শনিবার ১০ মে, ২০২৫


 

কাকোলূকীযম্‌

মানুষ জটিল প্রাণী। মনস্তাত্ত্বিকেরা বলেন, আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে বন্ধুসুলভ একজন মানুষ হতে পারেন, তবুও কিছু মানুষ থাকবেনই, যাই হোক না কেন, তারা আপনাকে অপছন্দ করবেন। হতেও পারে আপনাকে অপছন্দ করবার তাদের হয়তো যথেষ্ট কারণও পারে, আবার সব ক্ষেত্রে যে কারণ লাগে তাও নায়। তাই এটা স্বাভাবিক এই জগতে প্রত্যেক মানুষেরই শত্রু আছে। অজাতশত্রু এইটা একটা ধারণা মাত্র। বাস্তবে তা হয় না। তাই এই জগতে চলতে গেলে বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে কীভাবে ফাটল তৈরি হয় বা তৈরি করা যায় এবং কীভাবে নতুন নতুন বন্ধু সংগ্রহ করতে হয় বা সেই বন্ধুত্বের সম্পর্ককে কিভাবে বজায় রাখতে হয়। এইসব নিয়ে আলোচনা করার পর, বিষ্ণুশর্মা এখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির বিষয়কে অবলম্বণ করে গল্পের জাল বুনতে শুরু করলেন।

পঞ্চতন্ত্রের তৃতীয়তন্ত্র বিষ্ণুশর্মা রচনা করলেন কাক আর উলূক মানে পেঁচাদের মধ্যে বিরোধ নিয়ে। ভাষাতত্ত্ববিদ্‌রা উলূক শব্দটির ইংরেজি ‘Owl’ শব্দের সঙ্গের সাদৃশ্য দেখিয়েছেন। কাক আর উলূকদের কাহিনি আছে বলেই এই তৃতীয় তন্ত্রের নাম দিলেন পঞ্চতন্ত্রকার “কাকোলূকীযম্‌”। কাক আর উলূকের মধ্যে শত্রুতাই হলো এই তন্ত্রের মূল বিষয় এবং এটি ভারতীয় লোকাচার, উপকথা ও রূপকের একটি দীর্ঘ ঐতিহ্যের অংশ।

তবে এই শত্রুতার পেছনে প্রকৃত কোনও স্বভাবগত কারণ আছে কি না, তা নিয়ে যদিও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ বাস্তবে কাক ও প্যাঁচার মধ্যে এমন কোনও মারাত্মক দ্বন্দ্ব দেখা যায় না। প্যাঁচা দিনে অন্ধ আর কাক রাতে দেখে না—এই বৈপরীত্যটাই হয়তো রূপকের বীজ। এই শত্রুতার রূপকটি মহাভারতের সৌপ্তিকপর্বের মধ্যে সম্ভবতঃ প্রথম আমরা দেখতে পাই। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের শেষে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা একটি বিশাল বটগাছে নিশ্চিন্তে বসবাসকারী অনেক কাকদেরকে রাত্রির অন্ধকারে এক প্যাঁচার হাতে মরতে দেখে রাতের আঁধারেই পাণ্ডব শিবিরে হামলা চালান। সেখানে অশ্বত্থামার দুরভিসন্ধিকে সুস্পষ্টরূপে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাভারতকার বলেছেন—
ন্যাযতো যুদ্ধমানস্য প্রাণত্যাগো ন সংশযঃ।
ছদ্মনা তু ভবেত্‍ সিদ্ধিঃ শত্রূণাঞ্চ ক্ষযো ভবেত্‍।। (সৌপ্তিকপর্ব, ৩/৪৮)
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৫: মিত্রপ্রাপ্তির সম্ভাবনা দেখা দিলে সযত্নে তার সদ্ব্যবহার করতে হয়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৩: মা সারদার সঙ্গে সরলাদেবীর কাশীভ্রমণ

অর্থাৎ পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে ন্যায়সঙ্গতভাবে যুদ্ধ করলে প্রাণত্যাগ যে নিশ্চিত এটা নিয়ে অশ্বত্থামার মধ্যে কোনও সংশয় নেই। বরং এই পেঁচারা যেমন রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে কাকেদের হত্যা করলো ঠিক তেমন ভাবে ছলনার মাধ্যমে যুদ্ধ করলেই আমাদের সিদ্ধি হবে এবং শত্রুরাও পরাজিত হবে। এরই ফল হলো রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র এবং ধৃষ্টদুম্নের মৃত্যু।

