বৃহস্পতিবার ৫ জুন, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

মূল সংস্কৃত শব্দ ‘জামাতৃ’… তার প্রায়োগিক রূপ জামাতা। ভাষা-টাসা ভেসে চলে গেলে দেখা যাবে, শব্দটার মধ্যে জামা আছে, মাতাও আছে। সে থাকুক, কাদের হাত ধরে কোন পথে জামাতা জামাই হয়ে উঠলো সেই নিয়ে ভেবে লাভ নেই। মোটের ওপর, জামাই কী, কেন, কীভাবে, কার এবং কবে তা সামাজিক মানুষমাত্রেই জানেন। পৃথিবীতে বহু বিখ্যাত জামাইদের কথা শোনা যায়। আসলে, খ্যাতিমান মানুষ বিবাহিত হলেই জামাই পদে উত্তীর্ণ বা অবতীর্ণ হন, অখ্যাত লোকদের মতোই। আবার, বিখ্যাত লোকজনদের জামাইরাও পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন।
সুকুমার রায় ঠিকানা খুঁজতে খুঁজতে জানিয়েছেন, জনৈক খগেনের মামাশ্বশুর শ্যাম বাগচী, তাঁর জামাই কেষ্টমোহন। কেষ্টমোহনকে নিয়ে আমরা কি করব? কিছুই না, ঠিকানা এমনিতেই মেলে না। সেই যে সব অতি বড় বৃদ্ধ পতি কুলীন জামাইরা রীতিমতো লেজার বুক আর অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টার মেনটেইন করে করে শ্বশুর বাড়ি ঘুরতেন পাঁচশো কিংবা তার একটু বেশি-কম বিয়ে করে, তাদের যদি জামাইষষ্ঠীর দিন ডাকা হতো তাঁরা কি করতেন? হালখাতায় বিপুল নেমন্তন্ন পাওয়া খদ্দের কিংবা সরস্বতী পুজোর সকালে ব্যস্ততম ব্রাহ্মণের কাজটাও এর চেয়ে খানিক সহজ বোধহয়। সমাজমাধ্যমে অগুনতি বাটিঘটির মধ্যে বিদ্যমান জলটুঙ্গীর মতো কোনও এক জামাইয়ের ছবি প্রতি বছর ভাসে। জামাইষষ্ঠীর ব্যাপারটা আসলে সব কিছু ছাপিয়ে ওই খাদ্যাখাদ্যবিনিশ্চয়েই ঢুকে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

পর্দার আড়ালে, সত্যজিতের রায়, অপু থেকে আগন্তুক, পর্ব-১: খাওয়াব আজব খাওয়া

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১৭: আপাতত পরিত্রাণ

কালীপ্রসন্নের সময়ের বাংলা থেকে এখনকার বঙ্গভূমির জামাইদের শ্বশুরবাড়ি আসা যাওয়ার খাতির পঞ্চম জর্জ কিংবা মন্ত্রী-সান্ত্রীর আগমনের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। অবশ্য নিন্দুকরা ঘরজামাইদের নিয়ে নানা মস্করা করে, গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না জাতীয় কিছু একটা বলতে চায় তারা। জামাই ছাড়াও ভাগনেদের নিয়েও তাদের নানা থিওরি আছে, সে থাকুক। সেই বিখ্যাত জামাইদের গল্পটা জানা আছে তো? চার জামাই শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ফেরার আর নাম করে না। শেষে এক ফন্দি আঁটা হল। প্রথম পাতে ঘি পেল না কেউ, বাকিদের কিছু এল গেল না। কিন্তু হরি অপমানিত হয়ে ফেরত গেল। এর পরে বসার আসন না পেয়ে মাধব চলে গেল বেজায় অপমানিত হয়ে। থেকে যাওয়া বাকি দু’জনকে বাসি পচা খাবার, কদন্ন দেওয়া হল। তাদের হেব্বি রেগে পুণ্ডরীকাক্ষ চলে গেল। কিন্তু ধনঞ্জয় আর যায় না। এরপর গেঁয়ো যোগীর ওপর মুষ্টিযোগ ছাড়া আর কিছু চলে না বোধহয়, তাই প্রহারেণ ধনঞ্জয় আর কী!
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১০১: ছিট ঘুঘু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০০: অসুস্থ শরীরেও ভক্তদের দীক্ষাদান শ্রীমার

এই যে ভাগ্নে আর তাদের বাবা অর্থাৎ আদি অকৃত্রিম জামাইদের নিয়ে ঠাট্টা তামাশা এই নিয়ে কোনও মুভমেন্ট নেই, কোনও ইউনিয়ন কিংবা অ্যাসোসিয়েশন-ও গড়ে ওঠেনি এতদিনে। এই যেমন পুলিশ যখন তার অভীষ্টদের ধরে, তখন কাউকে মামাবাড়ি, কাউকে বা শ্বশুরবাড়ির খাতিরের কথা স্মরণ করানো হয়। সেই কাবুলিওয়ালা যখন মারপিট করে পুলিশের হাতে বন্দী, তখন মিনিকে বলে গিয়েছিল শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। পটচিত্রে বাঙালিবাবুর মাছ, রসগোল্লা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি আগমনের কিংবা চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়তে অভ্যর্থিত হওয়ার আইকনিক ছবিতে কিংবা আইকম বাইকম তাড়াতাড়ি যদু মাস্টারের ঝমাঝম রেলগাড়ি চেপে শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার তাড়ায় পা পিছলে নাস্তানাবুদ হওয়ার গল্পে বাঙালি জামাই বাবাজীবনদের যে রূপ ফুটে ওঠে তা বেশ কালজয়ী বটে। যদু মাস্টার তাড়াতাড়ি স্কুলের কাজ মিটিয়ে আলুর দম খেতে শ্বশুরবাড়ি দৌড়ে যান কীনা বলা মুশকিল, সেদিন জামাইষষ্ঠী ছিল কীনা তাও বলা যায় না, কিন্তু এই সম্পর্কের ক্ষেত্রটা বেশ মজার।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮০: রাজনীতিতে সবাই চায় সবলের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখতে, দুর্বলরা সব সময়ই একা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১৬: রাম যৌথ পরিবারের আদর্শনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ, তাঁর যেন এক ঘরোয়া ভাবমূর্তি

