বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

 

মিত্রসম্প্ৰাপ্তি

প্রাচীন ভারতে চিরকাল মঠমন্দির প্রতিষ্ঠার বিষয়ে ধর্মশাস্ত্রগুলিতে যেমন প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়, তেমন ভাবেই অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায়, যাঁরা এই সব বাহুল্য ত্যাগকেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভের একমাত্র পথ বলে মনে করেন, তাঁদের দর্শনে এইসব আড়ম্বরপূর্ণ ধর্মচর্চার বিষয়ে নিন্দাও দেখতে পাওয়া যায়। তাম্রচূড়ের অতিথি পিছন ভারি বৃহৎস্ফিঙ্‌ তাই রীতিমতো ক্রুদ্ধ হয়েই তাম্রচূড়কে বলল, ওরে মূর্খ! মঠের দ্বায়িত্ব পেয়ে তুমি এখন মঠাধিপতি হয়েছ। তাই গর্বে তোমার এখন বেশ ছাতি চওড়া হয়েছে বুঝতেই পারছি। অভিমানী লোকের অবস্থা যে কেমন শোচনীয় হতে পারে তা তোমাকে দেখলেই বোঝা যায়। তাই আমি এখনই এই মঠ ছেড়ে চললাম।

অভ্যাগত অতিথির মুখে এই রকম কথা শুনে তাম্রচূড় ভয়ভীত হয়ে বললে, হে ভগবন্‌! এমন কথা বলবেন না। ‘ন তত্সমোঽন্য মম সুহৃৎ কশ্চিদস্তি’। আপনার মতো দ্বিতীয় কোনও বন্ধু আমার নেই। আমি যে আপনার সঙ্গে কথাবার্তার সময়ে মাঝে মধ্যে অমনোযোগী হয়ে পড়ছিলাম তার কারণটা আগে দয়া করে শুনুন।

কিছুক্ষণ থেমে সে আমাকে [হিরণ্যককে] দেখিয়ে বলল, ওই যে দুষ্ট ইঁদুরটাকে দেখছেন তার কাণ্ডটা একবার খেয়াল করুন! ওই রকম উঁচুতে আমার ভিক্ষাপাত্রটি রাখা; সেখানেও সে লাফিয়ে উঠে কেমন করে আমার সঞ্চিত অবশিষ্ট শস্য সে খেয়ে যাচ্ছে দেখুন। ওই অবশিষ্ট শস্যদানার বিনিময়েই আমি লোক লাগিয়ে এই মঠ পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রাখি। তারা ওই ভিক্ষাবশিষ্ট শস্যদানার বিনিময়েই এই মঠে ঝাড়ু-পোঁছার কাজ করে। তাই ওই ইঁদুরটাকে ভয় দেখানোর জন্যই এই ফাটা বাঁশটা দিয়ে মাঝে মাঝে মাটিতে আঘাত করে ওই রকম শব্দ করি। আপনি ভুল বুঝবেন না। আপনাকে উপেক্ষা করার আমার কোনও উদ্দেশ্য নেই। শুধু এই কারণেই আমি মাঝে মধ্যে অমনোযোগী হয়ে পড়ছি। আপনি নিজেই একবার দেখুন না! এই ইঁদুরের লাফটা বেড়াল বা বাঁদরকেও হার মানাবে।
বৃহৎস্ফিঙ্‌ তখন জিজ্ঞাসা করঅ, তুমি কি জানো এর গর্তটা কোথায়?
তাম্রচূড় বলল, না ভগবন্‌! ঠিক জানি না।
বৃহৎস্ফিঙ্‌ বলল, নিশ্চয় কোনও ধনসম্পত্তির খাজানার উপর গর্তটা। টাকার গরমেই তো এতো লাফাচ্ছে। কথায় আছে —
উষ্মাপি বিত্তজো বৃদ্ধিং নযতি দেহিনাম্‌।
কিং পুনস্তস্য সম্ভোগস্ত্যাগকর্মসমন্বিতঃ।। (মিত্রসম্প্রাপ্তি ৭০)
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬২: মঠ-মন্দির তৈরি করার চিন্তা বেশি করলে প্রকৃত ধর্মচর্চা থেকে মানুষ দূরে চলে যায়

