বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

সেই অন্য পথে ছিল এক মোটাসোটা বেড়াল। ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে আমাদের যাতে ধরতে না পারে তাই সপরিবারে অন্য পথে যেতে গিয়েই সেই বেড়ালের একেবারের মুখের সামনে এসে পড়লাম আমরা। ইঁদুরের দল সেই বেড়ালটিকে দেখেই একেবারে ছুটোছুটি শুরু করল আর আমি অন্য রাস্তায় তাদের নিয়ে গিয়েছি বলে সকলে আমাকে দোষারোপ করা শুরু করল। নিজের রক্তের ধারায় পৃথিবী যেমন করে ধুয়ে যায় ঠিক তেমনই ভাবে স্রোতের মতো তারা সেই দুর্গের মধ্যে গিয়ে লুকালো। বলা ভালো এ কেবল বিধির পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। ভাগ্য সহায় না থাকলে একটি মৃগ যেমন ব্যাধের জালে ধরা পড়লেও সেই জাল কেটে, অন্য ফাঁদ ছিড়ে পালিয়ে, চারিদিকে আগুনের ঘেড়াটোপ থেকে রক্ষা পেয়ে, এমনকি ব্যাধের বিশাক্ত বাণ থেকে নিজেকে বাঁচিয়েও শেষ পর্যন্ত কূপের মধ্যে পড়ে যায়; তেমনই ভাবে সেই ইঁদুরের দলও সেই বিলদুর্গের মধ্যে এসে প্রবেশ করল।

আসলে দৈব সহায় না হলে একা পুরুষকার কিছুই করতে পারে না। অনেক বোঝালেও আমার নিষেধ তারা শুনলো না। ফলে আমি অন্যত্র থাকলেও বাকি মূষিকের দল সকলেই সেই বিলদুর্গে উপস্থিত হল। তাই ফল যা হওয়ার তাই হল। পরদিন সকালে সেই দুষ্ট পরিব্রাজকটি বিড়ালের আক্রমণে আহত ইঁদুরদের রক্তের দাগ অনুসন্ধান করতে করতে আমাদের বিলদুর্গের হদিশ পেয়ে সেই স্বহস্তিকা দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। খুঁড়তে খুঁড়তে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই গুপ্তসম্পদের খবর পেল সে, যার উপর সেই বিলদুর্গে আমার থাকতাম। সেই সম্পদের উষ্ণতাতেই অসাধ্যসাধন করতাম আমরা। আমাদের সবকিছুর উত্স ছিল সেই সম্পদ। সেই অভ্যাগত অতিথি সেই সম্পদ পেয়ে অত্যন্ত হৃষ্ট হয়ে তাম্রচূড়কে তখন বলল, হে ভগবন্‌! এইবার তুমি নিঃশ্চিন্তে ঘুমাতে পারবে—এই সম্পদের গরমেই ইঁদুরটার এতো ক্ষমতা এসেছিল। সম্পদের এমনই শক্তি। এই সম্পদ এখন আমাদের দখলে ফলে সেই ইঁদুরের এখন আর কোনও ক্ষমতাই নেই।
আমি তখন মনের দুঃখে সেই রাতটা কোনও ক্রমে কাটালাম। ওই সম্পদটা চলে যাওয়ায় আমার আত্মপ্রত্যয়টুকুও যেন চলে গিয়েছিলো। এদিকে আহারের ব্যবস্থা তো কিছু একটা করতে হবে! পরদিন রাতে আবার যখন অবশিষ্ট পরিবার নিয়ে ভিক্ষাপাত্র থেকে খাদ্য অন্বেষণের জন্য সেই মঠে এসে উপস্থিত হলাম তখন আমাকে দেখেই সেই তাম্রচূড় আবার সেই ফাটা বাঁশটা দিয়ে আওয়াজ করে ভয় দেখাতে লাগলো। বৃহৎস্ফিঙ্‌ তখন তাকে থামিয়ে বলল, ওহে বন্ধু! এবার তো তুমি নিশ্চিন্তে একটু ঘুমাও। আর ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই— “সখে! মা ভৈষীঃ। বিত্তেন সহ গতোঽস্য কূর্দনোত্সাহঃ”। ওর টাকাপয়সার সঙ্গে ওর বেশি লাফানোর ক্ষমতাও গিয়েছে। সকল জন্তুরই এই একই অবস্থা হয়। সদা উত্সাহী হয়ে অন্যকে অপমান করা কিংবা দণ্ডের ভয় না পেয়ে যথেচ্ছাচার করা। এই সবকিছুই টাকার গরমেই হয়। যখনই দেখবে যে মানুষ নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কথা বলছে, বা অন্যকে অকারণে অপদস্থ করছে। বুঝবে যে সবই সে করছে অর্থের জোড় আছে বলেই। অর্থের জোড়েই সে ক্ষমতা পায়। তার সেই ক্ষমতার উত্স সড়িয়ে নাও, দেখবে তার লাফালাফিও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

