বৃহস্পতিবার ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

ঋষি বশিষ্ঠের ঔরসে ইক্ষ্বাকুবংশের রাজা কল্মাষপাদের বংশরক্ষা হল। মহর্ষি বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূ, শক্ত্রির স্ত্রী অদৃশ্যন্তী শক্ত্রিতুল্য একটি পুত্রের জন্ম দিলেন। শত পুত্র হারিয়েও মহর্ষি বশিষ্ঠের বংশধারা অক্ষুণ্ণ রইল। বংশলোপের আশঙ্কায় মৃতপ্রায় বশিষ্ঠের প্রাণ সঞ্চার করলেন সেই বংশধর। তাই তাঁর নাম হল পরাশর। পরাসুঃ স্থাপিতস্তেন বশিষ্ঠঃ স যতো মুনিঃ। গর্ভস্তেন ততো লোকে পরাশর ইতি স্মৃতঃ।। পরাসু অর্থাৎ বংশলোপের আশঙ্কায় নিষ্প্রাণ বশিষ্ঠ মুনির মধ্যে নিস্তেজভাবের বিনাশ করেছিল এই পুত্র। তাই তাঁর নাম হল পরাশর। “পরাসুং পিতামহবশিষ্ঠস্য পরাসুভাবং শৃণাতি হিনস্তীতি পরাশরঃ” পরাশর, মহর্ষিকেই পিতা বলে মনে করতেন। একদা মা অদৃশ্যন্তীর উপস্থিতিতেই মহর্ষি বশিষ্ঠকে পিতা সম্বোধন করায়, মা তাঁকে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে জানালেন, মা তাত তাত তাতেতি ব্রূহ্যেনং পিতরং পিতুঃ। রক্ষসা ভক্ষিতস্তাত!তব তাতো বনান্তরে।। বাবা বাবা বলে বাবার বাবাকে ডাকিস না। তোর বাবাকে, এক রাক্ষস বনে খেয়ে ফেলেছে। আর্য্য এষ পিতা তস্য পিতুস্তব যশস্বিনঃ।

এই মহাশয় তোর পিতার পিতা। সত্যবাদী পরাশর, চরম দুঃখে সমস্ত রাক্ষসকুল বিনষ্ট করবেন, মনস্থ করলেন। বাদ সাধলেন ব্রহ্মবিদদের মধ্যে সর্বোত্তম, তীক্ষ্ণধী, মিত্রাবরুণতনয়, মহর্ষি বশিষ্ঠ। তিনি এক কাহিনির অবতারণা করলেন। ভৃগুবংশীয়দের যজমান ছিলেন কৃতবীর্য্য নামে খ্যাত এক রাজা। রাজা কৃতবীর্য্য, সোমযাগ সমাপনান্তে পর্যাপ্ত ধন ধান্য দান করে, ভৃগুবংশীয়দের পরিতৃপ্ত করতেন। রাজা কৃতবীর্য্যের প্রয়াণের পরে, বংশধরদের ব্যয়সাধ্য কাজের জন্য ধনের প্রয়োজন হল। ভৃগুবংশীয়রা ধনবান। তাই অর্থের আশায় তাঁদের দ্বারস্থ হলেন। ভৃগু বংশীয়রা, অক্ষয় ধনরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কেউ মাটির তলায় পুঁতে রাখলেন, কেউ আবার ক্ষত্রিয়দের ধনাধিকার থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে ব্রাহ্মণদের দিয়ে দিলেন, আবার কেউ ক্ষত্রিয়দের বলপ্রয়োগের ভয়ে তাঁদের ইচ্ছানুসারে ধন দিয়ে দিলেন। এর পরে কোনও ক্ষত্রিয় এক ভৃগুবংশীয়ের ঘরের মাটি খুঁড়ে ধনের সন্ধান পেলেন। সমবেত ক্রুদ্ধ ক্ষত্রিয়রা, শরণাগত ভার্গবদের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সেই সঞ্চিত ধন দেখতে লাগলেন।
এরপরে মহাধনুর্দ্ধারী ক্ষত্রিয়রা ভার্গবদের সবংশে নিধন করলেন। এমন কি, গর্ভস্থ শিশুরাও এই ক্ষত্রিয়রোষের শিকার হল। প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া ভার্গব অর্থাৎ ভৃগুবংশীয়দের স্ত্রীরা, বংশরক্ষায় মরিয়া হয়ে, আশ্রয় নিলেন দুর্গম হিমালয়পর্বতে। একজন ভৃগুপত্নী, স্বামীর বংশসূত্র রক্ষার তাগিদে ঊরুতে গর্ভ ধারণ করলেন। এক ব্রাক্ষণী, এই গর্ভবিষয়ে জেনে, ত্রস্ত হয়ে, সঙ্গে সঙ্গে জনান্তিকে ক্ষত্রিয়দের সেই গুপ্ত তথ্য জানিয়ে দিলেন। ক্ষত্রিয়রা সেই গর্ভ নষ্ট করবার জন্য উদ্যোগ নিলেন। তেজস্বিনী ব্রাহ্মণীর ঊরু ভেদ করে, গর্ভস্থ সন্তান, মধ্যাহ্নের দীপ্যমান সূর্যের মতো, ক্ষত্রিয়দের দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে, বহির্গত হল। অন্ধ ক্ষত্রিয়রা সেই পর্বতেই কিছুদিন অবস্থান করে, তাঁদের প্রতিহিংসা গ্রহণে ব্যর্থ হলেন। ভয়ার্ত ক্ষত্রিয়রা দৃষ্টিশক্তি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে সেই সম্মানীয়া ব্রাহ্মণীর শরণাপন্ন হলেন।

