শনিবার ২৩ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

একচক্রা নগরীতে পাণ্ডবদের আশ্রয়দাতা ব্রাহ্মণের পরিবার, এক ঘোর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে। কোনও এক রাক্ষসের কবলে পরেছে ব্রাহ্মণ পরিবারটি। পরিবারের মধ্যমণি ব্রাহ্মণ ও তাঁর স্ত্রী রাক্ষসের মুখোমুখি হতে ইচ্ছুক। কন্যাটি পিতামাতার আত্মত্যাগের উদ্যোগ ও পরিণাম শুনে, সেও তার নিজ বক্তব্যের সমর্থনে যুক্তিজাল বিস্তার করল। যে কোনও পরিবারেই, কন্যাকে একসময়ে (বিবাহযোগ্যা হলে) পরিত্যাগ করতেই হয়, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই ত্যাগযোগ্যা কন্যাটিকে এখনই সদ্য পরিত্যাগ করে পরিবারের সকলকে রক্ষা করা হোক। ত্যক্তব্যাং মাং পরিত্যজ্য ত্রাহি সর্ব্বং মমৈকয়া। মানুষ সন্তান কামনা করে বিপদ থেকে পরিত্রাণের আশায়। তাই কন্যার অনুরোধ—এই আসন্ন বিপদের সময়ে, পরিবারটিকে বিপদসাগর থেকে রক্ষায় ইচ্ছুক কন্যাকে নৌকাতুল্য উদ্ধারের মাধ্যমরূপে ব্যবহার করা হোক। তস্মিন্নুপস্থিতে কালে তরধ্বং প্লববন্ময়া

কন্যার বক্তব্য হল, পুত্র যদিও নরকের পরিত্রাতা, পুন্নাম্নো নরকাৎ ত্রায়তে। তাই সে পুত্র। কন্যা দৌহিত্রের জন্ম দেয়, সেই দৌহিত্রের হয়তো পুত্রতুল্য গুরুত্ব আছে। এক্ষেত্রে দৌহিত্র নয়, কন্যা স্বয়ং পিতার উদ্ধারকর্তা হবেন। পিতা মৃত্যুবরণ করলে, নিঃসন্দেহে, অনাথ বালক ভাইটি, আর বাঁচবে না। ফলে বংশে পিণ্ডদাতা কেউ আর জীবিত থাকবে না। সেটি পিতৃপুরুষদের কাছে অপ্রিয় হবে। এই দুঃখভার সহ্য করতে না পেরে, কন্যার বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠবে। অথচ এমনটি ঘটবার নয়। পুত্র আত্মার সদৃশ, স্ত্রী সখাতুল্য শুধু কন্যা যত কষ্টের কারণ। তাই সেই কষ্ট থেকে এখন মুক্ত করতে হবে নিজেকে। উপায় হল কন্যাকে ধর্মকার্যে নিয়োগ। কন্যা,বালিকা এবং দীনা। পিতৃহীনা হলে অধিক দীনতা গ্রাস করবে তাকে। তাই যে কোনও স্থানে সেই কন্যাটি যেতে ইচ্ছুক। মোট কথা সে অসাধ্য সাধন করে বংশকে উদ্ধার করবে।
কন্যাকে একসময়ে পরিত্যাগ করতেই হবে তাহলে এখনই নয় কেন? বাবা জীবিত না থাকলে, কুকুরের মতো পরের দ্বারে ভিক্ষে করতে হবে পরিবারের সকলকে। কন্যার গভীর বিশ্বাস—পিতা যদি এই কষ্ট হতে সবান্ধবে রক্ষা পান তাহলে অমৃতা হয়ে সে পরম সুখ লাভ করবে। ত্বয়ি ত্বরোগে নির্ম্মুক্তে ক্লেশাদস্মাৎ সবান্ধবে। অমৃতেব সতী লোকে ভবিষ্যামি সুখান্বিতা।। পিতা যদি তাকে পরিত্যাগ করেন। তবে তিনিই হবেন পিতৃপুরুষদের জলদাতা এবং ফলে মহা হিতাকাঙ্খী। তাই সকলের কল্যাণচিন্তায় সেটিই এখন কর্তব্য। পিতামাতা গুণী সন্তানের জন্ম দিতে পারেন, কিন্তু সন্তানের পিতামাতার পুনরায় জন্ম হয় না। এইসব পরিতাপের কথাবার্তা চলতেই থাকল। কাতর বিলাপের বিরতি নেই। এই অবস্থায় বালক পুত্রটি হাসতে হাসতে একটি তৃণ হাতে নিয়ে, সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, অনেনাহং হনিষ্যামি রাক্ষসং পুরুষাদকম্। আমি এইটি দিয়ে নরখাদক রাক্ষসকে বধ করব। ঘোর দুঃখ সত্ত্বেও সকলে হেসে উঠলেন। পাণ্ডবমাতা কুন্তী বুঝলেন, প্রশ্ন করবার এটাই আদর্শ সময়। তিনি এগিয়ে গেলেন শোকার্ত পরিবারটির কাছে। অয়ং কাল ইতি জ্ঞাত্বা কুন্তী সমুপসৃত্য তান্। তাঁর উপস্থিতি যেন অমৃতবৎ প্রাণ সঞ্চার করল সেই পরিবারস্থ সকলের।