অভিজ্ঞান-শকুন্তলের নাট্যকার কালিদাস/১

সেই অতিথির কথা শুনে আমার খুব রাগ হলো। কিন্তু কথাটি সে সত্যই বলেছিল। আমি শত চেষ্টা করেও আর সেই উঁচু নাগদন্তে রাখা ভিক্ষাপাত্র পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলাম না। যতবার লাফাবার চেষ্টা করলাম ততবার মাটিতে পড়ে গেলাম। আমার এই অবথা দেখে সেই সন্ন্যাসী বৃহৎস্ফিঙ্‌ তখন হেসে তাম্রচূড়কে বললো, এ বার শুধু তামাশা দেখো। ধনসম্পদ থাকলে সকলেই বলবান হয়। সকলেরই হম্বিতম্বি বেড়ে যা। এমন কি ধনসম্পদ থাকলে মূর্খও পণ্ডিত হয়ে যায়— “অর্থেন বলবান্‌ সর্বোঽপ্যর্থযুক্তঃ স পণ্ডিতঃ”। দেখো এখন ধনহীন হয়ে এই ইঁদুরটা কেমন তার জাতির অন্যান্যদের মতো হয়ে গিয়েছে। সে আর আলাদা কিছু নয়, অন্যান্য ইঁদুরের মতন সামান্য ইঁদুর একজন। সুতরাং এবার তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারো কারণ তার অতিরিক্ত লাফালাফির যেটা উত্স ছিল সেটা এখন আমাদের দুজনের হাতে। বলা ভালো—
দ্রংষ্ট্রাবিরহিতঃ সর্পো মদহীনো যথা গজঃ।
তথাঽর্থেন বিহীনোঽত্র পুরুষো নামধারকঃ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি, ৯০)
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৯: ভ্রমণে বেরিয়ে মহর্ষি পেয়েছিলেন পুত্রের মৃত্যু-সংবাদ

দশভুজা, দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৪: আনন্দী—এক লড়াইয়ের নাম

বিষদাঁত ছাড়া সাপ কিংবা মদবারিহীন প্রমত্ত হস্তির মতো টাকা-পয়সা বিহীন পুরুষ কেবল নামেই পুরুষ আসল ক্ষমতা তাদের থাকে না। সেই বৃহৎস্ফিঙ্‌-এর কথাটাই আসলে সত্যি। বেশ বুঝতে পারলাম যে আমার আর এক আঙুলও অতিরিক্ত লাফানোর ক্ষমতা নেই। আমার জীবন যে সেই অর্থহীন পুরুষের মতনই নিরর্থক সেটা বুঝতে আর দেরি হল না আমার। নিজের এই অবস্থার জন্য ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছিল তখন। ঠিক যেমন গ্রীষ্মে জলের অভাবে নদী শুকিয়ে যায় বেকার হয়ে যায়, তেমনই ধনহীন অল্পবুদ্ধি পুরুষেরও কোনও কাজই সফল হয় না, সব প্রচেষ্টাই তার বিফল হয়। দরিদ্র ব্যক্তির অনেক গুণ থাকলেও কেবল সম্পদের অভাবে তা প্রকাশিত হয় না।

সূর্য যেমন সকল ভূতবর্গকে প্রকাশিত করে তেমনই সম্পদ বা লক্ষ্মীশ্রীও সকলের গুণকে প্রকাশিত করে। সত্যি বলতে যে লোক শুরু থেকেই ধনহীন তার এতো কষ্ট হয় না, কিন্তু যে ব্যক্তি বিত্তশালী হয়ে পরে ধনহীন হয় তার মতন মানুষের দুঃখের আর শেষ নেই। পোকা-মাকড়ে খাওয়া, জ্বলে যাওয়া শুকনো গাছের জীবনও বরং ভালো এখন ভিক্ষুকের তুলনায়। প্রতাপহীন দারিদ্রকেও লোকে শঙ্কার দৃষ্টিতেই দেখে, কারণ কোনও ধনহীন ব্যক্তি নিজে থেকে যদি উপকার করতেও এগিয়ে আসে তাহলে তাকেও লোকে এড়িয়ে যায়। ভাবে হয়তো সে কিছু পাওয়ার আশায় করছে। সত্যি বলতে ধনহীন মানুষের মনের ইচ্ছে বিধবা স্ত্রীর স্তনের মতন, যা হৃদয়ে উঠে আবার মিলিয়ে যায়, বাস্তবে কাজে লাগে না। দারিদ্রতা একটা অন্ধকার। দিনের আলোতেও দরিদ্রলোককে লোকে দেখেও দেখে না।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৩৮: পুত্র বীরেন্দ্রর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানান মহারাজ রাধাকিশোর

