বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


আশা ভোঁসলে ও আরডি বর্মণ।

আজকের যুগেও পঞ্চমের সুরের মহাসমুদ্রে গা ভাসাতে আবালবৃদ্ধনিতা যে সদাপ্রস্তুত, তার কারণ একটিই। সেটি হল তাঁর সুরের সুদূরপ্রসারী প্রভাব। ঠিক যেমন মাঝ সমুদ্রে জন্ম নেওয়া একটি ঢেউ পাড়ে এসে সজোরে আছড়ে পড়ে। আপাদমস্তক সিক্ত করে তোলে আমাদের। ঠিক একই ভাবে, পঞ্চমের জন্ম দেওয়া এক একটি সুর যেন আছড়ে পড়ে আমাদের হৃদয়ে। এক নিমেষে ভিজে যায় আমাদের সঙ্গীত পিপাসু মন।

যুগের পর যুগ পেরিয়ে গিয়েছে, তবুও পঞ্চমের জন্ম দেওয়া সুরের উপর একটুও ধুলো জমেনি। সুরগুলি আজও একইরকম তাজা। সেই সুরগুলির মধ্যে আমরা আজও খুঁজে পাই জীবনের অনুভূতি। খুঁজে পাই আমাদের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন। খুঁজে পাই প্রেম, বিরহ, আনন্দ, বেদনা সব। তাই খুব স্বাভাবিক ভাবেই এই সুরগুলির বয়স শৈশবেই থেমে থাকে। কারণ প্রেম, বিরহ, আনন্দ, বেদনা ইত্যাদি অনুভূতি যুগ নির্বিশেষে একই থেকে যায়। যুগের বিবর্তন এই সব অনুভূতিকে মুছে ফেলতে পারে না। তাই, পঞ্চমের সুরও একই কারণে স্বমহিমায় বেঁচে থাকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
এই প্রসঙ্গে উঠে আসতেই পারে আশা ভোঁসলের গাওয়া ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না’ গানটি। সেতারে যেনো ঝরে পড়ে প্রেমিকার অভিমান। অন্তরা তো বটেই, সঞ্চারিও বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয়। দুটির মধ্যে সুরের এই বৈচিত্র্য সুনির্দিষ্ট ভাবে কানে ধরা দেয়। সংগীতের ব্যাকরণ না জানা থাকলেও বেশ বুঝতে পারা যায় যে, এই সুরের মান যথেষ্টই উৎকৃষ্ট। আশপাশে ছড়িয়ে থাকে নানাবিধ সুরের মাঝে এই সুর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সদর্পে।

আশারই গাওয়া ‘ঝুম ঝুম ঝুম রাত নিঝুম’ গানটিও অসাধারণ। মন মাতানো ছন্দ। এই ছন্দের তালে শরীর দোলাতে ইচ্ছে করবেই। প্রেলুড, ইন্টারলুড এবং ফিলারগুলি এতটাই উপযোগী যে এই গানটিকে কোনও অজুহাতেই উপেক্ষা করা একরকম অসাধ্য। আর এই ক্ষেত্রে আশা ভোঁসলের কথা উত্থাপন করা নিতান্তই বাতুলতা বলে গণ্য হবে। যাঁর কণ্ঠে স্বয়ং মা সরস্বতীর বাস, তাঁর সম্পর্কে নতুন করে কিই বা বলা যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬৪: এক দিন পাখি উড়ে যাবে যে আকাশে…

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩৯: রাঙা হাসি রাশি রাশি

পঞ্চম-আশার দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া ‘যায় রে যায় রে বেলা যে বয়ে যায় রে’ গানটি আপনারা শুনেছেন তো বটেই। কিন্তু গানটির বৈশিষ্ট্য কি জানেন? প্রথম বৈশিষ্ট্য হল, গায়ক-গায়িকার কণ্ঠে হারমোনাইসেশন। দ্বিতীয়টি হল, গায়ক এবং গায়িকার কণ্ঠকে ফিলার হিসেবে ব্যবহার করা। সাধারণত কোনও বাদ্যযন্ত্রকেই ফিলারের কাজে লাগানো হয়। যেমন ধরুন, হারমোনিকা, সাক্সোফোন, বাঁশি অথবা অন্য কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট। কিন্তু সুরকার যে পঞ্চম! আলাদা কিছু না ভাবলে কি চলে? তাই তাঁর এই প্রচেষ্টা। আশার গাওয়া অংশে তিনি ফিলার দিয়েছেন। তাঁর গাওয়া অংশে আশা ফিলার দিয়েছেন। সেই প্রচেষ্টায় তিনি একশোভাগ সফল। সফল, মানুষের মন জয় করার ক্ষেত্রে।

