রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


বার্নার্ড শ এবং শার্লটি।

প্রাক চল্লিশে বিবাহিত বার্নার্ড শ এবং তাঁর স্ত্রী শার্লটি পায়েন টাউনসেন্ড এক অশ্রুতপূর্ব জুটি—না ছিল যাদের মধ্যে প্রেমের বন্ধন, না ছিল শারীরিক আকর্ষণ। তবু তাঁরা যেন একে অপরের জন্য। বার্নার্ড শ জীবনে অনেক নারীর সঙ্গে প্রেমে পরেছেন। বুদ্ধির দ্যুতিতে নারীদের আকৃষ্ট করেছেন। কিন্তু এক অদ্ভুত নিস্পৃহতা নিয়ে মিশেছেন। কারও প্রতি গভীর প্রেম বা আকর্ষণ হয়নি। সম্ভবত নিজের অহংকে তৃপ্ত করতে নারীসঙ্গ করেছেন। আর শার্লটিও মাতৃত্বকে ভয় পেয়ে নিজের শারীরিক চাহিদাকে অবদমিত করে রেখেছেন। দু’জনই নিজের নিজের জায়গায় স্বতন্ত্র থাকতে পেরেছেন।
কেন এমন অদ্ভুত ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ সম্পর্ক? উত্তর খুঁজতে যেতে হবে উভয়ের শৈশব জীবনে। শ এর বাবা ছিলেন নিঃসম্বল, আবার মদ্যপ। স্বামীর প্রতি চরম ঘৃণায় মা ও সংসারে উদাসীন। ফলশ্রুতিতে শ এর শৈশব ছিল অবহেলাক্লিস্ট। পরবর্তীকালে শ তাঁর ছেলেবেলার এই অসুস্থ পরিবেশের কথা বলেছেন। এর ফলে তিনি খুবই আত্মনির্ভর হয়ে বড় হয়ে ওঠেন। কিন্তু মনের স্বাভাবিক আবেগগুলো যেন প্রতিবন্ধী হয়ে পরে।

এমনটি নয় যে, ছেলেবেলায় তাঁর প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করা হতো। কিন্তু বাবা-মায়ের তাঁর প্রতি ঔদাসীন্য শিশুর সুকোমল বৃত্তিগুলো বাড়তে দেয়নি। স্নেহ, ভালোবাসা, নির্ভরতা এগুলো কিছুই পাননি। তিনি লিখেছেন, বড় হয়ে এ কারণেই স্নেহ, ভালোবাসা, মমতা এগুলোর প্রতি এক বিপদজনক ছলচাতুরীর অভ্যাস হয়েছে তাঁর। শৈশবে মায়ের অবহেলা পরবর্তীকালে এক অদ্ভুত মানসিকতা তৈরি করেছিল। যৌবনে মেয়েদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে চাইতেন। মেয়েদের ভালোবাসা, মনোযোগ আকৃষ্ট করতেন। অথচ সেই ভালোবাসার প্রতিদানের কোনও ইচ্ছেই জাগতো না মনে। যেন নিজের অহংকেই তৃপ্ত করা একমাত্র চাওয়া।
আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪৬: ম্যাঙ্গো বাইট

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭২: বনবাসজীবনে প্রকৃতির প্রভাব কি রামের দুঃখকে মুছে দিয়েছিল?

অপরদিকে শার্লটিও এক অসুস্থ পরিবেশে বড় হয়েছেন। ধনীর দুলালী। কিন্তু মা অসম্ভব দাপুটে। সারাক্ষণ বাবার সঙ্গে ঝগড়া। বিন্দুমাত্র মতের অমিল হলেই চিৎকার করে বাড়ি মাথায়। একটাই বক্তব্য, তিনি নাকি সংসারের জন্য প্রাণপাত করছেন। কিন্তু কেউ তার খেয়াল রাখছে না। এ অবস্থায় বড় হওয়ার ফলে, বিয়ে এবং মা হওয়ার প্রতি এক তীব্র অনীহা দানা বাধে মনে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

