শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


 

সিন্নি: পর্ব-৫

যে পাঠকেরা বাবুকে শুরু থেকে জানেন তাঁদের কাছে বলা নিষ্প্রয়োজন যে সোনার কেল্লার বিখ্যাত সেই ক্যামেল রাইড সিনের থিম মিউজিক- হলো শ্রেয়া বাসুর রিংটোন। ভৈরব চক্রবর্তীর জন্য ফেলুদা থিম মিউজিক। ভৈরব দত্ত’র হ্যাপি প্লে আউট, ফরেনসিকের মফিজুল হকের জন্যে ট্রেন ধরতে ফেলুদাদের নিয়ে উটের দৌড়। মানে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট সংক্রান্ত সকলের জন্যে ফেলুদার আলাদা আলাদা রিংটোন। সিনেমা সংক্রান্ত সকলের ফোনের একটাই রিংটোন চারুলতার শৈশব মনে করানো সেই অসাধারণ বাঁশির সুর। বাকি সকলের জন্য ইসমাইল মার্চেন্টের প্রযোজনায় জেমস আইভরি পরিচালিত ছবি শেক্সপিয়ারওয়ালার জন্য সত্যজিতের করা অনবদ্য আবহ।
—হ্যালো।
—কি বস, ছবিটবি ছেড়ে দিলে?
ফোনের ওপারে প্রডাকশান কন্ট্রোলার রাকেশ সিং অবাঙালি ছেলে কিন্তু জন্ম লেখাপড়া সব কলকাতায়।
—সিনেমা তো মোহ এবং মায়া! ছাড়া যায় না! বিবাহযোগ্যা প্রেমিকার মতো আমায় ছেড়ে সিনেমা অন্য কারো সঙ্গে বাঁধে ঘর। আমি দূর থেকে দেখি বুঝতে পারি সখের সংসার সুখের হয়নি। কিন্তু লোকলজ্জা সমাজের ভয়ে কিছু বলতে পারি না!
—জিও! ওয়েব সিরিজ করবি?
—গপ্পোটা কে লিখবে?
—সে লোক আছে! কিন্তু তুই করবি কিনা বল?
—আমাকে দিয়ে সিরিজ করাতে চায় কে?
—সে সব বলবো তার আগে তুই হ্যাঁ বললে আমি এগোবো তুমি শালা সত্যজিতের বরপুত্র তোমার কাছে ছবির সাবজেক্ট হল প্রথম পছন্দের।
—না আমার প্রেডিকেটও পছন্দ। কিন্তু সেটা যেন কমিউনিকেট করে। ন্যারেটিভটা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। এমন একটা অদ্ভুতুড়ে কিছু ভাবলাম যেটাতে একসপ্তাহ বাদে আমি নিজেই কনভিন্সড নই, সেটা নিয়ে কাজ করবো কি করে।
—তাহলে আমি কী বলবো, তুই ছবি করবি হ্যাঁ কি না।
—আমি গপ্পোটা আগে শুনি।
—তাহলে মেয়েটাকে পাঠাই?
—মেয়ে কোত্থেকে এলো।
—কি মুশকিল রাইটার তো মেয়ে!!
—না না, তাহলে বাড়িতে ডাকা যাবে না।
—তুমি তো আচ্ছা সেকেলে বস!!
—হ্যাঁ, গোয়েন্দাগিরি করি তো এসব ক্লু না রাখাই ভালো, এতে দেশ ও দশের উপকার হবে।
—তাহলে গপ্পো?
—একটা কফিশপে ডাক তুইও থাক ওখানেই গপ্পো শুনে নেবো।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৫: ধৃতিমানের ওপর কি শ্রেয়া নজর রাখছিল? নাকি অন্য কেউ?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ

আসলে বহুদিন সিনেমার থেকে নির্বাসিত ধৃতিমান। আলো ক্যামেরার ফ্লোরের ব্যস্ততার অদ্ভুত একটা নেশা আছে। যারা এর স্বাদ পেয়েছে তারা জানে। তাছাড়া রোজগারও চাই জমানো টাকা তো দিনে দিনে ফুরিয়ে আসছে। গরমকালে কর্পোরেশনের জলের মতো বালতি ডেচকিতে সঞ্চয় করে রাখতে হয়। ফোন ছেড়ে বাবু ভাবতে বসল ঠিক কি কি দেখেছিল বাঁশতলা লেনের ঘোষ ভিলাতে।