সহানুভূতিভরা কণ্ঠে,পাণ্ডবজননী বললেন, কুতো মূলমিদং দুঃখং জ্ঞাতুমিচ্ছামি তত্ত্বতঃ। বিদিত্বা ব্যপকর্ষেয়ং শক্যঞ্চেদপকর্ষিতুম্।। এত দুঃখের উৎস কী? আমি সমস্যার গোড়া থেকে গভীর পর্যন্ত জানতে ইচ্ছুক। সবটা জেনে, তবেই দুঃখ দূর করতে সক্ষম হব। ব্রাহ্মণকে নৈরাশ্য গ্রাস করেছে। হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। ভদ্রতার খাতিরে বললেন, আপনি তপস্বিনী। সত্যকথাই বলেছেন, তবে এ দুঃখ দূরীভূত করা, মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য। তবে সে কাজ সম্ভব বা অসম্ভব যাই হোক, দুঃখের কারণ সেই ঘটনাটি যথাযথ বলতে বাধা নেই। শক্যং বা যদি বা২শক্যং শৃণু ভদ্রে! যথাতথম্।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-১০০: সঠিক পদ্ধতি মেনে মাছচাষ করলে বিঘাপ্রতি ২০-২৫ হাজার চারাপোনাও পাওয়া সম্ভব

নগরের অদূরে বাস করে বক নামে এক বলশালী রাক্ষস। সে এই নগরেরতো বটেই, এই দেশেরও প্রভু। নরমাংস ভক্ষণে হৃষ্টপুষ্ট সেই দুর্বৃত্ত, দেববিরোধী, রাক্ষস সতত এই জনপদের রক্ষাকর্তা। সে নগরী ও দেশের রক্ষাকর্তা, তাই অন্য কোন রাষ্ট্র বা প্রাণী হতে ভয় নেই কোনও। পর্যাপ্ত শালীধানের দশ কুম্ভ পরিমাণ অন্ন, দুটি মহিষ এবং একটি পুরুষ রাক্ষসটির খাদ্য বা (দেশরক্ষাকার্যের) বেতনরূপে নির্দিষ্ট করেছেন স্বয়ং রাজা। একেক বার একেক জন পুরুষের পালা পড়ে। সেই পুরুষ, খাদ্য নিয়ে, উপস্থিত হয় রাক্ষসের কাছে। এর অন্যথা হলে, ওই পুরুষের সপরিবারে মৃত্যু নিশ্চিত। এর থেকে পরিত্রাণ নেই কারো।
বেত্রকীয় নামে রাজধানীতে আছেন দেশের রাজা। প্রজারক্ষার স্বার্থে সেই দুর্বলবুদ্ধি রাজার কোন নীতি নেই, যার মাধ্যমে প্রজারা চিরকালের জন্য, রাক্ষস হতে বিপদমুক্ত হতে পারে। তাই প্রজারা সকলেই রাজার শাসনাধীন রাজ্যে উদ্বিগ্ন, বিপন্ন জীবন যাপন করেন। অথচ ব্রাহ্মণদের সর্বদাই পক্ষীতুল্য জীবন। তাঁরা কারুর শাসনাধীন নন বরং স্বচ্ছন্দে চলাফেরাতেই তাঁরা অভ্যস্ত। অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা নিজেদের গুণগত মর্যাদাবলেই কোনও স্থানে, বসবাসে অভ্যস্ত, কারও আদেশানুসারে নয়। গৃহকর্তা ব্রাহ্মণ আরও জানালেন, মানুষ প্রথমে শাসনকর্তা রাজা, এর পরে স্ত্রী, সবশেষে অর্থকে আশ্রয় করে, জ্ঞাতি ও সন্তানদের বিপদ হতে উদ্ধার করে থাকেন।

ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে সবটাই প্রতিকূল। রাজ্যের রাজা দুর্বল, স্ত্রী তাঁর ইচ্ছাধীন নন, পর্যাপ্ত অর্থ তাঁর নেই। তাই আসন্ন বিপদের মুখোমুখি হয়ে, তাঁর দিশাহারা অবস্থা। আজ ব্রাহ্মণের পালা উপস্থিত। এ যেন তাঁর বংশনাশের পালা। সেই রাক্ষসের বেতনরূপে ভোজ্য এবং একটি পুরুষ নিয়ে, রাক্ষস বকের কাছে উপস্থিত হতে হবে ব্রাহ্মণকে। ধনাভাবহেতু রাক্ষসের ভোজ্যরূপে একজন পুরুষকে কিনে দিতে পারবেন না বা কোনও শুভাকাঙ্ক্ষীকেও এই কাজে দান করতে পারবেন না। তাই রাক্ষসের কবল থেকে তাঁর মুক্তি নেই। বিপদ উত্তরণে অক্ষম, ব্রাহ্মণ। এই কারণে, এই বিশাল বিষাদসাগরে নিমজ্জিত হয়েছেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-২০: মানকুমারী বসু—সাহিত্য জগতের উজ্জ্বল রত্ন!

ব্রাহ্মণ স্থির করেছেন, আজ সপরিবারে রাক্ষসের কাছে উপস্থিত হবেন। সেই নীচ রাক্ষস, পরিবারের সকলকে একসঙ্গে ভোজন করুক। সব শুনে, পাণ্ডবজননী অভয় দিলেন ব্রাহ্মণকে। রাক্ষস হতে পরিত্রাণের একটি উপায় আছে। পরিবারের কেউ রাক্ষসের কাছে যাবেন—এটি তাঁর অভিপ্রেত নয়। বরং কুন্তীর পাঁচ পুত্রের মধ্যে একজন, সেই রাক্ষসের উপহার নিয়ে যাবে সেখানে।ব্রাহ্মণের সম্মতি নেই। শুধু নিজেদের জীবনরক্ষার কারণে অতিথি ব্রাহ্মণের প্রাণ বিসর্জন? না, তিনি এ কাজ করবেন না। নাহমেতৎ করিষ্যামি জীবিতার্থী কথঞ্চন। অনভিজাত, অধার্মিক প্রজারা পর্যন্ত নিজের পুত্রকে বা নিজেকে, কোনও ব্রাহ্মণের স্বার্থে উৎসর্গ করেন না।
ব্রাহ্মণের বক্তব্য হয়তো, তাহলে তিনি এ কাজ করবেন কী করে? তাই আত্মহত্যাই শ্রেয়। তিনি স্বয়ং আত্মহত্যায় ইচ্ছুক নন। অপরের দ্বারা আত্মহননে কোনও পাপ নেই। না ত্বহং বধমাকাঙ্ক্ষে স্বয়মেবাত্মনঃ শুভে। পরৈঃ কৃতে বধে পাপং না কিঞ্চিন্ময়ি বিদ্যতে।। দুরভিসন্ধিমূলক, গৃহাশ্রিত ব্রাহ্মণবধ —পরিত্রাণলাভের উপায় নয়। সে বড়, নিষ্ঠুর ও নীচ কাজ। পণ্ডিতেরা, গৃহাশ্রিত শরণার্থীকে হত্যার উদ্দেশ্যে পরিত্যাগ এবং প্রার্থীবধ—নির্মম ও নিন্দিত বলে মনে করেন। বিপদকালে কর্তব্যবিষয়ে অভিজ্ঞ, প্রাচীন, মহান, ধার্মিক জনেরা বলেছেন, কোনও অবস্থাতেই নিন্দিত ও নিষ্ঠুর কাজ করা উচিত নয়। কুর্য্যান্ন নিন্দিতং কর্ম্ম ন নৃশংসং কথঞ্চন। ইতি পূর্ব্বে মহাত্মান আপদ্ধর্ম্মবিদো বিদুঃ।। সস্ত্রীক নিজের বিনাশ শ্রেয়। তিনি ব্রাহ্মণবধ অনুমোদন করেন না।

