারতকে মাতিয়ে রেখেছিল সেখানে নতুন সংযোজন ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’। আর পাঁচটা গড়পড়তা বাণিজ্যিক ছবির মতো এ ছবির পথ চলা। ছবিটি ছিল রিমেক ভার্সন। এর আগে ১৯৩৫ সালে এই ছবি প্রথম মুক্তি পায় তখনকার অভিনেতাদের কল্যাণে। তারও আগে মঞ্চ সফল নাটক মানময়ী গার্লস স্কুল।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪২: সুন্দরবনের বাঘের ভবিতব্য
উত্তম কুমারের জীবনে নিপাট মৌলিক ছবির যে তালিকা আছে তার কতগুলি ধারা আমাদের মনে রাখা দরকার। মঞ্চ সফল নাটক যেখানে উত্তম কুমার নিজে অভিনয় করেছেন (যেমন: ‘শ্যামলী’) সেটাও পরবর্তীকালে সেলুলয়েডয়ে বন্দি হয়েছে।
আবার পূর্বে ছবিটিতে অনেক বাঘা বাঘা অভিনেতারা কাজ করেছেন। পরবর্তীকালে উত্তম কুমার সেই ছবিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছেন। এ তালিকাও কম নয়। যেমন গতবছরই মুক্তি পাওয়া ‘বড়দিদি’ (১৯৫৭)। ‘বড় দিদি’ ছবি এর আগেও সেলুলয়েড বন্দি হয়েছে। তারও পরবর্তীকালে উত্তমবাবু যখন ‘ছদ্মবেশী’ করেছেন তা আগে সেলুলয়েড বন্দি হয়েছে কিন্তু ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ সবাইকে ছাপিয়ে বেরিয়েছিল। কারণ মঞ্চের নাটক আর সেলুলয়েডের ফিল্ম ছবিটিকে অন্য মান দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৪: উদয়পুর অভিযানে মগ সৈন্যরা ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দিরের চূড়া ভেঙে দিয়েছিল
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৩: বিপর্যয়ের দিনে বন্ধু রবীন্দ্রনাথ
ছবিটিতে নায়িকার ভূমিকা সুযোগ পেয়েছিলেন অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। এ ছাড়া ছবিটির অন্যান্য অংশে চাঁদেরহাট বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুরুষদের মধ্যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, জহর রায়, ধীরাজ ভট্টাচার্য, তুলসী চক্রবর্তী এবং প্রেমাংশু রায়—কে ছিলেন না ছবিটিতে! আবার মহিলাদের মধ্যে মলিনা দেবী, কমলা মুখোপাধ্যায়, বাণী গঙ্গোপাধ্যায়, করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় এদের মতো বাঘা বাঘা অভিনেত্রীরা। বছর দু’ য়েক আগে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবিটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করতে ছবির কর্তৃপক্ষ কোনওভাবেই প্লেয়ার কাষ্টিং-এ কার্পণ্য করেননি। সেরকমই ‘মানময়ী গার্লস স্কুল’ নির্মাণেও ছবির কর্তৃপক্ষ কোনওভাবে কার্পণ্য করেননি। ছবির কাহিনি লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ মৈত্র। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন উত্তম কুমারের খুব পছন্দের মানুষ বিনয় চট্টোপাধ্যায়। যে সময় নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, নিতাই ভট্টাচার্য ছবির নির্মাণ পর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন সে সময়ই বিনয় চট্টোপাধ্যায় নামক সুলেখক বাংলা ছবির অনেক উজ্জ্বল ঘরানার সাক্ষী হয়েছিলেন।
ছবিটির আঙ্গিক ছিল হাস্যরস এবং কৌতুহল উদ্দীপক মানুষের বিনিময়। উত্তম কুমারের আঙ্গিক অভিনয়, ছবিটির সর্বাংশে ফুলে ফলে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। যে বছর ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘বন্ধু’ এবং ‘ইন্দ্রানী’-র মতো ছবি মুক্তি পাবে সে বছর এ ধরনের ছবির নির্মাণ, বাংলা ছবির যাত্রাকে অনেক মসৃণ করে তুলেছিল।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৯: ইন্দুমতী ও সুরবালা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৬: রামায়ণে রামচন্দ্রের যাত্রাপথ সুগম হওয়ার কারণেই কি সীতার উপস্থিতি?
ছবিটিতে সুর সংযোজনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন রাজেন সরকার। যিনি পরবর্তীকালে অনেক ব্যতিক্রমী ছবির সুরকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন। যে সমস্ত ছবিতে মনে রাখার মতো কিছু সৃষ্টি, মানুষকে যুগের পর যুগ মোহিত করে রাখে, রাজেন সরকার ছিলেন সেরকমই একজন সুর সংযোজক।
পরিচালক হেমচন্দ্র চন্দ্র যে কয়েকটি ছবি করেছেন শেষের দিকের ছবি ছিল এ ছবিটি। এরপর উনি আরেকটি ছবি করে পরিচালনার জগত থেকে অবসর নেবেন। যাইহোক পাঁচ-ছ’টা ছবি করার অভিজ্ঞতার ফসল তিনি এখানে রূপায়ন করতে পেরেছিলেন এবং উত্তম- অরুন্ধতীর রসায়ন, পর্দার বুকে এমন সুন্দর করে মেলে ধরেছিলেন যে সে বছরের ছবির ইতিহাসে এই ছবিটি স্মরণীয় হয়ে আছে।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar–Mahanayak–Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।