সান্তা ক্লজের বিরাট মূর্তি।
এখানকার আবহাওয়া অস্বাভাবিক শুকনো। দু’ দিন যেতে না যেতেই হঠাৎ দেখি আমার সারা গায়ে অ্যালার্জির মতো লাল হয়ে চারদিক জ্বলছে। আমি তো প্রথমেই যাঁদের থেকে বাড়ি নিয়েছি তাঁদের দপ্তরে ফোন করেছি যে, ঘরের গালিচায় প্রচুর সংক্রামক জীবাণু বা অ্যালার্জেন আছে। ঘর দেওয়ার আগে তারা ঠিক করে পরিষ্কার করেনি। তারপরে বুঝলাম, আমার অ্যালার্জির মতো যা হচ্ছে তা স্রেফ শুকনো আবহাওয়ার জন্য।
শীত এখানে অস্বাভাবিক রকমের শুকনো। দেখি গোটা গায়ে মোটা করে ক্রিম মেখে বেরোলেও বাইরে আধ ঘণ্টা যেতে না যেতেই সব শুকিয়ে যাচ্ছে। তখন থেকেই গোটা গায়ে বেশ ভালো করে তেল মাখতে শুরু করলাম। তাতে ওই সারা গায়ে হাতে পায়ে জ্বলুনির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গেল। পরে শুনলাম সবাই এখানে তাই করে।
আরও পড়ুন:
রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১২: দ্রুত গাড়ি চালিয়ে ঢুকে পড়লাম নিকটবর্তী একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে
চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন
পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-২: এখানে দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা, বাণিজ্যনীতি এবং বৈদেশিক নীতির চর্চা করা হয়েছে
শেষমেশ, ঝড় শেষ হল মোটামুটি ডিসেম্বরের ২৮-২৯ নাগাদ। মুঠোফোনে সকালবেলা আবহাওয়া দপ্তরের সতর্কতাবাণী এল ‘উইন্টার স্টর্ম হ্যাজ এন্ডেড, কোল্ড ইজ অন দা ওয়ে’। সত্যি কথা বলতে কী, তখনই জাঁকিয়ে পড়ল ঠান্ডাটা। এই তুষারঝড়ের কদিন ঠান্ডা গরম বাতাস মিশ্রিত ঝড়ের জন্য তাপমাত্রার উনিশ বিশ হয়েছিল দিনের মধ্যেই। কখনও মাইনাস ২৫ থেকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে, কখনও মাইনাস ৩০-এর একটু নীচে, আবার কখনও দুপুরের দিকটা করে যখন সূর্যোদয় হয় তখন মাইনাস ২৫-এরও ওপরে। আর এখন প্রায় সারাদিনই মাইনাস ৩৬ থেকে মাইনাস ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা।
সান্তা ক্লজের বাড়ি।
তবে প্রথম দিন ওই এত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও বেরিয়ে আসতে পেরে মনের মধ্যে একটা বেশ আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই স্রেফ পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে মাইনাস ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দেড়মাইল (প্রায় আধঘণ্টা) মতো হেঁটে হেঁটে একদিন গেলাম নিকটবর্তী ফ্রেডমায়ার-এর দোকানে জিনিসপত্তর কিনতে। অবশ্যই গায়ে দু’ তিনটে স্তরে গরমের জামাকাপড় জড়িয়ে। একটুও যে ভয় লাগছিল না, তা বলব না। কিন্তু দেখলাম কিছুই হল না। বরং লক্ষ করলাম অবাক ব্যাপার, একটু জোরে হাঁটলে সেই সময় শরীরে যেহেতু রক্তচলাচল বেশি হয় সেহেতু হাত পায়ের আঙুলগুলোও জমে যাচ্ছে না এতটুকুও। কাজেই ফিরেও এলাম হেটে হেঁটেই; অক্ষত শরীরে।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬০: রাতদুপুরে বিপন্নকে বাঁচাতে হাটখোলার পাট আড়তের টাকা এসেছিল জোড়াসাঁকোয়
বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৬: লিঙ্গ পরিচিতিতে খাদ্যাভ্যাসের রাজনীতি
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১: নাথানিয়্যাল গোবিন্দ সোরেনের গল্প
কাজেই এখন বলা যায়, আমি এখানকারই একজন বাঙালি এস্কিমো। তবে বাঙালি কিন্তু এখানে আমি একা নই। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরেই দেখি আমার কিছু সহকর্মী অধ্যাপক রয়েছেন বাঙালি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর মাস্টার্স বা পিএইচডি পাঠরত বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও রয়েছেন বাঙালি। তাছাড়া এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি।
আরও পড়ুন:
আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৮: সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত গান খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন পঞ্চম
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৬: গরমে কক্ষনও ডিম খেতে নেই?
জানুয়ারির ১৭-১৮ নাগাদ থেকে ঠান্ডা কমে গিয়েছে অনেকটাই। তাপমাত্রা মাইনাস ২০-এর ওপরে থাকছে প্রায় সবসময়েই। মানে উইসকনসিনের মতোই আর কী। আর তার থেকেও যেটা ভালো ব্যাপার সেটা হল, এখানে শিকাগো বা উইসকনসিনের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো হাওয়া নেই। বেশ শান্ত পরিবেশ। কাজেই আর খুব একটা খারাপ লাগছে না। বরং প্রথম দিনই ওইরকম বেয়াড়া অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করে সবকিছুই এখন বেশ ভালোই লাগছে।
শীতকালে জমে যাওয়া নদী।
গাড়ি ভালো নেই বলে এখানকার সাধারণ পরিবহন সম্পর্কেও সব জানা হয়ে গিয়েছে। কখন কোন জায়গায় বাস চলছে, কোথায় তারা দাঁড়ায়, সব কিছুই। দেখলাম যে, এখনকার সাধারণ পরিবহন বেশ ভালো। ঠিক সময়েই সব জায়গায় বাস চলে আসে এবং বিনামূল্যে সব জায়গায় যাওয়া যায়। আর তাতেই আমি বেশি যাতায়াত করছি আজকাল। সব মিলিয়ে বেশ চলছে এখন।
* রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা (Mysterious Alaska) : ড. অর্ঘ্যকুসুম দাস (Arghya Kusum Das) অধ্যাপক ও গবেষক, কম্পিউটার সায়েন্স, ইউনিভার্সিটি অব আলাস্কা ফেয়ারব্যাঙ্কস।