দেবী কুন্তীর যুক্তি, ব্রাহ্মণদের রক্ষাকরা অবশ্যকর্তব্য। তাঁর একশো পুত্র থাকলেও, কোনও পুত্র তাঁর কাছে অনাদরের নয়। অর্থাৎ অনাকাঙ্ক্ষিত পুত্রকে ব্রাহ্মণের রক্ষার্থে প্রেরণ করছেন, এমনটা নয়। কুন্তীপুত্র রাক্ষসের অবধ্য, সে শৌর্যবান, মন্ত্রসিদ্ধ ও তেজস্বী। দেবী কুন্তী নিশ্চিত, সে রাক্ষসের কাছে ভোজ্য পৌঁছিয়ে দেবে এবং রাক্ষসের কবল থেকে নিজেকেও মুক্ত করতে পারবে। রাক্ষসায় চ তৎ সর্ব্বং প্রাপয়িষ্যতি ভোজনম্। মোক্ষয়িষ্যতি চাত্মানমিতি মে নিশ্চিতা মতিঃ।।
আরও পড়ুন:

হে নূতন…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪২: শ্রীমার ভাইপো খুদি

কুন্তী জানালেন, অনেক বলবান, বিশালদেহী রাক্ষসরা তাঁর পুত্রটিকে প্রতিস্পর্ধা দেখিয়ে তাঁর সাথে মিলিত হয়েছে। তিনি স্বয়ং তাদের বধ প্রত্যক্ষ করেছেন। দেবী কুন্তী ব্রাহ্মণকে সতর্ক করে দিলেন, বিষয়টি যেন প্রকাশিত না হয়, কৌতূহলবশত কেউ এই মন্ত্র শিখে নিয়ে কুন্তীপুত্রদের প্রতারিত করতে পারে। গুরুর অনুমতি ছাড়া এই মন্ত্র কার্যকর হবে না। দেবী কুন্তীর অমৃততুল্য অভয়বাণীতে সস্ত্রীক সেই ব্রাহ্মণ আপ্লুত হলেন।তাঁকে বহু সম্মান প্রদর্শন করলেন। ব্রাহ্মণ ও মা কুন্তী দুজনে মিলে পবনপুত্র ভীমসেনকে অনুরোধ করলেন, কুরুষ্বেতি কাজটি কর।ভীম উত্তর দিলেন তথেতি তাই হবে।সম্মত হলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীমসেন। তিনি আবারও এক রাক্ষসের সম্মুখীন হবেন শীঘ্রই।

