প্রেক্ষাগৃহ: উত্তরা, পূরবী ও উজ্জ্বলা
আগের ছবি ‘দৃষ্টিদান’, ‘কামনা’ ও ‘মর্যাদা ‘ প্রভৃতির রিলিজিং ডেট দেখলে বোঝা যায়, একটি ছবির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব কখনও এক বছর কখনও বা দেড় বছর। কিন্তু ‘মর্যাদা’ এবং ‘ওরে যাত্রী’র মুক্তির ব্যবধান মাত্র দেড় মাস। আবার তার পরবর্তী ‘সহযাত্রী’ ছবির মুক্তি মাত্র এক মাস পরে। একই বছরে ‘নষ্টনীড়’ -র মুক্তি সাড়ে পাঁচ মাস পরে। উপরের সালতামামি থেকে একটা কথা স্পষ্ট, সময় অরুণকে উত্তম কুমার হওয়ার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিচ্ছে।
আগের ছবি ‘দৃষ্টিদান’, ‘কামনা’ ও ‘মর্যাদা ‘ প্রভৃতির রিলিজিং ডেট দেখলে বোঝা যায়, একটি ছবির সঙ্গে আরেকটির দূরত্ব কখনও এক বছর কখনও বা দেড় বছর। কিন্তু ‘মর্যাদা’ এবং ‘ওরে যাত্রী’র মুক্তির ব্যবধান মাত্র দেড় মাস। আবার তার পরবর্তী ‘সহযাত্রী’ ছবির মুক্তি মাত্র এক মাস পরে। একই বছরে ‘নষ্টনীড়’ -র মুক্তি সাড়ে পাঁচ মাস পরে। উপরের সালতামামি থেকে একটা কথা স্পষ্ট, সময় অরুণকে উত্তম কুমার হওয়ার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে দিচ্ছে।
কারণটা এমন নয় যে, একটা ছবির কাজ শেষ হয়েছে আর অন্য ছবির কাজ আরম্ভ হয়েছে। বরং ঘটনার ঘনঘটায় নিশ্চিত করা যায়, ‘মর্যাদা’-র কাজ শুরু হওয়ার পাশাপাশিই ‘ওরে যাত্রী’-র কাজ শুরু হয়েছিল। ‘মর্যাদা’-র রিলিজ হতে বিলম্ব হয়েছিল। ‘ওরে যাত্রী’ তৈরি হওয়ার পর খুব তাড়তাড়ি রিলিজের ব্যবস্থা হয়েছিল।
ছবি তৈরির পিছনে ব্যক্তি উত্তমের দৈনন্দিন কড়চা অংশটুকুও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত নায়ক প্রদীপ কুমারের কাছে সেট-র মধ্যে একঘর লোকের মাঝে অপদস্থ হওয়া হয়ে গিয়েছে। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধু পরিচালক রাজেন চৌধুরির ‘ওরে যাত্রী’ ছবির নায়কের চরিত্রে মনোনয়ন পাওয়ার পর গোদের ওপর বিষফোড়া যেন আরও বাড়ল।
ছবি তৈরির পিছনে ব্যক্তি উত্তমের দৈনন্দিন কড়চা অংশটুকুও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। প্রতিষ্ঠিত এবং পরিচিত নায়ক প্রদীপ কুমারের কাছে সেট-র মধ্যে একঘর লোকের মাঝে অপদস্থ হওয়া হয়ে গিয়েছে। বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের বিশেষ বন্ধু পরিচালক রাজেন চৌধুরির ‘ওরে যাত্রী’ ছবির নায়কের চরিত্রে মনোনয়ন পাওয়ার পর গোদের ওপর বিষফোড়া যেন আরও বাড়ল।
সবাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁকে অপমান না করতে পারলে বোধহয় পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না। ঘরে ধনী পরিবারের মেয়েকে বিয়ে করে সেখানে এক অসাম্যের সঙ্গে সহবাস। চাকরির জায়গায় অনিয়মের পাওনা-গণ্ডা হিসাবে ধার-বাকি না রেখে নগদ অপমান। স্টুডিয়োতে নিজেকে শতকরা একশভাগ উজাড় করে দিয়েও ভাগ্যদেবতার মুখ ফিরিয়ে থাকা।
সব মিলিয়ে এক ক্লেদাক্ত অবস্থা। ‘ওরে যাত্রী’ ছবির শ্যুটিং স্পটে ঘটে যাওয়া সেধরণের বেশ কিছু উক্তি- বিনিময়, ভগ্নহৃদয় উত্তমকে বড্ড একা করে দিয়েছিল। হাত-পা-মাথা-ধারী মানুষ যে এত নির্লজ্জভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কারও পক্ষে অনুভব করা কঠিন।
সব মিলিয়ে এক ক্লেদাক্ত অবস্থা। ‘ওরে যাত্রী’ ছবির শ্যুটিং স্পটে ঘটে যাওয়া সেধরণের বেশ কিছু উক্তি- বিনিময়, ভগ্নহৃদয় উত্তমকে বড্ড একা করে দিয়েছিল। হাত-পা-মাথা-ধারী মানুষ যে এত নির্লজ্জভাবে নিজেদের প্রকাশ করতে পারে তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া কারও পক্ষে অনুভব করা কঠিন।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩: এক ফ্লপ মাস্টার জেনারেল-র ‘মর্যাদা’ [২২/১২/১৯৫০]
পুজোর ছুটিতে সপরিবারে ঘুরতে যাচ্ছেন? কোন কোন বিষয় মাথায় রাখবেন? রইল ডাক্তারবাবুর জরুরি পরামর্শ
শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব ১৭: অপেক্ষার অবসান — অযোধ্যায় চার রাজকুমার
ষাট পেরিয়ে, পর্ব-১৬: বয়স হয়েছে তাই ওজন কমে যাচ্ছে— এই ধারণা কি আদৌ ঠিক? পর্ব-১
সহকারী পরিচালক যখন উত্তমবাবুকে নিয়ে রিহার্সালে ব্যস্ত তখন কোনও এক উর্বর মস্তিষ্ক বলে উঠলেন “রাজেনদা, এ কলির ভীমকে কোথা থেকে পেলেন? পায়ে পাথর বেঁধে না রাখলে ঝড়ে উড়ে যাবে।”
আর একজন তাঁর সেই মন্তব্যে ইন্ধন যোগালেন, “একেবারে নতুন আলু আমদানি হয়েছে গাঁ থেকে।” সহ অভিনেত্রী প্রভা দেবীও সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। এক ঘর লোকের সামনে ফাইনাল টেকিং-র আগে মনিটরের সময় বলে উঠলেন, “এ ছেলে অভিনয় করবে কী করে? ভয়েই তো এর গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে!”
আর একজন তাঁর সেই মন্তব্যে ইন্ধন যোগালেন, “একেবারে নতুন আলু আমদানি হয়েছে গাঁ থেকে।” সহ অভিনেত্রী প্রভা দেবীও সুযোগের সদ্ব্যবহার করলেন। এক ঘর লোকের সামনে ফাইনাল টেকিং-র আগে মনিটরের সময় বলে উঠলেন, “এ ছেলে অভিনয় করবে কী করে? ভয়েই তো এর গা-হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে!”
