শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


 

মুক্তির তারিখ : ১১/০৫/১৯৫৬

প্রেক্ষাগৃহ : রূপবাণী, অরুণা ও ভারতী

পরিচালনা : চিত্ত বসু

উত্তম অভিনীত চরিত্রের নাম: সুশোভন

আবার উত্তম সুচিত্রা! এবারে পরিচালক চিত্ত বসু। ১৯৫৪ সাল থেকে এই জুটি সম্পর্কে মানুষের ধারণা হয়েই গিয়েছে যে, প্রতি বছর আর কোনও পরিচালক বা পরিচালক গোষ্ঠী ছবি তৈরি না করলেও অগ্রদূত গোষ্ঠী ছবি বানাবেন এবং হয়েও ছিল তাই। কিছুদিনের মধ্যেই অগ্রদূতের সেই ব্লকবাস্টার ছবি ‘ত্রিযামা’ মুক্তি পায়। তার আগে ‘একটি রাত’ ছবির মুক্তিকে কেন্দ্র করে চিত্র দর্শকদের মধ্যে আলোড়ন তৈরি হয় কারণ এ ধরণের ফিল্মি নাম হলিউড ক্লাসিকে দেখা যায় পাশাপাশি এ ছবির কাহিনি ‘অগ্নিপরীক্ষা’-র মতো হেভি ওয়েট না হলেও প্রতিটি পরতে পরতে ছিল সম্মোহনী আকর্ষণ।
ছবির কাহিনি বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাবো সুশোভন আর তার স্ত্রী অনিতা, অন্যদিকে ব্রজেশ্বর ও তার স্ত্রী শান্তনা। এই দু’ জোড়া মানুষের মধ্যে বা দুটি পরিবারের দম্পতিদের মধ্যে মানসিক টানাপোড়েন ছিল কাহিনির মূল।

সুশোভন যাচ্ছিলেন বাবার বন্ধু দ্বিগবিজয় সিংহরায়ের বাড়িতে শিকারের আমন্ত্রণে। স্টেশনে দেখা হয়ে যায়, পুরানো বান্ধবী ব্রজেশ্বর রায়-র স্ত্রী সান্ত্বনার সঙ্গে। গল্প করতে করতে হঠাৎ দেখা যায় অনিতাকে নিয়ে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। সুশোভন মোটরে শান্তনাকে নিয়ে রওনা দেয়। এদিকে অনিতা পরের স্টেশনে নেমে বাড়ি ফিরে আসে। বাড়িতে এসে শোনে সুশোভন সান্ত্বনাকে নিয়ে রওনা হয়ে গিয়েছে।
সুশোভনের চরিত্র নিয়ে সন্ধিহান হয়ে ওঠে অনিতা। তৎক্ষণাৎ বাবা-মাকে নিয়ে রওনা হয়ে যায়। পাশাপাশি ব্রজেশ্বর রায়ও বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করে একই কারণে। এরকম একটি টানটান উত্তেজনায় পূর্ণ কাহিনিকে অবলম্বন করে সরস চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিখ্যাত নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়। ছবির সমালোচনা স্তম্ভে সবচেয়ে আগে লক্ষ্য করতে হয় উত্তম-সুচিত্রার পারস্পরিক বিনিময় অপেক্ষা, নিজেদের গড়ে তোলার একটা অদম্য চেষ্টা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪০: সে এক স্বর্গপুরীর ‘চিরকুমার সভা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৮: মনে পড়ে পঞ্চমের কণ্ঠে শোলে ছবির সেই বিখ্যাত ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

১৯৫৬ সালে উত্তমের করা বারোটি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মধ্যে চারটি ছবিতে সুচিত্রা সেন নায়িকা। ওই একই বছরই সুচিত্রা সেনের করা ছয়টি ছবির মধ্যে চারটি ছবির নায়ক স্বয়ং উত্তম কুমার। জুটির চারটি ছবির মধ্যে ‘সাগরিকা’ এবং ‘শিল্পী’ মেগা হিট। অন্যদিকে ‘একটি রাত’ ও ‘ত্রিযামা’ মন্দ ব্যবসা করেনি। ছবি দুটি রিলিজ অর্থাৎ পুনর্মুক্তিতে সুপার হিট হয়েছিল। পাশাপাশি উত্তম কুমার ছাড়া আর দুটি ছবি সুচিত্রা সেনের ‘শুভরাত্রি’ এবং ‘আমার বউ’ ছবি দুটোই সুপার ফ্লপ করে।