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

এইভাবে সেদিন নানা রকম বিলাপ করে সেই গুপ্তধনটা সন্ন্যাসীদের মাথার বালিশের তলায় দেখে মনের দুঃখে যখন বিলদুর্গে ফিরে এলাম তখন শুনি আমার ভৃত্যরা সকলে আমাকে দেখে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতে শুরু করেছে যে আমি নাকি এখন এদের পেট ভরাতে অসমর্থ। শুধু তাই নয় আমাকে অনুসরণ করলে নাকি তারা সকলে বেড়ালের পেটেই যাবে, আমার এখন কোনও ক্ষমতাই নাকি নেই। পণ্ডিতেরা বলেন—
যৎ সকাশান্ন লাভঃ স্যাৎ কেবলাঃ স্যুর্বিপত্তযঃ।
স স্বামী দূরতস্ত্যাজ্যো বিশেষাদনুজীবিভিঃ।। (ঐ, ৯৯)


যে স্বামী বা নেতার আশ্রয়ে থাকলে কোনও লাভের লাভ নেই বরং উল্টে বিপদেরই সম্ভাবনা বেশি সেই রকম স্বামী বা নেতাকে দূর থেকেই পরিত্যাগ করা উচিত। আর তাকে যারা অনুগমন করেন তাদের তো আরও আগেই সরে যাওয়া প্রয়োজন। আমার ভৃত্যদের মুখে এইসব কথা শুনে খুবই বিষণ্ণ হয়ে নিজের দুর্গে প্রবেশ করলাম সেদিন। কেউ যখন আশেপাশে ছিল না একাকী চিত্কার করে বললাম, ‘ধিগিযং দরিদ্রতা’। এই দারিদ্রকে ধিক্কার। অথবা বলা ভালো নির্ধন পুরুষ আর মৃত পুরুষের মধ্যে কোনও তফাৎ নেই। দু’জনেই শক্তিহীন। ঠিক যেমন সন্তান উত্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে মৈথুন ক্রিয়া ব্যর্থ, শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ না এলে শ্রাদ্ধক্রিয়া ব্যর্থ এবং দক্ষিণা না দিলে যজ্ঞক্রিয়া ব্যর্থ হয়, ঠিক তেমনই ধনসম্পদ না থাকলে বেঁচে থাকাটাই দায় হয়। ধনসম্পদহীন দরিদ্রের জীবন ব্যর্থ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮৯: মাথার কান

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭১: মা সারদার নলিনীর মানভঞ্জন

আমাকে এইরকম নির্বল দেখে দিনে দিনে আমার ভৃত্যরা সকলে আমার শত্রুর অনুগত হতে লাগলো আর সুযোগ পেলেই আমাকে নানাভাবে বিড়ম্বনা করতো। একদিন ঘুমের মধ্যে এক বিচিত্র চিন্তা মাথায় এলো। স্থির করলাম ওই দুষ্ট তপস্বী দু’জন যখন ঘুমাবে তখন তাদের মাথার বালিশের নিচে রাখা সেই ধনের পেটিকাটা ধীরে ধীরে কেটে তার মধ্যে সঞ্চিত ধনসম্পদ সব আমার চুরি করে এনে আমার বিলের মধ্যে রাখবো। ফলে সেই সঞ্চিত ধনের প্রভাবেই আবার আমার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারব। সত্যি বলতে প্রতিষ্ঠিত বংশের বিধবা স্ত্রীর মতো নির্ধন

ব্যক্তিও মনের মধ্যে হাজারটা ইচ্ছা সবসময় পুষে রাখলেও ইচ্ছানুসারের কিছুই করতে পারে না। যেকোনও প্রাণীর কাছে দারিদ্রের মতো দুঃখদায়িনী এবং অপমানজনক আর দ্বিতীয় কিছু নেই। নির্ধন হলে তার নিজস্ব আত্মীয় পরিজনও সেই ব্যক্তিকে মৃত বলেই মনে করেন। দারিদ্র কলঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। দারিদ্রদোষে কলুষিত পুরুষ দীনতার পাত্র, পরাজয়ের স্থান, বিপদের ঘর। যার কাছে ধনসম্পদ থাকে না তার বন্ধু-বান্ধবও তার সঙ্গে সম্বন্ধ বজায় রাখতে লজ্জাবোধ করে। এমনকি সেই নির্ধন ব্যক্তির মিত্রও তার শত্রুতে পরিণত হয়। প্রাণীর দারিদ্রতা তার কাছে মূর্তিমতী তুচ্ছতা ছাড়া আর কিছুই নয়। তার কাছে তখন ‘বিপদ’ আর ‘মৃত্যু’। এই শব্দ দুটো যেন সমান সমান অর্থে প্রতিভাত হয়। —চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content