স্তিমিতপ্রায় অগ্নিশিখাতুল্য ক্ষত্রিয়দের তেজোবহ্নি। ক্ষত্রিয়রা কথা দিলেন, তাঁরা আর কোনও পাপকাজ করবেন না। সুস্থতাই তাঁদের একমাত্র কাম্য। তাই, সপুত্রা ত্বং প্রসাদং নঃ কর্ত্তুমর্হসি শোভনে। পুনর্দৃষ্টিপ্রদানেন রাজ্ঞঃ সন্ত্রাতুমর্হসি।। হে শোভনে, পুত্র এবং আপনি আমাদের অনুগৃহীত করুন। পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়ে রাজাকে ক্ষত্রিয়দের রক্ষা করুন। ব্রাহ্মণী আশ্বস্ত করলেন, অন্ধত্বের কারণ তিনি নিজে নন। ঊরু থেকে জাত ওই ঔর্ব নামে ভার্গব নামের বালকটিই এর জন্য দায়ী।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭৪: রাজা দশরথ, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা সকলেই কি এক একটি জীবনবোধের প্রতীক?

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৫: আজি এ কোন গান নিখিল প্লাবিয়া

ব্রাহ্মণী জানালেন, ক্ষত্রিয়কৃত ভার্গবদের হত্যালীলা থেকে গর্ভস্থ সন্তানকে রক্ষা করবার জন্যে, ব্রাহ্মণী তাঁকে ঊরুতে ধারণ করেছিলেন মাত্র। গর্ভস্থ অবস্থায় সেই বালকটি ষড়ঙ্গসহ সমস্ত বেদ, অধিগত করেছেন। পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সেই ক্রুদ্ধ বালক ক্ষত্রিয়দের ধ্বংস করবার জন্য তাঁদের দৃষ্টিশক্তি হরণ করেছেন। ব্রাহ্মণীর অনুরোধে ক্ষত্রিয়রা ঔর্বের অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন। ঊরু থেকে জাত ঔর্ব প্রসন্ন হলেন। ক্ষত্রিয়রা দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেয়ে প্রস্থান করলেন। ঔর্ব নামের সেই ব্রহ্মর্ষি কিন্তু এই ঘটনাকে সর্বলোকের পরাজয় মনে করলেন। ব্রহ্মর্ষি, শক্তিবৃদ্ধির জন্য কঠোর তপস্যা শুরু করলেন। প্রয়াত পিতৃপুরুষরা এর বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়া অনুমান করে তাঁকে দেখা দিলেন। তাঁরা ঔর্বকে ক্রোধ সংযত করবার অনুরোধ করলেন। ঔর্ব্ব! দৃষ্টঃ প্রভাবস্তে তপসোগ্রস্য পুত্রক!। প্রসাদং কুরু লোকানাং নিয়চ্ছ ক্রোধমাত্মনঃ।।

