সোমবার ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

রাম অরণ্যবাসে প্রস্থান করেছেন। সারথি সুমন্ত্র, তাঁদের বিদায় জানিয়ে ঘোড়াদের বিপরীতমুখে চালিত করলেন। অবোধ প্রাণীদের চোখেও অশ্রুজল। কোনও মতে বিচ্ছেদবেদনা মনে অবদমিত রেখে শৃঙ্গবেরপুরে নিষাদরাজ গুহের আশ্রয়ে, সুমন্ত্র রামের আবারও আহ্বানের অপেক্ষায়, দীর্ঘ দিন বসবাস করলেন। ক্রমে তাঁর অপেক্ষা, নৈরাশ্যে পরিণত হল। অবশেষে আর অপেক্ষা নয়।

অবশেষে তাঁর প্রত্যাবর্তনের সিদ্ধান্ত। অযোধ্যার রাজ্যসীমায় পৌঁছে দেখলেন, গাছগুলি অঙ্কুরিত ফুল, পাতা, কুঁড়ি-সহ শুকিয়ে যেন রামের বিচ্ছেদে চরম বিপন্ন অবস্থায় ম্লানরূপ ধারণ করেছে। নদী, জলাশয়, সরোবরের জল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। বন, উপবন শুকনো পাতায় ছেয়ে আছে। কোনও প্রাণী বা হিংস্র শ্বাপদের চলাচলবিহীন বনভূমি।

রামের শোকে মুহ্যমান অরণ্য নীরব, নিস্তেজ। নদীর জলে ভাসমান পদ্মপাতা আর নেই, জল আবিল। পদ্মকুঁড়ি শুকিয়ে আছে জলে। পাখি ও মাছও যেন ম্লান, বিষণ্ণ। সুগন্ধ হারিয়েছে স্থলজ ও জলজ ফুলগুলি। ফল আর সরস নেই। তারা শোভাহীন। শূন্য উদ্যানগুলিতে পাখিরা লীন হয়ে রয়েছে। উদ্যানগুলি চিরন্তন সৌন্দর্য্য হারিয়ে হতশ্রী। সুমন্ত্র অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের পথে এসব কিছুই দেখেছেন। তিনি, রাজা দশরথের কাছে, তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন।

সুমন্ত্র দেখেছেন শোকস্তব্ধ অযোধ্যা নগরী। অনুভব করেছেন,রামহীন রথ দেখে স্ত্রীপুরুষ নির্বিশেষে নারী-পুরুষদের বুকফাটা দীর্ঘশ্বাস, পুরবাসীদের হাহাকার,পুরনারীদের কাতরোক্তি। শত্রু, মিত্র, উদাসীন সকলেই আজ সমব্যথী। নিরানন্দ, কষ্টাতুর, রামের বিরহকাতর অযোধ্যা। সুমন্ত্র, রাজা দশরথকে তাঁর এই অভিজ্ঞতার বৃত্তান্ত জানালেন।
রাজা আবেগমথিত ব্যথাতুর কণ্ঠে স্বীকার করলেন,বিচক্ষণ অভিজ্ঞ মন্ত্রীদের পরামর্শ ছাড়াই, স্ত্রীবুদ্ধি অনুসারে তাঁর এই সিদ্ধান্ত। হয়তো ভবিতব্যবশত, বংশনাশের জন্যেই এই উৎপাত ঘটেছে। সুমন্ত্রর কাছে রাজার অনুরোধ, রাজা যদি কোনদিন সুমন্ত্রর কিছুমাত্র উপকার করে থাকেন, তাহলে সারথি তাঁকে রামের কাছে পৌঁছিয়ে দেবেন।তাঁর আদেশের কণামাত্র মূল্য থাকলে রামকে ফিরিয়ে আনবেন সুমন্ত্র। বহুদূরবর্তী রাম, সীতা, লক্ষ্মণের দর্শনাভিলাষী রাজা দশরথ। রাম বিনা আর এক মুহূর্তের জন্যও এ জীবন নয়। দুঃখে ম্রিয়মাণ রাজার রক্ষাকারী কেউ নেই।