এই ঘটনাটিই পরে পঞ্চতন্ত্রের কাকোলূকীযম্‌ অংশের মূল কাহিনির উত্স হয়েছে বলে মনে হয়। আমাদের বক্তব্য হল, এই কাক ও প্যাঁচার মধ্যে শত্রুতাটার ধারণাটি যে পঞ্চতন্ত্রেরই প্রথম কথিত হয়েছে, তা নয়। বরং এর পূর্বেও নানা রূপক ও আপ্তবাক্যে এই দ্বন্দ্ব ব্যবহৃত হয়েছে এবং পঞ্চতন্ত্রের মধ্যে তা সংগৃহীত হয়েছে মাত্র।

চিরাচরিত পদ্ধতিতে শিশু রাজপুত্রদের আকর্ষিত করতে তন্ত্রের শুরুতেই একটি সূচনা শ্লোকের অবতারণা করেন পঞ্চতন্ত্রকার—
ন বিশ্বসেত্‍ পূর্ববিরোধিতস্য শত্রোশ্চ মিত্রত্বমাগতস্য।
দগ্ধা গুহাং পশ্য উলূকপূর্ণাং কাকপ্রণীতেন হুতাশনেন।। (কাকোলূকীযম্‌, ০১)


এই তন্ত্রের মূল বক্তব্য এবং উদ্দেশ্যটি কিন্তু এই শ্লোকের মধ্যেই আছে। এই তন্ত্রের মাধ্যমে পঞ্চতন্ত্রকার তাঁর রাজনীতির পাঠ নিতে আসা শিশুরাজপুত্রদের শেখাতে চলেছেন যে, এমন কাউকে কখনই বিশ্বাস করা উচিত নয় যে আগে শত্রু ছিল, কিন্তু এখন হঠাৎ বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই গুহাটির দিকে তাকিয়ে শিক্ষা নিতে হবে, যেটি একসময় সমস্ত পেঁচাদের আবাসস্থল ছিল, কিন্তু এখন তা সবটাই কাকেদের লাগানো আগুনে পুড়ে গিয়েছে।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯৬: পরাগপাখি

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১১: বিপদ যখন আসে

স্বাভাবিকভাবেই পাঠকদের মনে এখন যেমন গোটা ঘটনাটা শোনবার আগ্রহ জাগে তেমনই ভাবে শিশু রাজপুত্ররাও নিশ্চয় সেদিন নড়েচড়ে বসেছিলো। বিষ্ণুশর্মা বলতে শুরু করলেন—দাক্ষিণাত্য দেশে মহিলারোপ্য নামে এক নগর ছিল। সেই নগরের উপকণ্ঠেই জঙ্গলের মধ্যে একটি বিশাল বট গাছ ছিল; ঘন পাতায় ঢাকা শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত ছিল সে বৃক্ষ ছিল বিশাল। সেখানে কাকেদের রাজা মেঘবর্ণ, কালো মেঘের মতোই ছিল যার গায়ের রং, অনেক কাকপরিবারে সঙ্গে সেখানে বাস করতেন। সেই গাছেই এক বিশাল দুর্গ নির্মাণ করে সপরিবারে তার প্রজাদের সঙ্গে বসবাস করতেন তিনি এবং আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাতেন।

কাকেদের সেই বৃক্ষদুর্গের কিছু দূরেই পর্বতের গুহার মধ্যে একটি গিরিদুর্গ বানিয়ে, পেঁচাদের রাজা অরিমর্দন, যিনি শত্রুদের অনায়াসে পরাজিত করতে পারেন, তিনি বাস করতেন। সমগ্র উলূক পরিবার নিয়ে তারা পাহাড়ের ভিতরে একটি নিরাপদ গুহায় দুর্গের ভিতরে বাস করতেন।
আরও পড়ুন:

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-৫৬: সিলেটে দেখা মণিপুরী নাচ কবির নৃত্য ভাবনাকে উস্কে দিয়েছিল

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৪: গ্রীষ্মকালে আলাস্কা সত্যিই অচেনা এক দেশ