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-৩: ভাবিয়া করিও কাজ

অর্থাৎ ধনসম্পদ শরীর গরম করে; সেই ধনের উষ্ণতায় মানুষের তেজও বৃদ্ধি পায়। হম্বি-তম্বিও বারে আর তার উপর সেই ধনসম্পত্তি যদি কেউ দান বা ভোগ করে তাহলে তার তো চাল-চলনই বদলে যায়। যেকোনো মানুষ যদি তার ক্ষমতার অতিরিক্ত লাফালাফি করে তাহলেই বুঝতে হবে তার পিছনে কোনও না কোনও কারণ অবশ্যই আছে। অকারণে মানুষ অস্বাভাবিক আচরণ করে না, বুঝতে হবে কোনও না কোনও কারণ বা কোনও না কোনো অদৃশ্য ক্ষমতা থাকে তার শক্তির পিছনে। সেই যে সেই ব্রাহ্মণী যে পরিষ্কার খোসাছাড়া তিলের বদলে খোসা সহিত তিল নিচ্ছিল সেটার পিছনেও কোনো না কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে সেটা বুঝতে হবে।
তাম্রচূড় জিজ্ঞাসা করলো, ‘কথমেতৎ?’ —ব্যাপারটা ঠিক কী রকম?
বৃহৎস্ফিঙ্‌ তখন বলতে শুরু করল—
 

০২: খোসা ছাড়ানো তিল বিক্রয়কারী ব্রাহ্মণীর কাহিনি

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৬: সুযোগ্য প্রশাসকের মৃত্যুর অভিঘাত

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৯: শ্রীমার সন্তানস্নেহ

একবার বর্ষার সময়ে চাতুর্মাস্য ব্রত পালনের জন্য কোনও এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে আশ্রয় প্রার্থী হয়েছিলাম। আমার কথায় সেই দরিদ্র ব্রাহ্মণ আমাকে অতিথিরূপে তাঁর গৃহে আশ্রয় দেন। তাঁর সেবাশুশ্রূষায় দেবার্চনা করে আমার দিন বেশ ভালোই কাটছিল।

একদিন খুব সকালে ঘুম ভেঙে শুনি সেই ব্রাহ্মণ আর ব্রাহ্মণী নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। আমি কিছুটা কান পাতলাম বলতে পারো। শুনলাম সেই ব্রাহ্মণ তাঁর স্ত্রীকে বলছে, ওহে ব্রাহ্মণী! আজ তো দক্ষিণায়ন সংক্রান্তি। অর্থাৎ মকরসংক্রান্তি। এই তিথিতে দান করলে অক্ষয় পুণ্য হয়। অনেক লোকেই আজকের দিনে ব্রাহ্মণকে দান-ধ্যান করে পুণ্য সঞ্চয় করতে চাইবে। তাই সকাল সকাল দান গ্রহণ করতে অন্য গ্রামে যাব। তুমি সূর্যদেবের উদ্দেশ্যে কোনও এক ব্রাহ্মণকে অবশ্যই কিছু না কিছু ভোজন দেবে আজকে।

এই শুনে ব্রাহ্মণী বেশ ঝাঁঝিয়ে ভর্ত্সনা করে বললে, দারিদ্র ভরা তোমার এই ঘরে ভোজন ব্যবস্থা কোথা থেকে হবে? তোমার বলতে লজ্জা করলো না? তোমার হাতে পরে আমার জীবন থেকে সুখ বলে বস্তুটিই তো উধাও হয়ে গিয়েছে। সুমিষ্ট ভোজন আস্বাদন করা কিংবা হাত-পায়ের গয়না কিছুই আমার জোটেনি।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭১: সুন্দরবনের পাখি: সবুজ বক

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

স্ত্রীর মুখে এইসব শুনে একটু ঘাবড়ে গিয়ে সেই ব্রাহ্মণ ধীরে ধীরে তাকে বলল, ওহে ব্রাহ্মণী! এই রকম কথা বলাটা উচিত নয়। পণ্ডিতেরা বলেন— নিজের ক্ষমতা অনুসারে যাঁর প্রয়োজন, তাঁকে কিছুটা হলেও দেওয়া উচিত। নিজের যদি একগ্রাস খাবার জোটে যাচককে তার এক কণাটুকু হলেও দেওয়া উচিত। নিজের মনের মতন ধনসম্পত্তি তো কারও কপালেই জোটে না। আমি শুনেছি যে বিত্তশালী লোকেরা অতি দান করলে যে ফল লাভ করে সেই একই ফল দরিদ্র ব্যক্তিরা এককণা মাত্র দান করেই লাভ করে। তাই শাস্ত্রে বলেছে—
দাতা লঘুরপি সেব্যো ভবতি ন কৃপণো মহানপি সমৃদ্ধ্যা।
কূপোঽন্তঃস্বাদুজলঃ প্রীত্যৈ লোকস্য ন সমুদ্রঃ।। (ঐ, ৭৪)