সীমাহীন মনোবেদনায় দুঃখসাগরে নিমজ্জিত রাজা, তাঁর মনঃকষ্ট বর্ণনা করলেন রানির কাছে। এই দুস্তর শোকসাগর রামের শোকাবেগে বেগবান, সীতার বিচ্ছেদ এ সমুদ্রের সীমা, শোকতপ্ত দীর্ঘশ্বাস যেন আবর্তসঙ্কুল সাগরের ভাঙ্গা ঢেউ, অবিরলধারায় বয়ে যাওয়া চোখের জল কলুষিত করেছে এ সাগরের জল। শোকে উত্তলিত হাত যেন মীনেরা, কান্নার আর্ত রব যেন মহা শোকসাগরের গর্জন, বিক্ষিপ্ত এলিয়ে পড়া চুল যেন শৈবালদল, কৈকেয়ী সেখানে সৃষ্টি করেছেন দাবানল, হিংস্র জলচরের ছদ্মবেশে রয়েছে কুব্জা মন্থরার কুমন্ত্রণা, যার ফলে রামের নির্বাসন। নিষ্ঠুর কৈকেয়ীর বর যেন বেলাভূমি।নির্বাসিত রামের বিরহহেতু এই দুস্তর শোকসাগরে নিমজ্জিত রাজার আর উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই। রাম লক্ষ্মণকে দেখতে ইচ্ছুক রাজার ইচ্ছাপূরণ বুঝি আর সম্ভব নয়।

দ্বিগুণ শোকাবেগে বিধ্বস্ত, সংজ্ঞাহীন, রাজার কাতরোক্তিতে ভীতা হলেন রামমাতা কৌশল্যা। ভূতে পাওয়া নারীর মতো কাঁপছেন, মাটিতে আছড়ে পড়ে রামজননী কৌশল্যা। তাঁর ইচ্ছা আর এক মুহূর্তও নয়, গন্তব্য বনবাসী রামের আশ্রয় দণ্ডকারণ্য। সুমন্ত্রর সান্ত্বনার ভাষা আশ্বাসের। সুমন্ত্র রানি কৌশল্যাকে আশার বাণী শোনালেন।

ত্যজ শোকঞ্চ মোহঞ্চ সম্ভ্রমং দুঃখজং তথা। ব্যবধূয় চ সন্তাপং বনে বৎস্যতি রাঘবঃ। কার জন্যে এই শোক, মোহ, দুঃখজনিত সন্তাপ?দূর করুন যত মনঃকষ্ট। রাঘব রাম, নির্দ্বিধায় বনে বাস করবেন। লক্ষ্মণ তাঁর পদসেবাকেই পরমপ্রাপ্তি মনে করেন। আর সীতা? রামের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ সীতা, নির্ভয়ে গৃহকোণের নিশ্চিন্ত সুখ অনুভব করছেন। বনবাসের দীনতা তাঁকে স্পর্শ করেনি। প্রবাসের যোগ্যা বৈদেহীর সহনশীলতা। সীতাকে, অরণ্যজীবন বিন্দুমাত্র কষ্ট দেয়নি বলেই সুমন্ত্রর বিশ্বাস। এ যেন নগরীর উপবনে বাসের সমতুল।বিজন বনে বালিকার মতো তাঁর আনন্দানুভব। রামের সান্নিধ্যে তাঁর বনবাসের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। রামময় সীতার জীবন, রামের অধীন তাঁর জীবন, রামহীন অযোধ্যাবাস তাঁর কাছে অরণ্যবাসের থেকে কোন অংশে কম নয়।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৫: মহাভারতের অন্তর্লোকে কি শুধুই হিংসা ও প্রতিহিংসার ঘৃণা বিদ্বেষ?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬০: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— দুধি লতা ও পঞ্চরতি লতা