শ এবং শার্লটি তাই যখন বিবাহ বন্ধনে জড়ালো সেটি দু’জনের জন্যই উপযুক্ত হল। শ এর সঙ্গে শার্লটির প্রথম আলাপ ১৮৯৬ সালের জানুয়ারিতে। শার্লটি নিজেকে সেই সময়, পরিবারের বন্ধনহীন, অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন ও একটু অন্য ধরনের মেয়ে বলে বর্ণনা করেছেন। তার নিজেকে সাধারণ মানুষের মত আশা, নিরাশা, ভয়, ভবিষ্যৎ চিন্তা এ সব থেকে মুক্ত মনে হয়েছে। কোনওকিছুই তাকে যা মন চায় তাই করা থেকে আটকাতে পারবে না। এমনি অদম্য তখন তিনি। ওই বছরের গ্রীষ্মের ছুটি তিনি শ এর সঙ্গে কাটালেন। সারা বিকেল দু’জনে সাইকেল নিয়ে কান্ট্রিসাইডে ঘুরতেন। অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করতেন। শার্লটি শ এর প্রেমে পরলেন। তবে শ তো প্রেমে পড়ার লোক নন। মজা পেলেন এই ঘনিষ্ঠতা থেকে। ইতিমধ্যে তিনি অভিনেত্রী এলেন টেরি (Ellen Terry)-র সঙ্গে জমিয়ে প্রেমের খেলা খেলছেন। এলেনকে বললেন যে, বিয়ে নাকচ করার জন্যই তিনি শার্লটিকে বিয়ের কথা বলেন। শার্লটিকে তার প্রেমে পড়তেও বারণ করেছেন।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৪: টলস্টয় ও সোফিয়া—‘আমি জেনেশুনে বিষ করেছি পান’/৪

সম্পর্কের মোড় ঘুরল বছর দেড়েক পরে। ১৮৯৮ এর এপ্রিল মাস। শার্লটি দীর্ঘদিনের জন্য পৃথিবী ঘুরতে বেড়িয়েছেন। হঠাৎ লন্ডন থেকে খবর গেল, শ খুব অসুস্থ। তার পায়ে আঘাত লেগেছে। সে আঘাত হাড় পর্যন্ত গিয়ে পা ফুলে ঢোল। নেক্রোসিস অফ বোন। দু’ দু’বার অপারেশন হয়েছে। আঠারো মাস ধরে ক্রাচে ভর দিয়ে কোনওরকমে চলছেন। খবর পেয়েই শার্লটি বেড়ানো ছেড়ে চলে এলেন। শ’কে নিয়ে কান্ট্রিসাইডে একটি খোলামেলা বাড়ি ভাড়া করলেন। তারপর পরম যত্নে এবং মমতায় সেবা করে সুস্থ করে তুললেন তাকে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

এরপর শ এবং শার্লটি যখন একসঙ্গে থাকার কথা আলোচনা করতে বসলেন, শ এর মনে হল শার্লটি তার জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন। শ বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। তারিখটা ছিল দোসরা জুন ১৮৯৮, প্রস্তাব দিয়ে নিজের মনের মধ্যেই এক অস্থিরতা এল। প্রেম করবেন, বিয়ে করবেন না। কোনও আবেগের বশবর্তী হবেন না। এতদিন এমনই প্রতিজ্ঞা ছিল নিজের কাছে। লন্ডনের এক কাগজে এক মজার বিজ্ঞাপণ দিলেন বিয়ে করার সপক্ষে। বিজ্ঞাপনটি ছিল এরকম, “গতকাল এক ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। পথে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে তারা একটি অফিসে আশ্রয় নেয়। সেটি ম্যারেজ রেজিস্টার এর অফিস। রেজিস্টার দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় দু’জন সেখানে আশ্রয় নেওয়ায় কিছু বুঝতে না পেরে তাদের বিয়ে দিয়ে দেন”। শার্লটির ছিল প্রচুর সম্পত্তি। বিয়ের ফলে শ সবদিক দিয়েই লাভবান হলেন।—চলবে।
*ড. দুর্গা ঘোষাল (Durga Ghoshal), প্রাক্তন অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content