পুরনো রকিং চেয়ারটায় দোল খেতে খেতে বাবু প্রথম ভাবতে শুরু করল। কিন্তু কি অদ্ভুত মন তো আর নিয়ন্ত্রণে থাকে না। মনকে বললাম ঘোষ ভিলার কথা ভাবো আর মন উল্টোডাঙা মুচিপাড়া থেকে হুস করে সল্টলেক ছুঁয়ে বাইপাস ধরে মা ফ্লাইওভার বরাবর উড়ে চিড়িয়াখানা মাঝেরহাটের নতুন ব্রিজ টপকে জেমস লং ধরে চলল ২৯ এর পল্লী থেকে বাঁয়ে বেঁকে এস এন রায় রোড বাঁশতলা লেন হয়ে চলে গেল ঘোষ ভিলায়। মেটা ফিজিক্সের মাইন্ড ট্রান্সপোর্টেরশনের মতো। তারপর সিনেমাতে দেখা দৃশ্য। ঝাঁই-ঝাঁই করে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চলতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে, একেকটা করে ক্লু চোখের সামনে ঝলসে উঠতে থাকবে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

না! প্রথমেই মনে হল এই চেয়ারটার কথা। পুরনো রকিং চেয়ারটা সল্টলেকে একটা ছোটখাট একটা ফার্নিচার্সের দোকান থেকে কেনা। যতদূর মনে আছে মাকালী ফার্নিচার্স। গিয়েছিল একটা ছবির ফাইন্যান্সারের সঙ্গে কথা বলতে তার বাড়িতে যাবার সময় নজরে পড়েছিল ওই রকিং চেয়ারটার দিকে। ঠাঠা রোদ্দুরে বেচারিকে ফুটপাথেই বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গায়ে এক প্রস্থ গালা-গোলা তার্পিন তেল মাখানো হয়েছিল সদ্য। ট্যাক্সিতে যাবার সময় রাস্তার ওপেন ময়লা ফেলার উপচে পড়া পাত্র বা ডিজেল-ধূলো মেশা শহুরে দূর্গন্ধকে ছাপিয়ে নাকে এসেছিল তার্পিন তেলের ঝাঁঝালো ঝলক।

আচ্ছা ঘোষ ভিলায় কি সেদিন বিশেষ কোনও গন্ধ পেয়েছিল ধৃতিমান। মাছের গন্ধ? না ঠিক মাছের নয় কিন্তু একটা আঁশটে গন্ধ। কিন্তু এটা মনে হতেই সত্যি সত্যি হালে দেখা ওয়েব সিরিজের মতো একেবারে সিলিং হাইটের টপ শট থেকে ঝুপ করে ক্যামেরা জুম করে গেল সিঁড়ির রেলিংয়ের হাতলে। চক্রবর্তী সাহেব ঠাট্টা করে বলেন সিনেমাওয়ালা গোয়েন্দা তাই চোখ দুটো খুব শার্প আর সবকিছুর মধ্যেই সিনেমা খুঁজে বেড়ায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৯: মহাভারতের বিচিত্র কাহিনিগুলিতে আছে মৃত্যুজয়ের অভয়বাণী

কিন্তু ভৈরব চক্রবর্তী প্রশংসা এখানে কাজে লাগলো না। ঘটনাটা ধৃতিমানের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে। ইটের ওপরে রড আয়রনের ডেকোরেটিভ গ্রিল তার ওপর কালচে কাঠের হাতল। কালো বলেই সেদিন আলাদা করে চোখে পড়েনি। আর ঘটনাটা যখন দোতলায় ঘটেছে, তখন মানসিক প্রস্তুতিটাও দোতলাটাই ভালো করে দেখার জন্য প্রস্তুত ছিল। হ্যাঁ এখন স্পষ্ট মনে পড়ছে দু’ দুবার নজরে এসেও মাথায় পৌঁছয়নি।একটা কালচে স্পট অস্পষ্ট শুকনো হালকা ধুলোর আস্তরণ জমা। সেটা কি হাতের মোছার রক্তের দাগ? তাই কি?

হঠাৎ মনে হল মফিজুলের কথা। মফিজুলের চোখ দুটো শিকারি কুকুরের থেকেও তীক্ষ্ণ। এত বছর ধরে ফরেন্সিকে কাজ করছে কাঠের হাতলের ওপর দাগটাকি মফিজুলেরও চোখ এড়িয়ে যাবে ?

ফোন করতে গিয়ে থমকে গেল এখন কাজের সময়। নিশ্চয়ই গভীরভাবে কোন একটা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। তাই একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল—”একবার ফোন করবে প্লিজ!”

বুবু ঝিমোচ্ছে। খাঁচায় একটা দড়িবাঁধা কাঠের বল ঝোলানো আছে বুবু সেখানে মাথাটা রেখে নিজে নিজে সুড়সুড়ি খায় আর ঝিমোয়। এটা বুবুর রোজকার নেশা। খানিকটা আফিমের মৌতাতের মতো।

রকিং চেয়ারে ছোটছোট দোল খাচ্ছে বাবু। চিন্তাকে থামিয়ে রেখেছে ঠিক তখনি মোবাইলে সোনার কেল্লার বিখ্যাত উটের দৌড়ের আবহ। মফিজুল ফোন করছে। —চলবে।
 

ঘোষ পরিবার হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী ২৫ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content