একটি সঙ্কট, বহুযুক্তি, অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা, বহু দার্শনিকতার জন্ম দেয়। প্রাচীন ভারতীয় সমাজে কন্যা সর্বদাই সম্প্রদানযোগ্যা। তাই হয়তো ব্রাহ্মণকন্যাটির অভিমত, সঙ্কটকালে, পরিবাররক্ষার্থে তাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়ায় বাধা নেই কোনও। সন্তানের ওপরে নির্ভরশীলতা ভারতীয় পরম্পরার একটি দিক। পুত্র নয়, কন্যাকে ত্যাগ করে পিতা দায়মুক্ত হন। থাবা পেতে বসে আছে রাক্ষস বক, তার ভোজ্যরূপে কন্যাটি নিজে উপস্থিত হতে চায়। খাদক বক হলেও, এ যেন সমাজপতিদের রক্তচক্ষুর দাপটের সামনে নতিস্বীকারের অঙ্গীকার। কন্যা, বংশের উদ্ধারকর্ত্রী হয়ে ওঠে আজও। কন্যাটির দীনতাবোধ যেন ভারতকন্যাদের চিরন্তন আর্তি।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

শরণাগত মানুষ একটু আশ্রয়প্রাপ্তির মধ্যে অপার শান্তি ও স্বস্তি খুঁজে পান। পাণ্ডবমাতা কুন্তী, কৃতজ্ঞতার ঋণমুক্ত হতে চেয়েছেন নিজের পুত্রের জীবনের বিনিময়ে।তিনি তাঁর পুত্রের অপরিসীম শক্তিমত্তার প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। নগরীর সুরক্ষা নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে, রাজা, রাক্ষসকে নরমাংস ভোজ্যরূপে পৌঁছে দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছেন। ব্রাহ্মণ জানিয়েছেন, নগরঞ্চৈব দেশঞ্চ রক্ষোবলসমন্বিতম্। তৎকৃতে পরচক্রাচ্চ ভূতেভ্যশ্চ ন নো ভয়ম্।। সেই রাক্ষস দেশ ও নগরের রক্ষাকর্তা। তাই অপর কোন রাষ্ট্র ও প্রাণী হতে তাঁদের কোনও ভয় নেই। রাক্ষস নিজেই একজন মূর্তিমান সন্ত্রাস, তাঁর হাত থেকে কোন প্রজার নিস্তার নেই। অন্যান্য ভোজ্যদ্রব্যের সঙ্গে প্রত্যহ নরমাংস রাক্ষস বকের ভোজ্য। সেটিও রাজা প্রত্যহ সরবরাহ করেন প্রজাদের একজনের প্রাণের বিনিময়ে।

জীবন অমূল্য, সেটি কোন বিনিময় মাধ্যম হতে পারে কী? রাষ্ট্রকে রক্ষা করে যে সে নগরবাসীদের একেকজনকে ভোজ্যরূপে গ্রহণ করে। যে রক্ষক সেই ভক্ষক। রাজা প্রজাসুরক্ষানীতি অনুসরণ করেন না। এই সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান হয়তো কোনও কালেই ছিল না। যিনি শাসক, তাঁর প্রধান কর্তব্য রাষ্ট্ররক্ষা তথা প্রজাদের জীবনরক্ষা। যে কোনও বিপদ থেকে প্রজাদের পরিত্রাণ, যে কোনও শাসকের লক্ষ্য হওয়াই বাঞ্ছনীয়। একটি জীবন বিসর্জন, অনেক প্রশ্ন রেখে যায়। পাণ্ডবদের আশ্রয়দাতা গৃহকর্তা ব্রাহ্মণ এবং পরিবারের পরিণত প্রত্যেক সদস্য তাঁদের জীবনের একাধারে নশ্বরতা এবং গুরুত্ব ব্যক্ত করেছেন। সেই সঙ্গে শরণাগত আশ্রিতকে রক্ষা করা যে একটি অন্যতম মানবিক কর্তব্য — সেই মহান উপদেশ স্মরণ করিয়ে দেয় এই ঘটনা। কোনও পরিস্থিতিতেই নৃশংস আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়, এমন কি বিপদের সম্মুখীন হয়েও নয়।এই মহাভারতীয় চিন্তা যেন চিরন্তন মনুষ্যত্ববোধের জয়গান। এই উদার মানবিকবোধের পরিপন্থী নিষ্ঠুরতা, শুধু এ যুগেই নয়, যুগে যুগেও কি নিন্দিত নয়?—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content