তোমার তপস্যার উগ্র প্রভাব প্রত্যক্ষ করছি। তুমি, লোকসমূহের প্রতি প্রসন্ন হও, ক্রোধ সংবরণ কর। পূর্বপুরুষরা জানালেন, তাঁরা দীর্ঘায়ু আশা করেননি। তাই ক্ষত্রিয়দের হাতে বধ তাঁদের অভীপ্সিত ছিল। তাঁরা মাটির গভীরে ধন প্রোথিত করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল শত্রুতার সৃষ্টি। তাঁরা স্বর্গ কামনা করেছিলেন। কিন্তু আত্মঘাতী হলে স্বর্গলাভ সম্ভব নয়। তাই বোধ হয়, ক্ষত্রিয়দের সঙ্গে শত্রুতার সৃষ্টিও পূর্বপরিকল্পিত। তাই ক্ষত্রিয়দের প্রতি ক্রোধবশত সমস্ত লোক বিনাশের সিদ্ধান্তরূপ পাপকাজ একেবারেই কাম্য নয়। বিশেষ করে, তপস্যার প্রভাবকে দূষিত করছে যে ক্রোধ তাকে বিনষ্ট করা ঔর্বের কর্তব্য। দূষয়ন্তং তপস্তেজঃ ক্রোধমুৎপতিতং জহি। ব্রহ্মর্ষি ঔর্ব জানালেন, তাঁর ক্রোধ ও প্রতিজ্ঞা নিষ্ফল হতে পারে না। এই প্রতিজ্ঞারক্ষায় অসফল ক্রোধ প্রকাশ না করলে, আগুন যেমন জ্বালানি অরণি কাঠকে দগ্ধ করে তেমনই ক্রোধ আমাকে দগ্ধ করবে। বৃথা-রোষ-প্রতিজ্ঞো বৈ নাহং ভবিতুমুৎসহে। অনিস্তীর্ণো হি মাং রোষো দহেদগ্নিরিবারণিম্।।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৪: প্রতিমাদেবী— এক দুঃখবতীর কথা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৩: রাজনীতিতে উন্নতির জন্য নিন্দা বা প্রশংসা ব্যক্তিগত পরিসরে করাই শ্রেয়, সভায় নয়

তাঁর অকাট্য যুক্তি প্রস্তুত। তাঁর মতে, যিনি যুক্তিসঙ্গত ক্রোধ সংবরণ করেন, তিনি ত্রিবর্গ অর্থাৎ ধর্ম, অর্থ ও কাম রক্ষা করতে পারেন না। বিজয়াভিলাষী রাজারা, অশিষ্টদের শাসনের জন্য ও শিষ্টদের রক্ষার কারণে ন্যায্য স্থানে ক্রোধ প্রকাশ করে থাকেন। ব্রহ্মর্ষি ঔর্বের যুক্তি হল, ভৃগুবংশীয়দের পিতা মাতারা যখন অসহায় হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তখন কেউ তাঁদের রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। পাপের প্রতিরোধকারী যদি কেউ না থাকেন তবে বহু মানুষ পাপকাজে প্রবৃত্ত হবেন। শারীরিক বলে বা তপস্যার শক্তিতে যিনিই পাপের প্রতিকার না করেন তিনিও সমানভাবে পাপকাজে যুক্ত হয়ে থাকেন। রাজা ও তপস্বীরা সামর্থ্য সত্ত্বেও নিজের জীবনকে প্রিয় মনে করে ঔর্বের পিতৃপুরুষদের রক্ষা করেননি। তাই তপস্যার বলে বলী, ব্রহ্মর্ষি ঔর্বও, জনতা ও পূর্বপুরুষদের কথা রাখতে পারবেন না।