চারিদিকের পল্লী, নগর, বৃক্ষ, নদীর বৈচিত্র্যের প্রতি,সীতার অসীম কৌতূহল। তিনি অযোধ্যা পরিমণ্ডলের প্রমোদবন সম্বন্ধে যেমন আগ্রহী তেমনই অরণ্যের অজানা প্রকৃতির অপরিচিত বিষয়ে, সমান উৎসাহভরা জিজ্ঞাসু মনটি তাঁর। সুমন্ত্র আরও জানালেন, কখনও সীতার মুখে একদা সমালোচিত বিমাতা কৈকেয়ী বিষয়ক বিরূপ সমালোচনা তাঁর কানে আসেনি। সীতা, রোদে, শীতে, পথ পরিক্রমায়, বায়ু বেগে, সম্ভ্রমরক্ষায় চাঁদের আলোর তুল্য অবিকৃত সৌন্দর্যের অধিকারিণী। চাঁদের মতো প্রিয়দর্শিনী, পদ্মাননা সীতা সদাই অমলিনা। আলতার রক্তিমাভা সীতার পাদুটিতে, তাই বনবাসে আলতা রঙে না রাঙিয়েও পদ্মকেশরের দ্যুতি ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে।

আভরণবিহীনা সীতা স্বামীর গর্বে গরবিনী হয়ে আগের মতোই নূপুরের শব্দে হংসধ্বনিকে পরাজিত করে অক্লেশে ঘুরে বেড়ান বনে। সিংহ, বাঘ বা হাতিকে দেখে রামের নিশ্চিন্ত বাহুবন্ধনে আশঙ্কিত হয়ে ওঠেন না। তাই বনবাসী স্বজনদের প্রতি উদ্বেগবোধের কোন কারণ নেই। এই চিরন্তন বৃত্তান্ত যুগান্তরেও লোকে প্রচারিত হয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ইদং হি চরিতং লোকে প্রতিষ্ঠাস্যতি শাশ্বতম্। রাজা ও রানির নিজের আর শোকপ্রকাশ সঙ্গত নয়। সুমন্ত্রর যুক্তিপূর্ণ সান্ত্বনা বৃথা হল। মায়ের মন শান্ত হল না। রানি কৌশল্যার বিলাপের অন্ত নেই। হাহাকার করে উঠল মাতৃহৃদয়, ন চৈব বিশ্রাম কূজিতাৎ প্রিয়েতি পুত্রেতি চ রাঘবেতি চ। হায় প্রিয়, হায় পুত্র, হায় রঘুকুলনন্দন, এ শোকের যেন শেষ নেই।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: সরলাদেবী—নির্ভীক এক সরস্বতী

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৪: স্বার্থান্বেষীকেও চিনতে শেখায় এই গ্রন্থ

প্রতিকারহীন শোকের অন্তিম পরিণতি ক্ষোভ, দুঃখ, অসহায়ের আক্রমণাত্মক তিরস্কার ও দোষারোপের শেষ সীমায়। রামজননী কৌশল্যার কণ্ঠে ভর্ৎসনার সুর। রাজা দশরথের প্রতি ক্ষোভের অন্ত নেই তাঁর। দয়াবান, দাতা, প্রিয়ভাষী রাজা দশরথ, তিনজন সুখযাপনে অভ্যস্ত মানুষকে দুঃখী জীবনে ঠেলে দিলেন? সোনার বরণী বৈদেহী অসহনীয় শীত ও প্রখর আতপ সহ্য করবেন কী করে? সুনেত্রা সীতা সুস্বাদু ভোজ্যেই অভ্যস্ত। তিনি বনে নীবার ধানের অন্ন গ্রহণ করবেন কীভাবে? তাল লয়ের সুর শোনাই যাঁর অভ্যাস তিনি অরণ্যে হিংস্র সিংহনাদের শ্রুতিকঠোর গর্জন শুনবেন শুধু? আহা বাছা রাম এখন তাঁর বাহুমাত্র সম্বল করে কোন শয্যায় নিদ্রামগ্ন রয়েছেন? মায়ের বুক ভেঙে যায় ভাবতে, কবে কমলবদন, পদ্মনেত্র সুগন্ধী শ্বাসপ্রশ্বাসরত সুন্দর কেশমণ্ডিত কোমল মুখখানি দেখবেন? তাঁর হৃদয়টি বজ্রতুল্য কঠিন তাই হয়তো রামের অদর্শনেও সেটি সহস্র খণ্ডে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে না।