রাত নামলেই, উলূকরাজ অরিমর্দন সেই কাকেদের বৃক্ষদুর্গের বাইরে উড়ে বেড়াতো। কাকেদের সঙ্গে পূর্বশত্রুতাবশতঃ যখনই সে কোনও একটি কাককে তাদের দুর্গের বাইরে একা পেতো, নিমেষে তাকে হত্যা করে ফেলতো আর তারপরেই মুহূর্তে সে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতো। এটি প্রায় প্রতি রাতেই ঘটতো এবং কয়েক মাসের মধ্যে, সেই বটবৃক্ষে বসবাসকারী কাকের সংখ্যা ক্রমশ কমে যেতে শুরু করে। পঞ্চতন্ত্রকার বলেন এতে যদিও অবাক হওয়ার মতন কিছুই নেই। কারণ, যে ব্যক্তি কেবল আলস্যের কারণে নিজের শত্রু বা রোগকে উপেক্ষা করে, যখন সেগুলি সেই ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন সেই শত্রু এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত রোগই তাকে ধীরে ধীরে নিহত বা পরাজিত করে।

এবং এছাড়াও…।

যে ব্যক্তি শুরুতেই শত্রু বা কোন রোগকে সমূলে বিনষ্ট করে, সেই রোগ যতই কঠিন হোক বা সে শত্রু যতই মহাবল হোক না কেন, সেই ব্যক্তির কোনও ক্ষতি করতে পারে না।

বৃক্ষদুর্গের অধিবাসী তার প্রজাদের দিনের পর দিন পেঁচাদের হাতে এইভাবে নির্বিচারে হত্যা হতে দেখে বায়সরাজ মেঘবর্ণ খুবই উদ্বিগ্ন হলেন এবং কিভাবে এর প্রতিকারের হতে পারে তার জন্য সে তার মন্ত্রী পরিষদের একটি জরুরি সভা ডাকলেন। আচার্য কৌটিল্যও বলেন, “মন্ত্রপূর্বাঃ সর্বারম্ভাঃ”। যে কোনও ব্যাপারেই রাজার কর্তব্য হল তার মন্ত্রীদের সঙ্গে যথাযথ মন্ত্রণা করে তবেই একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১০৯: আধুনিক যুগে দাবানলের ফলে বনদহনের সঙ্গে খাণ্ডব বনদহনের সাদৃশ্য আছে কী?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৯: সে এক স্বপ্নের ‘চাওয়া পাওয়া’

রাজসভার সকল সচীবদের ডেকে বায়সরাজ মেঘবর্ণ বললেন, আমাদের শত্রু খুবই শক্তিশালী এবং ধূর্ত। রাতের অন্ধকারে, যখন আমরা চোখে দেখতে পাই না, সে তখন আমাদের উপর চতুরতার সাথে আক্রমণ করে। আমরা এতোটাই হতভাগ্য যে তাদের দুর্গ কোথায় সেই সংবাদও আমাদের কাছে অজানা, ফলে দিনের বেলায় সেখানে গিয়ে যে পাল্টা আক্রমণ চালাবো, সেটাও সম্ভব নয়। আমি জানিনা কিভাবে তাদের সঙ্গে আমরা এই অসম লড়াই চালাবো! তাই রোজকারের এই সমস্যার আমাদের এখনই একটা দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। কৌটিল্যের মতন অর্থশাস্ত্রকারেরা এবং মনুর মতো স্মৃতিকারেরাও সকলেই এই ধরনের সমস্যা মোকাবেলার ছ’টি নীতির কথা— সন্ধি (বলবান শত্রুর সঙ্গে শান্তি চুক্তি), বিগ্রহ (দুর্বল শত্রুর প্রতি শত্রুতা), যান (দুর্বল শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া), আসন (সমান শক্তি সম্পন্ন শত্রুর সম্পর্কে উদাসীনতা এবং নিরপেক্ষতা বজায় রাখা), সংশ্রয় (শক্তিশালী শত্রুর সঙ্গে মোকাবিলা করবার জন্য বলবান রাজার সঙ্গে জোট গঠন) এবং দ্বৈধীভাব (শত্রুর সঙ্গে দ্বৈত আচরণ বা বন্ধুত্বপূর্ণ হওয়ার ভান করা, কিন্তু শক্তিশালী হলে যথা সময়ে পাল্টা আক্রমণ হানা)। তাই দয়া করে এখন আপনারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে রাজসভায় যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি প্রদান করুন; আর এই অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির মোকাবেলা আমরা কিভাবে করতে পারি সে বিষয়ে নিজের অভিমত দিন।”—চলবে।
* পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি (Panchatantra politics diplomacy): ড. অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায় (Anindya Bandyopadhyay) সংস্কৃতের অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’ -এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন। বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন। ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না। গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে। ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content