মোটকথা ব্রহ্মর্ষি ঔর্ব তপস্যার শক্তির সদ্ব্যবহার করবেনই। তিনি কোনও মতেই লোকসংহারের ইচ্ছা দমন করবেন না। কারণ পাপের ভয়ে লোকসংহারের জন্য সঞ্চিত অথচ অবদমিত এই ক্রোধের দহন জ্বালায় তিনি নিজে দগ্ধ হবেন। যশ্চায়ং মন্যুজো যেঽগ্নির্লোকানাদাতুমিচ্ছতি। দহেদেষ চ মামেব নিগৃহীতঃ স্বতেজসা।। পিতৃপুরুষরা সর্বলোকের কল্যাণকামী, তাই পৃথিবীর হিতকামনায় ও বংশধর ঔর্বের মঙ্গলচিন্তায় বরং মনোনিবেশ করুন। পিতৃলোকবাসীরা বললেন, তাহলে বিশ্বলোকের বিধ্বংসী ক্রোধকে ঔর্ব বরং জলে নিক্ষেপ করুন। কারণ সব রসই যে জলে, জলময় এই জগৎ। তাই, ওহে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, তোমার এই ক্রোধবহ্নি, জলেতে বিমুক্ত কর অপোময়া সর্ব্বরসাঃ সর্ব্বমাপোময়ং জগৎ। তস্মাদপ্সু বিমুঞ্চেমং ক্রোধাগ্নিং দ্বিজসত্তম।। এই ক্রোধাগ্নি জলে অবস্থান করে বিরামহীনভাবে জল দগ্ধ করুক, কারণ সমগ্র লোকই যে জলময়। এমন হলে প্রতিজ্ঞাটিও সত্য হবে, আবার দেবতা, মানুষ সকলেই বিনষ্ট হবেন না। সেই ক্রোধ সমুদ্রে নিক্ষেপ করলেন ঔর্ব। ঋষি ঔর্বের রোষ,বিশাল ঘোটকের মুখাবয়ব ধারণ করে বহ্নি উদ্গিরণ করতে করতে সমুদ্রের জল পান করতে থাকল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭৭: কথা কিছু কিছু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৭: উপবাস নিয়ে শ্রীমায়ের দৃষ্টিভঙ্গি

ঔর্বের কাহিনির অবতারণা করে মহান বশিষ্ঠ তাঁর উত্তরপুরুষ পরাশরকে এই শিক্ষাই দিলেন, পরম জ্ঞানী পরাশর, লোকসমূহের পরম জ্ঞান অধিগত করে সেই লোককে হত্যা করতে পারেন না। তস্মাত্ত্বমপি ভদ্রং তে ন লোকান্ হন্তুমর্হসি। পরাশর!পরাল্লোঁকান্ জানন্ জ্ঞানবতাং বর।।

মহর্ষি পরাশর,সমগ্র লোকের বিনাশকর ক্রোধ থেকে নিবৃত্ত হলেন ঠিকই তবে পিতৃহত্যার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে রাক্ষসমারণ যজ্ঞ শুরু করলেন। বালক থেকে বৃদ্ধ সব রাক্ষসদের দগ্ধ করতে লাগলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ তাঁকে বাধা দিলেন না। উদারবুদ্ধি মহর্ষি অত্রি এই যজ্ঞের সত্বর সমাপ্তি, প্রয়োজন মনে করলেন। মহর্ষি পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, মহাক্রতু প্রভৃতি মহর্ষিরা রাক্ষসদের পরিত্রাণের জন্যে উপস্থিত হলেন। মহর্ষি পুলস্ত্য,পরাশরকে খেদের সঙ্গে বললেন, নির্দোষ রাক্ষসরা, যারা পরাশরের পিতা শক্ত্রির হত্যার বৃত্তান্ত জানে না তাদের বধ করে কী উল্লাস অনুভব করছেন তিনি? মহর্ষি পুলস্ত্যের বংশধর রাক্ষসদের বিনাশ করবার সামর্থ্য, তপস্বী ব্রাহ্মণদের নেই।