শুভাকাঙ্খীদের পরামর্শ ছাড়া রাজার কঠোর সিদ্ধান্তের ফলে, বাছারা, প্রাসাদ থেকে আজ বহিষ্কৃত হয়ে, অনিশ্চিত জীবনে, দুঃখী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বনে বনে। বনবাসের শেষে অযোধ্যায় ফিরে ভরত রামকে রাজ্যপাট ও কোষাগার ছেড়ে দেবে কিনা এ বিষয়ে ঘোর সন্দেহ আছে। শ্রাদ্ধে গুণবান ও বিদ্বান ব্রাহ্মণদের ভোজনে অগ্রাধিকার বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন।কিন্ত দেবতুল্য, প্রাজ্ঞ, দ্বিজকুল,সেই অমৃততুল্য অন্ন প্রত্যাখ্যান করে থাকেন। কারণ, বৃষ যেমন শৃঙ্গচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না তেমনই গুণবান ও সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী জ্যেষ্ঠ রামের পক্ষে কনিষ্ঠের শাসিত রাজ্যধারণ ঠিক সাধারণ ব্রাহ্মণদের ভোজনান্তে জ্ঞানী বটরাহ্মণদের ভোজ্যগ্রহণের মতোই অসহ্য ও অবমাননাকর। কনিষ্ঠের শাসিত রাজ্য জ্যেষ্ঠ গ্রহণ করবেন কেন?বাঘ কখনও অন্যের ভোজ্যাবশেষ গ্রহণ করে না। নরশ্রেষ্ঠ রামও এর ব্যতিক্রম নন।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-২৩: রাজসভায় মিথিলার সঙ্গীতজ্ঞ

যজ্ঞের হবি, পুরোডাশ, কুশ, খদির কাঠে নির্মিত যূপ ইত্যাদি পুরাণ হলে যাজ্ঞিকরা পুনর্ব্যবহার করেন না। সারহীন সুরা বা সোমরসহীন যজ্ঞের মতো ভরতের উচ্ছিষ্ট এই রাজ্যকে রাম কিভাবে স্বাগত সম্ভাষণ জানাবেন? বাঘ যেমন তার লেজে স্পর্শ পছন্দ করে না তেমনই রামও এমন অনাসৃষ্টি সইতে পারবেন না।