একটি দৃশ্যে নিজেকে মনে মনে কল্পনা করুন। অলস বিকেল। পড়ন্ত সূর্যের আলো এসে পড়েছে আপনার বারান্দায়। আপনি সেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন চায়ের পেয়ালা হতে নিয়ে। হঠাৎ দুর থেকে আপনার কানে ভেসে এলো ‘তোমাতে আমাতে দেখা হয়েছিল জানি না কবে কোথায়’ গানটি। কেমন হবে আপনার অনুভূতি? স্কুল অথবা কলেজ জীবনের কোনও এক বিশেষ দিন, অথবা কোনও এক বিশেষ মুহূর্তের কথা কি মনে পড়ে যাবে না? যে বিশেষ মুহূর্তের কথা আজও কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারেননি আপনি? যা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত? এই গানের স্বার্থকতা এখানেই। আরও নির্দিষ্ট ভাবে বললে, এই সুরের ক্ষমতা এতটাই। পঞ্চমের কণ্ঠ এবং গায়কী যেন এই গানটির জন্য আদর্শ। এই গানের অন্য কোনও সংস্করণ আমাদের কর্ণেন্দ্রিও হয়তো মেনে নিতে রাজি নাও হতে পারে। আমার অনুমান।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’

ভোটস্য পরিবেদনা

যেমন ধরুন ‘শোনো মন বলি তোমায়, সব করো প্রেম করো না’। এই গানটিও এমন ভাবে আমাদের শরীরে মনে মিশে আছে, যে এই গানে পঞ্চম ব্যতীত অন্য কোনো কন্ঠ কোথাও গিয়ে যেনো বেমানান বলে মনে হতে পারে। এই গানের জন্য রাহুল দেব বর্মনের কণ্ঠের ওই বিশেষ টেক্সচারটিই যেন সব দিক থেকে মানানসই।

গানের ইন্ট্রো এবং পঞ্চম কণ্ঠে আলাপ। দুটিই নিঃসন্দেহে রহস্যময়। কোন গানের কথা বলছি? গানটি হল ‘নদীর পাড়ে উঠছে ধোঁয়া, মনে হয় কিছু হয়েছে’। খুব মন দিয়ে গানটি যদি শোনা যায়, পাওয়া যাবে পঞ্চমের ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভার পরিচয়। তবলার লয় এবং পঞ্চমের উপস্থাপনা। দুটির মধ্যে অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি যোগাযোগ পরিলক্ষিত হয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এই দুইয়ের মধ্যে কোনওই সমন্বয় নেই। কিন্তু গানটির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়ে যদি গানটিকে শোনার প্রচেষ্টা করি, তাহলে আমাদের সেই ভুল ভাঙ্গবেই ভাঙবে। কি অসাধারণ সৃষ্টি! এই গানে তবলার ব্যবহার এতটাই নিখুঁত যে, আমাদের উত্তেজনাকে চরমে পৌঁছে দেয় এই দেশজ বাদ্যযন্ত্রটি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৯: বাইনাচ-গানেরও কদর ছিল ঠাকুরবাড়িতে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৩: তরু দত্ত— এক আনন্দ বিষাদের তরুলতা

আরও অজস্র সুররত্ন আধুনিক বাংলা গানের আকারে আমাদের উপহার হিসেবে দিয়ে গিয়েছেন সচিনপুত্র, মা সরস্বতীর বরপুত্র রাহুল দেব বর্মণ। যে গানগুলি এই প্রবাদপ্রতিম মানুষটির সংগীতমনস্কতা, জ্ঞানগরিমা, অধ্যাবসায়, গবেষণা এবং নতুন কিছু করার তাগিদ এ সবের সাক্ষ্য বহন করে। যে গানগুলি আজও বাঙালিকে সমৃদ্ধ করে রেখেছে এপার বাংলা-ওপার বাংলা নির্বিশেষে। একইভাবে সমৃদ্ধ করে রাখবে আগামীতেও। সুরসাধক পঞ্চম সুরারোপিত বাংলা গানের সুসজ্জিত ডালি রাঙিয়ে দেবে আপামর বাঙালির হৃদয়ের আঙিনা। দিনের পর দিন। বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ।—চলবে।
* পঞ্চমে মেলোডি (R D Burman): সৌম্য ভৌমিক, (Shoummo Bhoumik) সঙ্গীত শিল্পী।

Skip to content