প্রেক্ষাগৃহ : মিনার, বিজলী ও ছবিঘর
পরিচালনা : সুকুমার দাশগুপ্ত
সে এক অন্য সময় শুরু হয়েছে। সুচিত্রা-উত্তমের ‘হারানো সুর’ ব্লকবাস্টার হিট। পুজোর আগে হলে হলে প্যান্ডেলের মাইকে হারানো সুরের গান সংলাপ এবং সর্বোপরি উত্তম-সুচিত্রার জয়গান। কিন্তু উত্তম কুমারের জীবনে সুচিত্রা সেনের যেমন একটা রোম্যান্টিক অধ্যায় তৈরি হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরোয়া এবং আটপৌরে জীবন যাপনের সঙ্গী ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
সময়ের কি অলঙ্ঘ্য বাঁধুনি, যে মাসে ‘হারানো সুর’ রিলিজ করল সেই মাসেই মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে অভয়ের বিয়ে রিলিজ করল ‘অভয়ের বিয়ে’। পরিচালক এক এবং অদ্বিতীয় সুকুমার দাশগুপ্ত। ‘হারানো সুর’ রূপবাণী-অরুণা-ভারতীতে সুপার-ডুপার হিট। ‘অভয়ের বিয়ে’ মিনার, বিজলী ও ছবি ঘর কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই সময়তেই একসঙ্গে চলছে ‘চন্দ্রনাথ’, ‘পথে হল দেরি’, ‘জীবন তৃষ্ণা’-র মতো ছবির প্রস্তুতিপর্ব তথা মেকিং।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?
আমাদের সবচেয়ে যেটা মনে রাখার মতো বিষয় যে, এক ঝাঁক উত্তম, ভিন্ন ভিন্ন নায়িকার সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন পরিচালকের সঙ্গে নানা রকমের কাহিনি চিত্রে প্রাণসঞ্চার করে বেড়াচ্ছেন। এমন তো নয় যে সারা বছরে শুধুমাত্র উত্তম কুমারের ছবিই রিলিজ করছে। পাশাপাশি অন্যান্য নায়কদের ছবিও চলছে। কিন্তু উত্তম সুচিত্রা, উত্তম সাবিত্রী, উত্তম-মালা সিনহা, উত্তম-অনিতা গুহ এ বছর যেন উত্তম কুমারের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেন ও উত্তম বাবুর সঙ্গে যত ছবি করেছেন এবছরের মতো ছবি রিলিজ তার কোন বছরের ঝুলিতে নেই।
যাইহোক সবকিছুরই একটা উত্থান-পতন থাকে। একটা সময় আমরা দেখব উত্তম-সুচিত্রার জুটি, দুটি ভিন্ন পথে বাঁক নিয়েছে। কিন্তু উত্তম সুচিত্রার পাশাপাশি যে ছবিগুলো বাজারে অ্যাভারেজ চলছিল সে অর্থে সুপার ডুপার হিট হিসেবে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছিল না। সে দিক দিয়ে ‘অভয়ের বিয়ে’ অনেকটাই এগিয়েছিল। নিতান্তই একটা সাদামাটা কাহিনিকে রূপায়ণ করতে সুকুমারবাবু চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৭: হিন্দু-মুসলিম মিশ্র দেবতা সত্যনারায়ণ ও সত্যপীর
সমালোচনা স্তম্ভে একটা কথা সবচেয়ে জোর দিয়ে বলতে হয় যে সময়ে উত্তম কুমার এ ধরনের অভিনয় করতেন না সেই মানের অভিনয়ে উনি এই ছবিতেই দেখিয়েছিলেন। বিষয়টা কী রকম? উত্তমকুমার গরিবের ছেলে হবেন, নায়িকা বড়লোকের মেয়ে হবেন। তাদের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলবে এবং সেই সুবাদে একটা সময় কাহিনির ঘনঘটা দিয়ে বিষয়টাকে সমাধানের পথে নিয়ে যাওয়া হবে।
১৯৫৭ সালে এসে বাংলা ছবি অন্যদিকে বাঁক নিল। সুকুমার বাবুর মতো পরিচালকরা কিন্তু সেই চেনা ছক থেকে বের হতে পারলেন না। তাঁদের ছবিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, আধুনিক চিন্তাভাবনার পরিচয় কম থাকলেও উত্তম কুমারই একমাত্র নায়ক যিনি সেই ওয়ার্ল্ড রেঞ্জে অভিনয় করেছিলেন। আমরা শুধু ‘নায়ক’, ‘চিড়িয়াখানা’, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’, ‘অগ্নীশ্বর’ দেখেই তার অদম্য সাধনার পরিচয় খুঁজি।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭৭: আস্তাবলে সহিসদের রাখি পরাতে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর
সত্যিকারের কোনও বোদ্ধা যদি উত্তমবাবুর মৃত্যুর শেষ পাঁচ বছরের ছবি দেখেন সেখানে যে অভিজ্ঞতার দিকে যাচাই করা রোল উনি করে গিয়েছেন সমগোত্রের একই মানের অভিনয় কিন্তু ‘সাহেব বিবি গোলাম’ থেকেই উনি করে গিয়েছেন। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয়েছে অনেকের মধ্যে উত্তমবাবুকে দেখেছি আর জীবনের শেষ পর্বে উত্তম বাবুকে শুধু দেখেছি কিন্তু এই ‘অভয়ের বিয়ে’ ছবিতে দেখা যাচ্ছে বিকাশ রায়, ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় পাল্লা দিয়ে উত্তমবাবুর সঙ্গে অভিনয় করে যাচ্ছেন। কিন্তু উত্তমবাবু ছাড়বার পাত্র নন।
উত্তম মঞ্চ অভিনয় এবং চলচ্চিত্র অভিনয়ের যে তফাৎ সেটাকে সযত্নে এই ছবিতে দেখাতে পেরেছেন। কাজেই অন্যান্য চরিত্রদের অভিনয় কিছুটা ফিল্মোচিত না হলেও উত্তমবাবু কিন্তু এখানে একশোতে একশো। বর্তমান প্রজন্মের যাঁরা এখনো পর্যন্ত ছবিটি দেখেননি তাদের অনুরোধ করবো ‘অভয়ের বিয়ে’ ছবিটি একটু মনোযোগ দিয়ে দেখতে। কোনও অংশে অন্যান্য ধ্রুপদী ছবির থেকে ছবিটি কম নয়।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।