
ছবি: লেখক।
ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে মোটামুটি দু’ ঘণ্টার মতো গাড়ি চালিয়ে গেলে আসে ডেল্টা জংশন নাম একটি শহর। এটাই এই রাস্তায় শেষ বড় শহর, যেখানে সব রকম পরিষেবা পাওয়া যায়। কাজেই সেখানে নেমে একবার একটু হাত-মুখ ধুয়ে আবার এক পেয়ালা কড়া কফি কিনে নিয়ে পথ চলা শুরু হল। সূর্যাস্তের সময় আমরা ফেয়ারব্যাঙ্কস থেকে বেরিয়েছিলাম। কাজেই ডেল্টা জংশন থেকে বেরোতে না বেরোতেই সূর্য উঠতে শুরু করে দিয়েছে।
ইতিমধ্যেই পাশ থেকে দেখা যেতে শুরু করেছে আলাস্কা পর্বতমালার সুউচ্চ শৃঙ্গগুলো। তখন পাহাড়ের ওপরে সূর্যের সোনালি আভা। অনেক নীচে একটা বিস্তৃত সমতল ভূমি। সেটা পুরোটাই ঢেকে আছে সুবিশাল মেরু অরণ্যে (বোরিয়াল ফরেস্ট)। কনিফার, বার্চ, আর অ্যাস্পেন গাছে ভরা এই অরণ্য। মাথার ওপরে সূর্যোদয়ের আলোয় রাঙা উজ্জ্বল গৈরিকবর্ণ আকাশ, তার নীচে তুষারশুভ্র পর্বতমালা, আর একেবারে নীচে সবুজ ঘেরা মেরু অরণ্য। যেন ভারতের জাতীয় পতাকার এক প্রাকৃতিক নিদর্শন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ
ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অপরূপ রূপের মহিমা উন্মোচন করে চলেছে পরমা প্রকৃতি। একটা পাহাড়ের ওপর থেকে নামতে গিয়ে দেখি একটি বিশাল হ্রদ, খুব সম্ভবত প্যাক্সন লেক। এখানে পৃথিবীর বক্রতার কারণেই হোক অথবা অন্য যে কোনও কারণেই হোক—পাহাড়ের উঁচু থেকে নীচের হ্রদগুলো দেখলে মনে হয় যেন একদিকে হেলে আছে। অবশ্যই এ এক ধরণের আলোক বিভ্রান্তি। কিন্তু যখনই দেখি তখনই মনে হয় এই বুঝি হ্রদের জল সবটা বেরিয়ে চলে যাবে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে
সেই বিশাল হ্রদে তখন পাশের পাহাড় আর পুরো আকাশের প্রতিফলন। কি অপূর্ব সেই দৃশ্য। এ এক অবর্ণনীয় অনুভূতি। একে নিজের ভাষায় বর্ণনা করা আমার অসাধ্য। শুধু কিছু কিছু গল্পের বা কবিতার পংক্তিগুলো হঠাৎ হঠাৎ মাথায় চলে আসে, আবার হারিয়ে যায়। আমার স্ত্রী আবার ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ। সে আমার থেকেও বেশি সাহিত্য-প্রেমী। কাজেই রাস্তার প্রত্যেকটা বাঁকে প্রকৃতির আর নিজেদের অনুভূতির সঙ্গে মিলিয়ে জনপ্রিয় কোনও কবিতা বা গানের পংক্তি মনে করতে করতে বেশ কেটে যায় আমাদের দীর্ঘ যাত্রাপথ। বিবাহ বার্ষিকীর শুভ উদযাপন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ
এমন ভাবেই একটা পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এলাম নীচে। দূরে যে হ্রদটাকে এতক্ষণ উঁচু থেকে দেখছিলাম, সেটা চলে এসেছে ঠিক রাস্তার পাশে। সূর্যের আলো পড়ে তার জল চিকচিক করছে। তার চার পাশেই বিস্তৃত জঙ্গল। শুধু রাস্তা থেকে একটা জায়গায় গাছপালা কেটে একটা সরু সুঁড়িপথ (ট্রেইল) করা হয়েছে সেই হ্রদে যাওয়ার জন্য। উঁচু থেকে যে পাহাড়ের চূড়াগুলো দূরে দেখা যাচ্ছিল সেগুলো যেন হঠাৎ করে এখন আমাদের ঘিরে ধরেছে দৈত্যের মতো। তাদের কয়েকজনের গা বেয়ে কিছুদূর উঠে গিয়েছে সবুজ মেরু-অরণ্য, তার ওপর রুক্ষ-শুষ্ক, ধূসর পাথর, আর তার ওপরে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৬: পৃথিবীতে এমন কেউ নেই, যাঁর জীবনের আকাশে কখনও শত্রুতার মেঘ জমেনি
এই ধূসর পাথরেও ইতস্তত ভাবে ছড়িয়ে রয়েছে বরফ। চারিদিকে কেউ কোথাও নেই। কেমন যেন একটা গা ছমছম করা পরিবেশ। আমরা দু’জনেই যেন বিহ্বল। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে “এখন আমিও একটা পাহাড় কিনতে চাই।… সেই পাহাড়ের পায়ের কাছে থাকবে গহন অরণ্য।…. আমি সেই অরণ্য পার হয়ে যাব, তারপর শুধু কঠিন পাহাড়।… একেবারে চূড়ায়, মাথার খুব কাছে আকাশ, নীচে বিপুলা পৃথিবী,…চরাচরে তীব্র নির্জনতা।… আমার কণ্ঠস্বর সেখানে কেউ শুনতে পাবে না।”—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।