
অকৃত্রিম সৌন্দর্য। ছবি: সংগ্রহীত।
শীতের নিশীথের কথা এখন তোলা থাক। বরং চলে যাই উত্তরায়ণের শেষের দিনগুলো আর দক্ষিণায়ণের প্রথম দিনগুলোতে অর্থাৎ মে মাসের শেষ দিক থেকে অগাস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। বোঝাই যাচ্ছে যে এই সময় ব্যাপারটা হয় ঠিক উল্টো। অর্থাৎ সূর্য উত্তর দিকেই ওঠে আর উত্তর দিকেই অস্ত যায়। কিন্তু এখন এখানে গ্রীষ্মকাল সব সময়েই দিন। কাজেই সূর্য এখন আর একটা চূড়ায় উঠে দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে পাশের চূড়ায় ঢলে পড়ে না। সে সারা আকাশ জুড়ে ঘুরতে থাকে নিজের মতো করে। হাজার হাজার ছোটছোট নক্ষত্রদের যুদ্ধে পরাজিত সে এখন রাজা। তার রাজ্যে এখন আর অন্য কারও ঠাঁই নেই। সারা পৃথিবীকে এখন সে তার নিজের আলোয় ভরিয়ে রাখবে।
উত্তরে উদিত হয়ে দিনের প্রায় বাইশ তেইশ ঘণ্টা জুড়ে উত্তর থেকে পূর্ব দিক হয়ে দক্ষিণ দিক ঘুরে পশ্চিম পার করে সারা আকাশে রাজত্ব করে সে আবার ওই উত্তর দিকেই ফিরে আসে। ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য সেখানেই ঢলে পড়ে একটু বিশ্রাম নিতে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি এই সময়টা হয় মোটামুটি রাত সাড়ে ১২টা থেকে ১টা দেড় টার মধ্যে। কিন্তু চারিদিকে তখনও তার প্রশান্ত জ্যোতি। সূর্যাস্তের মনোরম গোধূলির আলোয় তখনও আলোকিত সারা রাজ্য। আবার দু-তিন ঘণ্টা সেরকম গোধূলির পরেই আবার উত্তরে ওই একই জায়গা থেকে লাল থালার মতো উঠে পড়ে সূর্যটা।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫০: রোজই দেখি আলাস্কা পর্বতশৃঙ্গের বাঁ দিকের চূড়া থেকে সূর্য উঠতে

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৬: ভারতীয় পারিবারিক জীবনে স্নেহময় জ্যেষ্ঠর ভূমিকায় রামচন্দ্র কতটা আকর্ষণীয়?
এই গ্রীষ্মকালে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়টা আমার নিজেকে বড় দুঃখবিলাসী মনে হয়। ঠিক যেমনটা ছিল বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালির’ অপু। নিশ্চিন্দিপুরের অপুর মতো আমারও দূরে দিগন্তে সূর্যটাকে ঠিক যেন মনে হয় মহাভারতের কর্ণের রথের চাকা। সূর্যাস্তের সময় সে যেন তলিয়ে যাচ্ছে ওই দূরদিগন্তে মাটির ভিতর। তার চারপাশে নানা রঙের আর নানান গড়নের মেঘগুলো যেন সত্যিই কর্ণের রথের মতোই দেখতে লাগে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৪: রবীন্দ্রনাথের ‘মুকুট’ ত্রিপুরার ইতিহাসাশ্রিত গল্প

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’
বিশ্ববিদ্যালয়ে লম্বা গরমের ছুটির সুযোগ নিয়ে আমি আর আমার স্ত্রী তখন রোজই কোথাও না কোথাও ঘুরতে বেরিয়ে পড়ি। সকাল থেকে রাত আবার রাত থেকে সকাল, কখন যে পেরিয়ে যায় কোনও খেয়ালই থাকে না। সূর্যাস্তের সময় হয়তো দাঁড়িয়ে পড়ি রাস্তার কোনও এক ধারে। আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলে যাই নির্জন কোনও একটা পাহাড়ের কোলে, অথবা শান্ত সমুদ্রের ধারে, অথবা কোনও হিমবাহের উপরে। সেখানে দাঁড়িয়ে ডুবে যেতে দেখি সূর্যটাকে। আবার সেখান থেকেই খানিক পরে তাকে দেখি উঠে যেতে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯২: দুর্গা টুনটুনি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০৭: লুকাবো বলি, লুকাবো কোথায়?
কর্ণের রথ যেন হয়ে যায় হ্যারি পটারের ‘আজকাবানের বন্দী’ (প্রিজনার অফ আজকাবান) গল্পের সময়যান। বারবার একই ভাবে তার চাকাটা মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে আবার উঠে পড়ছে। আর সেই সময়যানের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে সময়ের খেই হারিয়ে ফেলছি আমরাও। কখন সূর্য ডুবছে, কখনই বা সে আবার উঠছে, সবটাই যেন কেমন রূপকথার মতো। আমি আর আমার স্ত্রী এই দৃশ্য দেখতে দেখতে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি অনেক্ষন। হয়তো কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছি না, কিন্তু এই নির্জন নিশ্চিন্দিপুরের প্রান্তরে কাউকে পাশে পাওয়ার এক নিঃশব্দ অনুভূতি, যেন একে অন্যের দুঃখবিলাসের সঙ্গী।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৮: সকালবেলাই হাঁটতে হবে?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯o: মা সারদার কথায় ‘ঈশ্বর হলেন বালকস্বভাব’
তবে শুধু কর্ণের রথের চাকার সঙ্গে মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া দুঃখ বিলাসিতাই বা কেন বলছি, এই আমি আর আমার স্ত্রী তখন সেই মেঘগুলোকে আর সূর্যটাকে নিয়ে কত রকমের অলীক কল্পনা করতে থাকি। কখনও তারা হয়ে যায় আরব্য রজনীর এক বিরাট দৈত্য যার চোখটা আগুনের মতো জ্বলছে, আবার কখনো বা একটা বিরাট পাহাড়ের গুহা যার সামনেই জ্বলছে আগুন আর তারপরেই হয়তো অন্ধকার। এই হল সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের গল্প আর আমাদের কথা।—চলবে।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।