ষষ্ঠীপুজোর ব্যাপারটাতেও সামাজিক তির্যকতা আছে, বিশেষত ব্যক্তিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠানকে সমষ্টির করে তুললে। গুষ্টির ষষ্ঠীপুজোর পিছনে নানা ভদ্র-অভদ্র ইঙ্গিত আছে। তবে ষষ্ঠীঠাকরুণের কাছে সন্তানের মঙ্গল কামনার পর তাকে তৃপ্ত করার যে আয়োজন যে অনুষ্ঠানে নিজের মতো করে বাঙালি সমাজ করে নিয়েছে, তা নাকি আদিতে একটি নারীকেন্দ্রিক আচারানুষ্ঠান ছাড়া কিছু নয়, কীভাবে কোনও গলিপথে জামাইদের হস্তগত হয়েছে। এর পিছনেও আসলে পুরুষতান্ত্রিক একটা চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র আছে হয়তো, থালাটা নিজের দিকে টেনে নেওয়ার। আর যা যা থালার শোভা বৃদ্ধি করবে, শ্বশুরমশাইদের দ্বারা বাহিত, শ্বাশুড়িমায়েদের দ্বারা সংস্কৃত হয়ে থালায় একটু জিরিয়ে সোজা পেটে ল্যান্ড করবে তাদের রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ নিয়ে একটা মহাভারত হয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৭: রবীন্দ্রনাথ ব্যারিস্টার হতে চেয়েছিলেন

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৮: হেলিকপ্টারে সওয়ার হয়ে চূড়ার কাছাকাছি গিয়ে পাহাড় দেখার রোমাঞ্চটাই আলাদা

দেশের জিডিপি কিংবা উন্নতিও হয়তো এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কেননা, এই সময়ে বাজারমূল্যে যেভাবে মূল সংখ্যার পাশে শূন্যের বাড়বাড়ন্ত তাতে খরিদ্দার যে চন্দ্রবণিকের অধস্তন উত্তরপুরুষ সে বিষয়ে সংশয়টুকুও কেটে যায়। যাই হোক, গুপী বাঘা রাজার জামাই হয়েছিল পাকেচক্রেই। নিজেদের মূল্যায়নে গান বেঁধে গুপী জানিয়েছে, তারা খায় দায় ঘোরে ফেরে, দিনে বাবুগিরি করে রাতে আয়েশে ঘুমায়। শ্বশুরমশাইদের পৃষ্ঠপোষণা এইরকম বোধহয়। ধনঞ্জয়ের কথাটাও ভুললে চলবে না। তবে আধুনিক মস্করায় স্কুলবালক স্যারের যে কোনও প্রশ্নকেই অভিন্ন উত্তরে এনে ফেলে। বড় হয়ে কী হতে চাও, তোমার জীবনের স্বপ্ন কি অথবা মা বাবার জন্য কী করতে চাও এসব নানা দৃষ্টিকোণের প্রশ্নে একটাই উত্তর—জামাই হতে চাই, মা বাবার জন্য ঘরে বৌ আনতে চাই। এই ক্লাসটার শেষেই যদু মাস্টার শ্বশুরবাড়ি দৌড়েছিলেন?
* ড. অভিষেক ঘোষ (Abhishek Ghosh) সহকারী অধ্যাপক, বাগনান কলেজ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ থেকে স্নাতকস্তরে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত। স্নাতকোত্তরের পর ইউজিসি নেট জুনিয়র এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগে সাড়ে তিন বছর পূর্ণসময়ের গবেষক হিসাবে যুক্ত ছিলেন। সাম্বপুরাণের সূর্য-সৌরধর্ম নিয়ে গবেষণা করে পিএইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন। আগ্রহের বিষয় ভারতবিদ্যা, পুরাণসাহিত্য, সৌরধর্ম, অভিলেখ, লিপিবিদ্যা, প্রাচ্যদর্শন, সাহিত্যতত্ত্ব, চিত্রকলা, বাংলার ধ্রুপদী ও আধুনিক সাহিত্যসম্ভার। মৌলিক রসসিক্ত লেখালেখি মূলত: ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে চলেছে বিভিন্ন জার্নাল ও সম্পাদিত গ্রন্থে। সাম্প্রতিক অতীতে ডিজিটাল আর্ট প্রদর্শিত হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে, বিদেশেও নির্বাচিত হয়েছেন অনলাইন চিত্রপ্রদর্শনীতে। ফেসবুক পেজ, ইন্সটাগ্রামের মাধ্যমে নিয়মিত দর্শকের কাছে পৌঁছে দেন নিজের চিত্রকলা। এখানে একসঙ্গে হাতে তুলে নিয়েছেন কলম ও তুলি। লিখছেন রম্যরচনা, অলংকরণ করছেন একইসঙ্গে।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content