বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস-এর একটি ভবন। এরই পাঁচ তলায় আমার বসার ঘর।

আমাকে সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে ওরায়ণ চলে গেলেন তাঁর স্ত্রীর গাড়িতে চেপে। আর আমিও দুগ্গা দুগ্গা বলে গাড়ির চাবিটা ঘুরিয়ে একসেলেরাটোরে চাপ দিলাম। ঘড়িতে তখন সবে বিকেল চারটে। কিন্তু চারিদিক ততক্ষণে রাতের মতোই অন্ধকার। বিমানবন্দর থেকে আমার বাড়ি প্রায় সাড়ে তিন মাইল মতো। কোনও রকমে ঢুকঢুক করতে করতে চালাচ্ছি। একবার একটু গতি বাড়াতে গিয়েই দেখলাম গাড়ি টলমল করছে আর পিছলে যাচ্ছে। তাই ঘণ্টায় দশ কি বড় জোর পনের মাইল বেগে চললাম। তারই মধ্যে দেখছি বড় রাস্তা বা হাইওয়ের ওপরে কোনও জায়গায় বেশি বরফ আবার কোনও জায়গায় কম বরফ জমে আছে। আবার কোথাও গাড়ির চাপে বরফ বসে গিয়েছে কিছুটা। কোনও জায়গায় ঢিপির মতো হয়ে আছে। সব মিলিয়ে গোটা রাস্তাটা আমাদের দেশের কোনও প্রত্যন্ত গ্রামে মাটির তৈরি, গর্ত ভরা, ফাটল ধরা, ইঁট ভাঙা রাস্তার চাইতে শুধু খারাপই নয়, তার ওপরে আবার গাড়ি পিছলে যাচ্ছে।
এই প্রথম গাড়ি চালাতে বসে আমার সত্যিই কান্না পেয়ে গিয়েছিল। আমি বরাবরই গাড়ির ব্যাপারে একটু সৌখিন। উইসকনসিনে ওই দিগন্ত প্রসারিত মসৃণ রাস্তার ওপর দিয়ে আমি ছুটিয়ে দিতাম আমার নতুন জার্মান বিএমডাবলু। আর এখানে, বরফ জমে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া রাস্তায় চালাচ্ছি আমার জন্মের আগে তৈরি পুরোনো একটা ট্রাক। উইসকনসিনে চারিদিকে জানলা, উইন্ডশিল্ড, সানরুফের কাঁচের মধ্যে দিয়ে কখনও মিঠে রোদ, কখনও ফল কালার, আবার কখনও বা হালকা তুলো তুলো বরফ যাকে নিয়ে আদিখ্যেতা করা যায়। কখনও জানলায় মাথা ঠেকিয়ে, কখনও আবারা কাঁচে হাতের চেটোটা আলগা ছুঁইয়ে, আবার কখনও বা সান রুফের কাঁচ দিয়ে শুধু আকাশ দেখেই নিজেকে মিলিয়ে দেওয়া যেত বাইরের প্রকৃতির সঙ্গে। আর এখানে তো রোদের দেখা মেলাই ভার। আর বরফ পড়ছে যেন বৃষ্টির মতো। তাতে উপভোগ করার মতো তেমন কিছু নেই, শুধুই একরাশ আশঙ্কা।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩: বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই উইসকনসিনের সঙ্গে পার্থক্যটা টের পেলাম, মুহূর্তে ঠোঁট, গাল জমে যেতে লাগল

স্বাদে-গন্ধে: মিষ্টি কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? বাড়িতে ঝটপট বানিয়ে ফেলুন জিভে জল আনা ক্ষীর মাধুরী

তবে কান্নাকাটির আরও অনেক বাকি ছিল। কোনও মতে ধীরে ধীরে গাড়ি চালিয়ে প্রায় আধ ঘণ্টা পরে পৌঁছলাম আমি যেখানে ঘর নিয়েছি সেখানে। এটা একটা এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। সেখানেই একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকবো। তাদের দপ্তরের সামনে গিয়ে গাড়িটা দাঁড় করালাম। আগে থেকেই কথা বলা ছিল। তাই এই খ্রিস্টমাস ইভের দিনও ভিতরে এক মহিলা আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই তার কাছ থেকে চাবি পাওয়া গেল। কাগজপত্রে সই সাবুদও হল। আমাকে সব কিছু দিয়ে প্রায় হুড়মুড় করে তিনি বেরিয়ে চলে গেলেন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪: আপনি কি খেয়ে উঠেই শুয়ে পড়বেন? জানেন কী হচ্ছে এর ফলে