আমরা উত্তম কুমারের দিকে ব্যক্তিগতভাবে নজর দিলে দেখব, তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত এগারোটি ছবি প্রায় সুপারহিট। প্রযোজকের ঘরে প্রাপ্য অর্থ ফিরিয়ে এনে দিয়েছে। এরকম একটা যুগসন্ধিক্ষণে যেখানে নিঃশব্দে ১৯৫৭ সাল প্রস্তুত নিচ্ছে সেরকম একটা প্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে এই ছবির প্রতিটি ফ্রেমকে আলোচনা করা দরকার।
ছবিতে সবার আগে লক্ষ্য করার মতো বিষয় হল, উত্তম সুচিত্রা যখনই মুখোমুখি হচ্ছেন পরিচালক চিত্ত বসু কতটা তাদের রসায়নকে দর্শকসমাজে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পেরেছেন। অর্থাৎ ফিল্মের ক্যামেরার সাথে এমন একটা আত্মীয়তা করে ফেলেছিলেন পরিচালককে সবার আগে মাথায় রাখতে হতো কিভাবে দর্শককে সন্তুষ্ট করতে পারবেন। বাণিজ্যিক ছবির পরিচালক প্রযোজক গোষ্ঠী সবার আগে সৃজন অপেক্ষা বিনিয়োগ করা অর্থের রিটার্নে মন বেশি দিতেন। তাই তাদের সৃজন, কাহিনিকে এমন ভাবে আবর্তিত করাতো প্রতিটি ক্ষণ অত্যন্ত মূল্যবান হয়ে যেত। এ ব্যাপারটা দু’ জনের মধ্যে থেকে সবার আগে ভেঙে দিয়েছিলেন একমাত্র পরিচালক অজয় কর মহাশয়।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩: ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ

দশভুজা: মাই নেম ইজ গওহর জান—ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে অঘোষিত বিপ্লব এনেছিলেন এই শিল্পী

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?
বাকি সমস্ত পরিচালকই একটি বিশেষ দৃশ্যের নির্মাণে যদি উভয়কে সিঙ্গেল দৃশ্যে দেখাতে হয় তাহলেও তাদের ভেতরে যেন একটা অদৃশ্য সুতোর টান থাকে সেই ব্যাপারটার দিকে খেয়াল রাখতেন। পরিচালক চিত্ত বসু এ ছবিতে তার ব্যতিক্রম ঘটাননি। সুচিত্রা সেনের কাছাকাছি দেখতে সবিতা বসুকে সেসময় উনি সহ-নায়িকার রোল দিয়ে ছবির মধ্যে একটা নতুন আকর্ষণ গড়ে তুলেছিলেন। আসলে উত্তম সুচিত্রার রসায়ন নিয়ে যত দৃষ্টিকোণ থেকেই আলো ফেলা যাক না কেন প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক একটা নতুন চিত্র দেখা দেবে।
আমাদের এ ছবির প্রস্তুতি পর্বেও তার কোন খামতি ছিল না। ছবিটিতে প্রতিটি মুহূর্তকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য তুলসী চক্রবর্তী ও মলিনা দেবীর যে পারস্পরিক টানাপোড়েন ‘সাড়ে চুয়াত্তর’-র মাধ্যমে ম্যাগনাম ওপাস হয়ে গিয়েছিল সেটাকেই এই ছবিতে একটু ঘুরিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে।

মলিনা দেবীর নিরীহ স্বামীর ভূমিকায় একেবারে নিষ্পাপ সরল চোখের চাহনি নিয়ে গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবতরণ দর্শককে সিটের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল। অন্যদিকে এটাও মনে রাখতে হয়েছে তুলসী চক্রবর্তীর মত ক্ষনজন্মা অভিনেতাকে মেস মালিক বা হোটেলের কর্তা হিসাবে ছবিতে ব্যবহার যথেষ্ট মানুষের মনে দাগ কেটেছিল।
এরও প্রভাব পরবর্তী কালে আমরা দেখব, উত্তম-সুচিত্রার ‘চাওয়া পাওয়া’ ছবিতে। যেখানে পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে মূল্য দিতে তুলসী চক্রবর্তী মত অভিনেতাকে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে।

নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় চিত্রনাট্যের বাঁকে বাঁকে এ ধরনের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু রচনা করে ছায়াছবিকে অন্য মানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন এবং তিনি সফল হয়েছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

একটি রাতের দুজন ভিন্ন পরিবারের মানুষের পারস্পরিক যাপনকে কেন্দ্র করে কাহিনীর ঘনঘটা যে এই মানে হতে পারে তা পরিচালক চিত্ত বসু না থাকলে বোঝা যেত না। আমরা যারা বিশ্ববন্দিত বাঙালি পরিচালকদের নিয়ে বা তাদের স্টোরি টেলিং পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসি তাদের উদ্দেশ্যে নিবেদন, বাংলা ছবিতে পঞ্চাশের দশকে কিভাবে গল্প বলার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল তা দেখার জন্য চিত্ত বসু পরিচালিত প্রতিটি মুহূর্তে আকর্ষণে ভরপুর ‘একটি রাত’ ছবিটি অবশ্যই দর্শনীয়।
সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন অনুপম ঘটক। যাঁর সুরের ছোঁয়ায় ‘অগ্নিপরীক্ষা’ আজও মানুষের কাছে ইতিহাস। তিনি যত্ন করে বিশেষত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে এই ছবিতে ব্যবহার করে সুচিত্রা সেনের প্রতিষ্ঠা আরও জোরদার করে তুলেছিলেন।

কাজেই আগামী দিনে এ ধরনের বৈপরীত্যে ভরা ছবির নির্মাণে বোধহয় তখনকার টলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মেতে উঠেছিল না হলে একই কাহিনী বুননে কিছুদিনের মধ্যেই মুক্তি পেতে চলেছে অগ্রদূতের ব্লকবাস্টার ছবি ‘ত্রিযামা’।—চলবে।
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।

Skip to content