রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


নলিনী দাশ।

সে এক সময়। নারীবাহিনী দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলেছে। সাহিত্যে নারীরাও পিছিয়ে নেই। পুরুষ গোয়েন্দা চরিত্রদের পাশাপাশি বেশ সন্তর্পণে বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে মুখ আর মন নিয়ে হাজির হলেন মহিলা গোয়েন্দা চরিত্ররা। বাংলা সাহিত্যে প্রথম গোয়েন্দা চরিত্র হল কৃষ্ণা।

প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কলমে হাজির হল এগারোটি কৃষ্ণা সিরিজের উপন্যাস। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের বিন্দিপিসি কাঁথা বোনেন এবং এই কাঁথা বুনতে বুনতেই হত্যাকাণ্ডের সমাধান করেন। তারপর কালের গর্ভ থেকে জেগে ওঠেন মিতিন মাসি, দময়ন্তী, গার্গীরা। কিন্তু গোয়েন্দা বললেই ব্যোমকেশ, ফেলু মিত্তিররা ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসেন। গল্প জমে ওঠে। মহিলা গোয়েন্দারা প্রচারের অন্তরালেই রয়ে যান। অথচ সমাজে অপরাধপ্রবণ গল্প চলতেই থাকে। সেই ঋকবেদের গরুচুরির গল্প থেকে শুরু করে আজকের থ্রিলার পর্যন্ত পুরুষ গোয়েন্দার ব্যাপারই আলাদা। কিন্তু ঘর সংসারের কাজ করতে করতে, রান্নাঘরের কোণ থেকে উঁকি দেয় মহিলা গোয়েন্দাবাহিনী। বিদেশেও মহিলা গোয়েন্দারা উল বুনতে বুনতে সমাধান করে দেন।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে গোয়েন্দা গল্পকে বটতলার গল্প হিসেবে ধরা হত। সাহিত্যসমাজে এই সব সাহিত্যের খুব কদর ছিল না। ঠাকুরবাড়ির স্বর্ণকুমারী দেবী ‘ভারতী’ পত্রিকায় গোয়েন্দা গল্প লিখতে লেখকদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। যদিও মূলত পুরুষ লেখকরাই রহস্য লেখা লিখতে শুরু করেছিলেন, তবু মহিলা লেখকদের সংখ্যাও কিছু কম ছিল না। প্রতিভা বসু, আশালতা সিংহ, শৈলবালা ঘোষজায়া, পান্না বেগম হয়ে নলিনী দাশ লিখে চলেছিলেন গোয়েন্দা গল্প।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২৯: পুণ্যলতা চক্রবর্তী— রায়বাড়ির সরস্বতী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭০: পিতার সমালোচক রাম শুধুই মানুষ, তবু তিনি কেন পুরুষোত্তম?

এখন গোয়েন্দা গল্পের গোয়েন্দা চরিত্র নারীপ্রধান হওয়া শুরু হওয়াটাও গল্পের গল্প। ষাটের দশকে ছোটদের সন্দেশ পত্রিকায় হাজির হল গোয়েন্দা গণ্ডালু। এখানে একজন নয়, একঝাঁক কিশোরী গোয়েন্দা। প্রত্যেকের নামের শেষে মজা করে ‘লু’ লেখা। কাকলি চক্রবর্তী, মালবিকা মজুমদার, বুলবুলি সেন— কালু, মালু, বুলু! সকলেই বালিকা বিথহদ্যালয়ের হোস্টেলে থাকে। সংকেতে কথা বলে, গুপ্তধনের সন্ধান করে,হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে আনে। সবমিলিয়ে দুর্দান্ত এক সিরিজ।
আরও পড়ুন:

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

নলিনী দাশের মা ছিলেন পুন্যলতা চক্রবর্তী, উপেন্দ্রকিশোরের মেয়ে। রায়বাড়ির বুদ্ধির দীপ্তি আর বিদ্যাচর্চা নলিনীর মধ্যেও ছিল। ১৯১৬ সালের ৫ আগস্ট তাঁর জন্ম হয়। বাবার নাম অরুণকুমার চক্রবর্তী। নলিনী দাশ একসময় সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন তিনি। জীবনানন্দ দাশের ছোট ভাই অশোকানন্দ দাশের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। নলিনী দাশের মামার বাড়ি ভর্তি লেখক। উপেন্দ্রকিশোর, সুখলতা রাও, সুকুমার রায়, পুন্যলতা চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায় নলিনী দাশ সকলেই লেখক।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-২: যতই দেখি তারে, ততই দহি…

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৫: প্রথম ভারতীয় সিভিলিয়ান সত্যেন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন পরীক্ষায় পাশই করবেন না

১৯৩২ সালে নলিনী দাশ ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয় থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে ডায়োশেসন থেকে আইএ এবং স্কটিশ চার্চ থেকে ফিলোজফি অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেন। ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশনের শিক্ষিকা ও পরে বেথুন কলেজ, ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ ইত্যাদি জায়গায় অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তাঁর কর্মজীবন ছিল। এছাড়াও তিনি সমাজসেবামূলক কাজও করেছিলেন অনেক। তাঁর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে রামকানাই যেন টের না পায়, হাস্য ও রহস্যের গল্প,বঙ্গমগড়ের রহস্য, মধ্যরাতের ঘোড়সওয়ার এবং গোয়েন্দা গন্ডালু উল্লেখযোগ্য। শিশু কিশোর মনস্তত্ত্ব তাঁর লেখায় বেশ ভালোভাবে প্রকাশিত হয়েছে। তার একটি কারণ রায় বাড়ির আজীবন রয়ে যাওয়া শিশুমন। অন্য কারণ নলিনী দাশের আজীবন শিক্ষকতা ও কিশোর ও তরুণদের সঙ্গে কাজকর্ম করে যাওয়া।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্থনারী মা সারদা

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১: ভাঙনের জয়গান গাও

গন্ডালু গোয়েন্দার দল নিঃসন্দেহে নলিনী দাশের নারীবাদী ভাবনার প্রকাশ। তিনি একজন কর্মযোগী ছিলেন। সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনার কাজেও নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছিলেন। কাজের মানুষদের কাজ কীভাবে এগিয়ে চলে তাঁরাই জানেন। নলিনী দাশ আজন্ম সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর কাছে কর্মই ধর্ম ছিল। বিদেশে থাকাকালীন গোয়েন্দা গল্প পড়ে সময় কাটাতেন। এনিড ব্লাইটনের ফেমাস ফাইভের প্রভাব পড়েছিল তাঁর লেখায়। আসলে নতুন কিছু করতে পারা সে যুগের মেয়েদের পক্ষে বড় ব্যাপার ছিল।
নলিনী দাশ অবশ্য সেই অবরুদ্ধ সময় থেকে অনেক ধাপ এগিয়ে ছিলেন সময়ের হিসেবে। মা পুন্যলতা রাওয়ের প্রভাব তাঁর জীবনে ছিল অসীম। তাছাড়া একঝাঁক কিশেোরী গোয়েন্দা বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে রইলেন। এই কৃতিত্বটি তাঁর সবচেয়ে ভড় বলে আমাদের মত। রায় বাড়ি ও দাশ বাড়ি এই দুই সাহিত্যিক পরিবারের আদর্শ সন্তান ছিলেন গন্ডালু গোয়েন্দা দলের স্রষ্টা। এইসব কথা গল্প হলেও সত্যি।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content