মহর্ষি পুলস্ত্যের উপদেশ—হে পরাশর,কামক্রোধনিবৃত্তিকর, পরম ধর্ম শান্তি, অবলম্বন কর। শম এব পরো ধর্ম্মস্তমাচর পরাশর!। শ্রেষ্ঠ হয়েও তাঁর এই অধর্মাচরণ কেন? ঋষি শক্ত্রি তাঁর নিজের প্রদত্ত শাপের ফল ভোগ করে স্বর্গ লাভ করেছেন। ঋষি শক্ত্রির মৃত্যু তাঁর নিজের পরিকল্পিত। তা না হলে কোনও রাক্ষসের তাঁকে হত্যা করবার সাধ্য ছিল না। অন্যান্য বশিষ্ঠপুত্রও একই গতি লাভ করছেন। পরমানন্দে আছেন তাঁরা। মহর্ষি বশিষ্ঠ এই বৃত্তান্ত জনেন। মহর্ষি বিশ্বামিত্র, রাজা কল্মাষপাদ, এঁরা ঘটনার নিমিত্তমাত্র। তাই এই রাক্ষসদের মারণযজ্ঞের নিয়ামক মহর্ষি বশিষ্ঠের বংশধর, মহর্ষি পরাশর, এই যজ্ঞ থেকে নিবৃত্ত হন। নিমিত্তভূতস্ত্বঞ্চাত্র ক্রতৌ বাশিষ্ঠনন্দন!। তৎ সত্রং মুঞ্চ ভদ্রং তে সমাপ্তমিদমস্তুতে।। মহাপ্রাজ্ঞ পুলস্ত্য ও বশিষ্ঠের অনুরোধে যজ্ঞে ইতি টানলেন মহর্ষি পরাশর। রাক্ষসনিধন যজ্ঞের সংগৃহীত অগ্নিকে নিক্ষেপ করলেন হিমালয়ের উত্তরপার্শ্বে। প্রত্যেক চতুর্দশী তিথিতে আজও সেই আগুন, রাক্ষস, তরুরাজি, পাথর দগ্ধ করে চলেছে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৬: বার্নার্ড শ ও শার্লটি —তবে কেন মিছে ভালোবাসা/২

গন্ধর্বরাজ এই সব বৃত্তান্ত তাঁর আগ্রহী শ্রোতা,বন্ধু, অর্জুনকে শোনালেন। অর্জুনের প্রশ্নের শেষ নেই। এখন তাঁর জিজ্ঞাস্য বিষয় হল—রাজা কল্মাষপাদ নিজের ভার্যার ক্ষেত্রে মহর্ষি বশিষ্ঠের মাধ্যমে নিয়োগবিধির (পুত্রোৎপাদনে অন্যকে নিয়োগ করা) আশ্রয় নিলেন কেন? ধর্মের তত্ত্বকথা জেনেও, মহর্ষি বশিষ্ঠ, অগম্যা পুত্রবধূতুল্যা কল্মাষপাদপত্নীতে উপগত হলেন কেন? অর্জুনেরএই সংশয় দূর করলেন অঙ্গারপর্ণ।

অভিশাপগ্রস্ত ক্রুদ্ধ রাজা কল্মাষপাদ, ক্ষুধার্ত অবস্থায়, সপত্নী, হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল বিজন বনে যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন, তখন মৈথুনের ইচ্ছায় অরণ্যে উপস্থিত এক ব্রাহ্মণ দম্পতিকে দেখতে পেলেন। দম্পতির মনোবাসনা পূর্ণ হল না। তাঁরা দু’জনে, ভয়ে, পালিয়ে বাঁচতে তৎপর হলেন। রাজা তাঁর বাহুবলে ধরে ফেললেন ব্রাহ্মণকে। ব্রাহ্মণী, রাজাকে সতর্ক করে বললেন, সূর্যবংশের রাজা কল্মাষপাদ, সাবধানতা অবলম্বন করে ধর্মাচরণ এবং গুরুশুশ্রূষায় নিরত আছেন। হে শাপগ্রস্ত,দুর্দ্ধর্ষ রাজা, পাপকাজের যোগ্য নও তুমি। শাপোপহত! দুর্দ্ধর্ষ! ন পাপং কর্ত্তুমর্হসি।