ভরতের অনুগত মানুষজন এক মহাযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতেও ভীত হবে না। ধার্মিক রাম কিন্ত ধর্মের পথেই চালিত করবেন অধার্মিকদের। রাম মোটেই বলহীন নয়। রাম একাই এই সসাগর লোকসমূহ ধ্বংস করতে সমর্থ। রানি কৌশল্যা তিরস্কারে বিদ্ধ করলেন রাজাকে, পিতা হয়ে পুত্রঘাতক মৎস্যতুল্য আপনি এমন পুরুষসিংহের বিনাশ নিজে ডেকে আনলেন? ধার্মিক পুত্রের প্রতি এই অবিচার শাস্ত্রবিরুদ্ধ আচরণ। কারণ শাস্ত্রে আছে,যথাক্রমে নারীর প্রথম আশ্রয় তাঁর স্বামী,দ্বিতীয় পুত্র,তৃতীয় জ্ঞাতিবর্গ। তাহলে আজ রানির এই দশা কেন? স্বামী থেকেও তাঁর ওপরে কোন অধিকার নেই, পুত্রও নির্বাসিত, স্বামী বর্তমান তাই বনবাসও নিষিদ্ধ। তাহলে আর রইল কী? ক্ষোভে ফেটে পড়লেন দেবী কৌশল্যা। তাহলে রানির সর্বনাশের মূলে আছেন রাজা। রাষ্ট্র,মন্ত্রী সকলের ঘাতক হলেন রাজা। রানি নিজে সপুত্র নিহত হলেন। শুধ তাই নয় পুরবাসীদের নিধনের কারণ রাজা। রাজা দশরথের এই ধ্বংসাত্মক কাজের ফল এমনই ভয়াবহ। শুধু আনন্দ পেলেন ভরতজননী ও ভরত। কৌশল্যার এই আক্রমণাত্মক যুক্তিপূর্ণ ভর্ৎসনায় রাজা ‘হা রাম’ এই কাতরোক্তি করে উঠলেন। প্রবল দুঃখে, মোহাবিষ্ট ও শোকাহত রাজা দশরথের নিজের দুষ্কর্মের বৃত্তান্ত স্মরণে এল।

মন অতলান্ত রহস্যময়তায় ভরা। প্রিয়জনের বিচ্ছেদ বেদনায় মনেহয় সবকিছু নিষ্প্রাণ, নিস্তেজ। প্রকৃতির উজ্জ্বলতা নয়, নিষ্প্রভ দিকটিই তখন প্রকট হয়ে ওঠে।মনের মাধুরী, পারিপার্শ্বিককে সাজিয়ে তোলে। সুমন্ত্রের বেদনাবোধ, তাঁর ব্যথাতুর দৃষ্টিতে অযোধ্যা যেন প্রাণহীনা, অযোধ্যার প্রাণ, পুরবাসী পুরুষ নারীদের মনে শোকের ছায়া। আকস্মিক জননেতার হঠাৎ বিচ্ছেদবেদনায় স্তব্ধ আধুনিক জনজীবনের চির পরিচিত দৃশ্য।শোকের অভিঘাতের প্রভাব বোধ হয় সবযুগেই একই রকম।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৭: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে/২

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

ঘটনাপ্রবাহের প্রভাব ক্রমানুসারে আবর্তিত হয়। প্রশাসনিক ভুল সিদ্ধান্তের মূল্য দেয় সমাজ,রাষ্ট্র পরিবার, সকলে। তখন প্রশাসকের, অনুশোচনা, আক্ষেপ, দ্বন্দ্ববোধ সব নিষ্ফল হয়ে যায়। স্ত্রীর অনুযোগ, তীব্র বাক্যবাণে বিদ্ধ রাজা দশরথ যেন সেই বিভ্রান্ত বিবেকচেতনা। এই বিবেকবোধ, পারিপার্শ্বিকের চাপে পিষ্ট হয়, ক্ষণিক আবেগের ঢেউ ভাসিয়ে নিয়ে যায় ধর্মবোধ, দূরদর্শিতা, কোমলবৃত্তি, ন্যায় অন্যায়বোধ। জীবনে স্থিতাবস্থা ব্যাহত হলে, কঠোর কঠিন বাস্তব বুঝিয়ে দেয়,ভুলটি কোথায়? তখন আর ত্রুটি সংশোধনের উপায় নেই।

শুধু নিজে আত্মক্ষয়ী অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে, ক্ষয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায় থাকে না। কোন যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে,তালিকার যোগ্যতার মান ভঙ্গ করে, যদি পরবর্তীকে সুযোগ দেওয়া হয় তবে সেটি একরকম প্রতারণার সামিল। দোষীর কাঠগড়ায় ওঠেন রাজা দশরথ থুরি সঠিক বিবেকচেতনা। তার সিদ্ধান্তের কাটাছেঁড়া, মূল্যায়ন শুরু হয় তখন। প্রশাসনের ক্ষেত্রে বিবেকবান প্রশাসকের কাছে থাকে অপরিমিত প্রত্যাশা। তিনি মুহূর্তের ভুলে, মোহগ্রস্ত হয়ে যদি সেই আশায় জল ঢেলে দেন তখন তার মূল্য দিতে হয়, অবিশ্বাস, সন্দেহ, প্রশ্ন,এমন কি জীবন দিয়ে।