অর্থাৎ ধনহীন হলেও সে যদি দানী ব্যক্তি হয় মানুষ তাঁকে সম্মান করে। উল্টো দিকে কোনও ব্যক্তি অত্যন্ত বৈভবশালী হয়েও সে যদি দান না করে লোকে সেই কৃপণ ব্যক্তিকে মর্যাদা দেয় না। ঠিক যেমন মিষ্টি জলপূর্ণ কুঁয়ো আকারে ছোট হলেও লোকের প্রিয়, কারণ সে জলদান করে; কিন্তু সমুদ্র আকারে বৃহৎ হলেও লবণাক্ত জলের কারণে মানুষের প্রিয় নয়। দান না করলে রাজার রাজা কুবের হয়েও কোনও লাভ নেই। সে সকল ধনসম্পদের রক্ষাকর্তা হলেও কুবের কিন্তু মহাদেব নন। জলপূর্ণ ঘট সুগঠিত সুন্দর হলেও জলের ভিতরে ডুবে যায় যদি না সে জল দান করে। ঠিক তেমনই মানুষও সদাচারী আর সুশীল হলেও সে যদি দানী না হয় তাহলে সে অধোগতি প্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে কুরূপ-কদাচারী ব্যক্তিও যদি দানী হয় তাহলে সে উচ্চগতি প্রাপ্তি হয়।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪২: যোগমায়া দেবী—এক প্রতিবাদী নারী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

পাঠকদের বলব, পঞ্চতন্ত্রকারের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাটা একবার লক্ষ্য করুন। তত্ত্বগতভাবে দানের মাহাত্ম্য বলে শেষে আসল কথাটি বলে দিলেন যে কুরূপ এবং কদাচারী ব্যক্তিও যদি দানশীল হয় তবে সে উচ্চগতি লাভ করে। মানেটা বুঝতে আশাকরি অসুবিধা হচ্ছে না। কদাচারী একজন ব্যক্তি, সে চোর-ডাকাত যাই হোক, সে যদি লাভের ভাগ দানরূপেও মানুষকে কিছু কিছু দেয় তাহলেই সে ভগবান হয়ে যায়। দানের এমনই মাহাত্ম্য। এমনকি স্বর্গ্যফল লাভও তাঁর পক্ষে সম্ভব। ঠিক যেমন অতিবৃষ্টিতে বন্যা হয়ে গেলেও লোকে মেঘকেই চায় কারণ সে জলদান করে বলে, কিন্তু মিত্র-সূর্য সবসময় দুই হাত প্রসারিত করে কিরণ বিস্তার করলেও লোকে কিন্তু মেঘকেই চায়, সূর্যকে নয়। কারণ সে শুধু নেয়, কিন্তু মেঘ দেয়।

এই জন্য দারিদ্রতা থাকলেও মানুষের সব সময় যোগ্য পাত্রকে সাধ্যমতন কিছু না কিছু অবশ্যই দেওয়া উচিত। শাস্ত্রেও বলেছে, দেশ-কাল অনুসারে নিজ নিজ ক্ষমতা অনুসারে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে বিবেকী পুরুষ যা কিছু দান করে সে সবই অক্ষয় ফলদান করে। সুতরাং দান করতে গেলে সব সময় যে বিশাল সম্পত্তির অধিপতি হতে হয় এমনটা কিছু নয়। সত্যি বলতে অতি লোভ করাটাও ঠিক নয় বরং লোভ পরিত্যাগ করাটাই উচিত না হলে সেই শেয়ালটার মতন অবস্থা হবে। মাথার সামনে ধনুকের দাগটা একেবারে শিখার মতন দেখতে লাগবে।
ব্রাহ্মণী বলল, ‘কথমেতৎ?’ —সেটা আবার কেমন?
ব্রাহ্মণ তখন বলতে শুরু করল। —চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

Skip to content