একঝাঁক কুৎসিত মন্তব্যের জোরালো আক্রমণে উত্তম ক্ষতবিক্ষত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু করার কিছুই ছিল না। অসহায়, অপ্রতিষ্ঠিতের প্রতিবাদ কেউ গ্রাহ্য করে না। বরং খিল্লি করে, মজা নেয়। আদ্যন্ত ফিল্ম পার্সোনালিটি উত্তম জানতেন, কোথায় কতটা বলতে হয় কতটা থামতে হয়। এই পরিমিতি বোধই তাকে মহানায়ক হয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এত দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই সব ব্যর্থ হয়ে গেল। ‘ওরে যাত্রী’ সিনেমার ভাষায় ফ্লপ করল। এত দিনকার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল।
আরও পড়ুন:
মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৩৬: অক্ষবিদ্যাশিক্ষা করলেন নলরাজা
ছোটদের যত্নে: শিশু পেটের ব্যথায় ভুগছে? তাহলে শিশু বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি মেনে চলুন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৩৫: শেকল-বাঁধা ঠাকুরবাড়ির খাতা
ত্বকের পরিচর্যায়: হঠাৎ শিশুর জ্বর আর মুখে-হাতে দানাদানা? কোন রোগের উপসর্গ? জানুন বিশেষজ্ঞের মতামত
এবার আসি ‘ওরে যাত্রী’ ছবির নির্মেদ আলোচনায়। প্রথমত ছবিটির কাহিনী। চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনা করেছিলেন পরবর্তী বাংলা ছবির সাড়াজাগানো চিত্রনাট্যকার নিতাই ভট্টাচার্য। সুরকার সুবিখ্যাত কালীপদ সেন। যাঁদের রেকর্ডবুক ছবির জগতে অবিস্মরণীয়। তা সত্ত্বেও ছবি হিট হল না। এর কোনও স্বাস্থ্যকর ব্যাখ্যা তখন ছিল না।
দ্বিতীয়ত: নায়িকা নির্বাচন। নায়িকা হিসাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন করবী গুপ্ত। ছবিটি শুরু থেকে উত্তম কুমারের মানসিক গঠন এমনভাবে ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল যে, নায়িকার সঙ্গে সহজভাবে নিশ্বাস নিতে পর্যন্ত অসুবিধা হয়েছে। যে উত্তম সারাজীবন বিপরীতের নায়িকার সঙ্গে চোখ দিয়ে অভিনয় করেছেন তাঁকেই যেন প্রতিবন্ধী করে রাখা হয়েছিল।
দ্বিতীয়ত: নায়িকা নির্বাচন। নায়িকা হিসাবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন করবী গুপ্ত। ছবিটি শুরু থেকে উত্তম কুমারের মানসিক গঠন এমনভাবে ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল যে, নায়িকার সঙ্গে সহজভাবে নিশ্বাস নিতে পর্যন্ত অসুবিধা হয়েছে। যে উত্তম সারাজীবন বিপরীতের নায়িকার সঙ্গে চোখ দিয়ে অভিনয় করেছেন তাঁকেই যেন প্রতিবন্ধী করে রাখা হয়েছিল।
তৃতীয়ত: রূপোলি পর্দায় অভিনয়ের সুযোগ পাওয়া যেখানে স্বপ্নের ব্যাপার সেখানে পেটের দায়ে চাকরি বজায় রেখে অভিনয় শিল্পের জন্য বাছাই করে ছবি নির্বাচন এককথায় অসম্ভব ছিল।
চতুর্থত: অবধারিতভাবে পরিচালনাগত সুবিধা-অসুবিধা। যতদিন না নির্মাতা বা নির্মাতাগোষ্ঠী, উত্তমের ফিল্ম এ্যাক্টিং-কে বুঝতে পেরেছেন, ততদিন উত্তম কুমার নামক অভিনেতা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারেননি।
পরিশেষে বলা যায়, উত্তমের সেই মিলিয়ন ডলার হাসি তখনও ক্যামেরা হজম করতে পারেনি। যে হাসি ছিল উত্তমের গুপ্তধন। মানুষের মুখের নির্মল হাসি যে এত পবিত্র হতে পারে তারও স্রষ্টা উনি, যা ‘ওরে যাত্রী’ সিনেমায় দর্শক খুঁজে পাননি। নিটফল ‘বিগ জিরো’। —চলবে
চতুর্থত: অবধারিতভাবে পরিচালনাগত সুবিধা-অসুবিধা। যতদিন না নির্মাতা বা নির্মাতাগোষ্ঠী, উত্তমের ফিল্ম এ্যাক্টিং-কে বুঝতে পেরেছেন, ততদিন উত্তম কুমার নামক অভিনেতা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হতে পারেননি।
পরিশেষে বলা যায়, উত্তমের সেই মিলিয়ন ডলার হাসি তখনও ক্যামেরা হজম করতে পারেনি। যে হাসি ছিল উত্তমের গুপ্তধন। মানুষের মুখের নির্মল হাসি যে এত পবিত্র হতে পারে তারও স্রষ্টা উনি, যা ‘ওরে যাত্রী’ সিনেমায় দর্শক খুঁজে পাননি। নিটফল ‘বিগ জিরো’। —চলবে
* উত্তম কথাচিত্র (Uttam Kumar – Mahanayak – Actor) : ড. সুশান্তকুমার বাগ (Sushanta Kumar Bag), অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, মহারানি কাশীশ্বরী কলেজ, কলকাতা।