ছবি: প্রতীকী।

রানি কৌশল্যা সেই সন্দেহ,সংশয়,আশঙ্কার দ্বন্দ্বময় দিক। এ সংশয় হয়তো অমূলক নয়। ক্রমভঙ্গের মাসুল দিতে হয়। রামের নির্বাসন, প্রশাসনিক রদবদল, ভরতের ভাবি প্রশাসন, প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখীন হয়। রাষ্ট্র ভুক্তাবশিষ্ট অন্নের মতোই উচ্ছিষ্ট হয় কী পরবর্তী প্রশাসকের দৃষ্টিতে? কনিষ্ঠ ভরতের রাজ্য প্রাপ্তির পরে রাম, দীর্ঘ বনবাসান্তে, সেই রাজ্যকে পরম যত্নে আপন করে নেবেন? ভরতের বিরোধিতার আশঙ্কা কী সত্য? এ সবকিছুই সাধারণের আশঙ্কা, উদ্বেগ, যেগুলি স্নেহাধিক্য বা নিঃশর্ত আনুগত্য থেকে জন্ম নেয়। কৌশল্যা সেই মোহাবিষ্টা স্নেহময়ী ফল্গুধারা, যাঁরা ঘটনার কঠোরতার অভিঘাত সহ্য করতে পারেন না। বিবেকবোধকে আদালতের কাঠগড়ায় তুলে জেরা করেন, ঘটনার চুলচেঁড়া বিশ্লেষণে উঠে আসে ক্লেদ, ঘৃণা, হাহাকার। শুধু বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। ভেঙ্গে পড়েন রাজা দশরথ, ভেঙে যায় যুক্তিবোধ, বিবেক মূক হয়, মুখর হতে পারে না। এটিই বোধ হয় সমাজের নৈতিকতার নিরিখে চিরকালীন যুগচিত্র।

আমরা রামের মতো নির্লিপ্ত উদাসীন হতে পারি না। যা নই সেই আদর্শ যখন অধরা থেকে যায় তখন তাকে জয় করার প্রচ্ছন্ন বাসনা মনে রয়ে যায়। তাই রাম উত্তম আদর্শ পুরুষ হয়ে স্বমহিমায় আজও বিরাজমান। দৈবের প্রতিকূলতা, পরিবারিক অনুশাসনের বিরুদ্ধাচার না করে, জীবন যখন,যে পরিবেশে ঠেলে ফেলে দেয় সেইভাবেই মেনে নিয়ে এগিয়ে চলার যে গৌরব সেই অতিমানবিক দৃঢ়তা আমাদের নেই। তাই মনে মনে যিনি এমন পারেন বা তিনি যা হয়েছেন সেই আদর্শকে আঁকড়ে ধরে মনে মনে আশার বীজ বুনে চলি। নিজেকে ছাপিয়ে চাওয়ার মধ্যে হীনমন্যতার দীনতা নেই, নেই হতদৈন্য কোন ক্লীব মানসিকতা। ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে যে ঔদাসীন্য, তার মধ্যে সাহসের অভাব নয়, আছে এক চরম ত্যাগের সুপ্ত মহিমা। তাই রামায়ণের প্রতিষ্ঠার ভিত দৃঢ় হয়ে গেঁথে যায় আপামর ভারতীয়ের মনোভূমিতে। প্রতিকূলতায় ভরা অরণ্যবাসে সীতার স্বামীসান্নিধ্যের স্মৃতি আজও রোমাঞ্চিত করে ভারতীয় নারীদের।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content