ছুটির দিনে শুধু আমাকে চাবি আর ওই কাগজগুলো দেওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলো কিছুক্ষণের জন্য। আমার সঙ্গে সব কাজ কর্ম মিটতেই দুদ্দাড় করে চলে গেলেন। আমি সব কাগজপত্তর এক এক করে ব্যাগে পুরে ঘরের দিকে এগোলাম। ভাবলাম আজকের জন্য নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। কিন্তু সমস্যা সবে শুরু হল। গাড়ি চালাতে গিয়ে দেখি ওই পনেরো মিনিটের মধ্যে গাড়ির ব্যাটারি বসে গিয়েছে। পুরোনো ব্যাটারি, খুব একটা ভালো নয়। আমি পড়লাম মহা ফাঁপরে।
আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: সব খাবারের সেরা সুপারফুড কিনোয়া খান, ওজন কমান

মনের আয়না: আপনার সন্তান কি মোবাইলে আসক্ত? এর থেকে মুক্তি পেতে জানুন মনোবিদের পরামর্শ

যদিও এই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স-এর চত্বরে অনেক কটা বাড়ি আছে কিন্তু এই ঠান্ডায় কে আর বেরোবে বাইরে। আমি চিনিওনা কাউকে যে তাকে বাড়িতে গিয়ে ডাকবো। অন্যদিকে এখানকার নিয়মানুযায়ী আমাকে নির্দিষ্ট জায়গাতেই গাড়ি রাখতে হবে। না হলে কেউ নালিশ জানালে আমার ভুল জায়গায় গাড়ি রাখার জন্য গাড়ি তুলে নিয়ে চলে যাবে। তাকে ছাড়াতে হলে আবার প্রচুর হয়রানি। এদিকে দপ্তর থেকেও সবাই বেরিয়ে গিয়েছে যে তাঁদের বলে কিছু ব্যবস্থা করা যাবে। আমি প্রথমেই ওরায়নকে জানালাম ব্যাপারটা। সে বললো যে দেখছে কিছু ব্যবস্থা করা যায় কিনা।

ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস: শীতকালে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার রাস্তা।

এদিকে ওই ঠান্ডায় আমার তখন বেশ খারাপ অবস্থা। হঠাৎ দেখি আর একজন গাড়ি রাখছে কিছুটা দূরে। আমি ছুটে ছুটে গিয়ে তাঁকে ধরলাম। যদি তাঁর কাছে জাম্পার তার থাকে। জাম্পার তার একটি সক্রিয় গাড়ির ব্যাটারি থেকে অন্য নিষ্ক্রিয় গাড়ির ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ঠিক যেমন মুঠোফোনে চার্জ দেওয়া হয়, সেরকম। আমি তার গাড়ির ব্যাটারির সঙ্গে আমার গাড়ির ব্যাটারি যুক্ত করে কোনও রকমে সেটা চালু করলাম। ভাবলাম এ যাত্রায় কোনও রকমে বাঁচা গেল। কিন্তু এতো সবে সন্ধ্যে। রাত তখনও অনেক বাকি। সঙ্গে আমার দুর্দশাও।

ছবি : লেখক
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।
 

বাইরে দূরে

লেখা পাঠানোর নিয়ম: এই বিভাগে পাঠকদের সঙ্গে আপনার সেরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কাহিনি ভাগ করে নিতে পারেন। ভ্রমণ কাহিনি লিখতে হবে ১০০০ শব্দের মধ্যে ইউনিকোড ফরম্যাটে। লেখার সঙ্গে বেশ কিছু ছবি পাঠাতে হবে। চাইলে ভিডিও ক্লিপও পাঠাতে পারেন। ছবি ও ভিডিও ক্লিপ লেখকেরই তোলা হতে হবে। ওয়াটারমার্ক থাকা চলবে না। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content