ব্রাহ্মণী জানালেন, তাঁর ঋতুকাল উপস্থিত, গৃহে স্বামীর অভিমানদোষে ক্লিষ্টা ও পুত্রোৎপাদনে অকৃতকার্য হয়ে সন্তানপ্রসবের লক্ষ্যে বনে এসেছিলেন। রাজার কাছে ব্রাহ্মণীর অনুরোধ, প্রসীদ নৃপতিশ্রেষ্ঠ! ভর্ত্তাঽয়ং মে বিসৃজ্যতাম্। হে নৃপশ্রেষ্ঠ, প্রসন্ন হও। আমার স্বামীকে ছেড়ে দাও। ব্রাহ্মণীর কাতর আবেদন অগ্রাহ্য করে, বাঘ যেমন হরিণ ভক্ষণ করে তেমনই নির্বিচারে ব্রাহ্মণকে ভক্ষণ করলেন রাজা। ব্রাহ্মণী, প্রবল ক্রোধে, দুঃখে, শোকে কল্মাষপাদ রাজাকে অভিশাপ দিলেন, যেহেতু, অতৃপ্ত মনোরথ ব্রাহ্মণীর সম্মুখে, নিষ্ঠুর রাজা তাঁর প্রিয় স্বামীকে ভক্ষণ করলেন, তাই ব্রাহ্মণীর শাপে, বুদ্ধিভ্রমবশত রাজা ঋতুকালে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ামাত্র, তৎক্ষণাৎ প্রাণত্যাগ করবেন। পত্নীমৃতাবনুপ্রাপ্য সদ্যস্ত্যক্ষ্যসি জীবিতম্।

এ ছাড়াও যে রাজা, মহর্ষির পুত্রদের বিনাশ করেছেন সেই পুত্রহারা মহর্ষি বশিষ্ঠের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে রাজার ভার্যা পুত্রের জন্ম দেবেন। হে অধম রাজা, সেই পুত্রই হবেন তোমার বংশধর। স তে বংশকরঃ পুত্রো ভবিষ্যতি নৃপাধম। ব্রাহ্মণী আগুনে আত্মাহুতি দিলেন। বহুকাল পরে গভীর তপস্যা,জ্ঞান ও মহর্ষি বশিষ্ঠের অনুগ্রহে ঋষি শক্ত্রিপ্রদত্ত অভিশাপ থেকে মুক্ত হলেন রাজা কল্মাষপাদ। এর পরেও একদা রাজার মতিভ্রম হল। রানির ঋতুকালে রাজার সঙ্গমের ইচ্ছা জাগল। রাজমহিষী নিষেধ করলেন। কামোন্মত্ত রাজা বারণ শুনলেন না। শেষে রাজমহিষীর কথাতেই রাজা সতর্ক হলেন, ব্রাহ্মণীর শাপের বৃত্তান্ত স্মরণ করে বিষণ্ণ রাজা অনুতপ্ত হলেন। তাই বংশরক্ষার কারণে রাজা কল্মাষপাদ মহর্ষি বশিষ্ঠের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

ছবি: প্রতীকী।

ইক্ষ্বাকুবংশের পুরোহিত বশিষ্ঠের অসীম প্রভাবের বৃত্তান্ত জেনেই হয়তো অর্জুন তাঁদের পুরোহিত নিয়োগের আবশ্যকতা অনুধাবন করলেন। গন্ধর্বরাজের পরামর্শ অনুসারে উৎকোচকতীর্থে অবস্থানরত ঋষি দেবলের অনুজ সর্ববেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ ঋষি ধৌম্যকে অভিভাবকরূপে পৌরোহিত্যে বরণ করলেন। পাণ্ডবরা মনস্থ করলেন, তাঁরা পুরোহিত ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে যোগদান করবেন।

মহাভারতের কাহিনি বৈচিত্র্যে আছে হিংসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষের দিনলিপি, তেমনই আছে শেষে পূর্ণ শান্তির বিনির্মাণ। আছে বংশধারার বিলোপের মধ্যে উন্নত রক্তের সংমিশ্রণের বার্তা। ধ্বংস ও সৃষ্টির অবিচ্ছিন্ন গতিময়তা জীবনের উত্তরণের সূচক। সৃষ্টি ও ধ্বংসের এই ক্রমপর্যায়ে আজও চলমান জীবন তথা পৃথিবী ও মহাবিশ্ব।

মহর্ষি বশিষ্ঠের উত্তরসূরী শক্ত্রিপুত্র পরাশর পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে চেয়েছেন। প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠেছেন তিনি। ক্ষমাশীল পিতামহ, মহান বশিষ্ঠ, ক্ষমাশীলতার পাঠ শিক্ষা দিতে উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি উদাহরণরূপে যে কাহিনির অবতারণা করেছেন সেটিও রাজা কৃতবীর্য্যের বংশধরদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবার বৃত্তান্ত। কিন্তু সেই রক্তাক্ত হিংসার প্রতিফল হল আরও মারাত্মক অন্ধত্ব। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানদৃষ্টির স্বচ্ছতা,মনকে আবিলতা, ক্লেদ, গ্লানি মুক্ত করে। ক্ষত্রিয়দের এই অন্ধত্ব যেন মনুষ্যত্ববোধজনিত জ্ঞানদীপ্তির অভাব। যখন ঔদ্ধত্য মানসিক শক্তির কাছে নতমস্তকে ভুল স্বীকার করে তার প্রতিদান হয় একমাত্র নিঃশর্ত ক্ষমা। মানসিক শক্তিও অসীম নয়,সেখানেও সীমাবদ্ধতা আছে।

সর্বোপরি ষড়রিপুর অন্যতম ক্রোধ যদি কোনও মহৎ শক্তিকে চালিত করে তবে তার পরিণতি শুধুই ধ্বংস। নিরাময় নয়,শুধুই নিপীড়ন।অত্যাশ্চর্য শক্তির আধার মানুষের দম্ভ,বোধ হয় আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তাঁদের ক্রোধের অভিঘাত আরও বেশি। আত্মঘাতী ক্রোধের জ্বালায় দিশাহারা ঔর্ব, ক্রোধানল সমুদ্রের জলে বিসর্জন দিয়েছেন।জলেই দ্রবীভূত হয় এই পঞ্চভৌতিক শরীরের অন্তর্গত যা কিছু পার্থিব রাগ, রোষ, মান, অভিমান, হিংসা দ্বেষ, প্রেম, প্রীতি, বাৎসল্য, নিষ্ঠুরতা, করুণা, মমত্ববোধ অশুভ ও শুভবোধ সব সবকিছু।ঋষি বশিষ্ঠের নবীন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে হয়তো এটাই শিক্ষণীয় বার্তা ছিল—মানুষের জীবন,বিনাশে নয়, লোকের কল্যাণে উৎসর্গীকৃত।

প্রতিহিংসার জ্বালা তুষের আগুনের মতো অন্তর্নিহিত থেকে যায়,সহজে মেটে না। মহর্ষি পরাশরের নির্বিচারে রাক্ষসদের গণহত্যা, সেটাই প্রমাণ করে। সবার ওপরে আছে মানুষের শুভবোধ, যার প্রতি অসীম আস্থায় মহাভারতকার বার বার সেই শুভবোধের বিজয় ঘোষণা করেছেন। মহর্ষি পরাশরের রাক্ষসনিধন পর্বের সমাপ্তি টেনে হয়তো সেই বার্তাই দিতে চেয়েছেন।
রাজা কল্মাষপদের রাক্ষসত্বের হিংস্র পরিণাম পীড়াদায়ক। মানুষের মধ্যে মাথা চারা দিয়ে ওঠে যে উগ্র পশুত্ব তা সাময়িক। এর অবসান প্রয়োজন। সঙ্গমরত দম্পতির একান্ত অবসরে তাঁদের একজনকে হত্যা যেন রামায়ণের ক্রৌঞ্চবধের ফলে পরিবেশের দূষণ সৃষ্টির সমতুল বলেই মনে হয়। এ শুধু সূচনামাত্র। মহাভারত আরও নগ্ন, হিংস্র পাশব উদাহরণে পরিপূর্ণ। তবে ইতিবাচক দিকও আছে। সঙ্গমে বিঘ্নসৃষ্টিকারীর শাস্তি প্রাণঘাতী সঙ্গমেচ্ছার জাগরণ, শেষে নৈরাশ্যের ব্যর্থতা। বংশ উচ্ছেদের শাস্তি, বিনষ্টবংশের প্রাণপুরুষের মাধ্যমে বংশধারার গতি বজায় রাখা প্রভৃতি। এই সবকিছুর ঊর্দ্ধে আছে শুভ, কল্যাণ, হিত চিন্তা, মণিমুক্তা রত্নরাজি যেগুলি আজও ভরতবংশীয়দের অমূল্য সম্পদ।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content