শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

রাজা দশরথের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। চতুর্দশ দিবসে রাজার কর্মসহায়ক মন্ত্রীরা সকলে মিলিত হয়ে ভরতকে বললেন, মন্ত্রীদের মাননীয় রাজা দশরথ। তাঁর গুরুত্ব গুরুর থেকেও বেশি। জ্যেষ্ঠ রাম ও মহাবীর লক্ষ্মণকে নির্বাসিত করে, রাজা আজ প্রয়াত হয়েছেন। নেতৃত্বহীন রাজ্যে কোন অপরাধমূলক কাজ এ পর্যন্ত ঘটেনি। হে মহাযশস্বি রাজনন্দন, আপনি আমাদের রাজা হন। ত্বমদ্য ভব নো রাজা রাজপুত্র মহাযশঃ। সঙ্গত্যা নাপরাধ্নোতি রাজ্যমেতদনায়কম্।। অমাত্যরা, রঘুবংশীয় ভরতকে জানালেন, স্বজনবর্গ ও প্রজাপুঞ্জ অভিষেকের উপাচার নিয়ে অপেক্ষমান। ভরত, পিতৃপিতামহের চিরন্তন এই রাজ্য গ্রহণ করুন এবং রাজ্যে অভিষিক্ত হয়ে সকলের রক্ষক হন। দৃঢ়সঙ্কল্প ভরত, অভিষেকদ্রব্যে পরিপূর্ণ পাত্রগুলি প্রদক্ষিণ করে, উপস্থিত জনসমক্ষে প্রত্যুত্তর দিলেন, আমাদের বংশের রীতিই হল আবশ্যিকভাবে জ্যেষ্ঠর রাজ্যাধিকার। তাই আপনাদের মতো অভিজ্ঞদের এমন কথা বলা উচিত নয়। জ্যেষ্ঠস্য রাজতা নিত্যমুচিতা হি কুলস্য নঃ। নৈবং ভবন্তো মাং বক্তুমর্হন্তি কুশলা জনাঃ।।

ভরত বললেন, তাঁদের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হলেন রাম, তিনিই হবেন রাজা। ভরত চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে বাস করবেন। চতুরঙ্গ মহাসৈন্যদল প্রস্তুত করা হোক। ভরত, জ্যেষ্ঠকে অরণ্য থেকে ফিরিয়ে আনবেন। তিনি স্থির করলেন, অভিষেকের উপকরণসমূহ নিয়ে ভরত নিজে যাবেন বনে, সেখানে পুরুষব্যাঘ্র রামকে অভিষিক্ত করে, যজ্ঞ থেকে সংগৃহীত অগ্নিতুল্য রামকে সামনে রেখে ফিরে আসবেন। পুত্রের প্রতি পক্ষপাতিত্বপূর্ণা মায়ের মনোবাসনা পূর্ণ করবেন না। দুর্গম অরণ্যবাস ভরতের অভীপ্সিত, রাজা হবেন রাম। ভরত আদেশ দিলেন, শিল্পীরা উঁচু নীচু পথ সমান করুন, দুর্গম পথে অনায়াসে বিচরণকারী রক্ষীরা তাঁদের অনুসরণ করুন। রামের সপক্ষে, রাজপুত্র ভরতের এমন ঘোষণা শুনে, উপস্থিত জনগণ, সুন্দর, মঙ্গলকর বাক্যে প্রত্যুত্তর দিলেন, জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র রামকে আপনার রাজ্যদানের এই অভিপ্রায়হেতু, কমলাসনা লক্ষ্মী আপনাকে আশ্রয় করুন। এবং তে ভাষমাণস্য পদ্মা শ্রীরুপতিষ্ঠতাম্। যস্ত্বং জ্যেষ্ঠে নৃপসুতে পৃথিবীং দাতুমিচ্ছসি।।
রাজনন্দন ভরতের কথা শুনে আর্যজনমণ্ডলীর হর্ষোৎফুল্ল চোখ থেকে আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়ল। ভরতের আদেশ শুনে, অমাত্য ও পরিষদবর্গ, বীতশোক হলেন। সন্তুষ্ট মনে, তাঁরা বললেন, হে নরশ্রেষ্ঠ, আপনার আদেশ অনুসারে শিল্পীবৃন্দ ও অনুগত জনকে, পথ প্রস্তুত করতে আদেশ দেওয়া হল। পন্থানং নরবর ভক্তিমান্ জনশ্চ। ব্যাদিষ্টস্তব বচনাচ্চ শিল্পিবর্গঃ।। অতঃপর ভূতত্ত্ববিদ, সূত্র দিয়ে কাজে (জমির পরিমাপ) দক্ষ মানুষ, নিজ কর্মে (খননকাজে) কুশল সাহসী খনক, যন্ত্রচালনায় নিপুণ কর্মী, শ্রমিক, স্থপিতি, যন্ত্রবিদ্যাবিদ, পথনির্মাণকুশল জন, বৃক্ষচ্ছেদক, পাচক, সুধাকার, বাঁশ ও চামড়া ছেদক সমর্থ পুরুষদের, সামনে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন পথপ্রদর্শকগণ। প্রস্থানরত আনন্দোৎফুল্ল বিশাল জনতা যেন পর্বকালীন সমুদ্রের মহাবেগের মতো প্রতীয়মান হলেন। সেই পথনির্মাণে দক্ষ জনেরা ক্রমানুযায়ী নিজ নিজ উপকরণ নিয়ে, সম্মুখে অগ্রসর হলেন। তাঁরা লতা, বল্লী, গুল্ম, স্থাণু, পাষাণ সবকিছু ছেদন করতে করতে পথ প্রস্তুত করতে লাগলেন। যে জায়গাগুলি তরুহীন সেখানে কেউ কেউ বৃক্ষ রোপণ করলেন, কেউ আবার কুঠার, টঙ্ক, দাত্র দিয়ে ছেদন কাজ করতে লাগলেন।

অন্য সব অধিকতর বলশালীরা, বীরণ-স্তম্বগুলি উপড়ে ফেলে অসমান দুর্গম জায়গাগুলি গমনোপযোগী করে তুললেন। আরও অনেকে, চারিদিকের কুয়ো, প্রশস্ত গর্তগুলি, নীচু জমিগুলি সব, পাংশুরাশি দিয়ে ভরাট করে তুললেন। মানুষগুলি যেখানে বন্ধন প্রয়োজন সেখানটি বেঁধে দিলেন, খননযোগ্য স্থান খুঁড়ে ফেললেন, যে স্থানটি ভেদ করা আবশ্যক সেই স্থানটি ভেদ করলেন। অচিরেই বহু জল বিশিষ্ট সাগরতুল্য বিবিধ আকারের অনেক জলাশয় প্রস্তুত হল। নির্জলস্থানে বেদীযুক্ত বহু উত্তম হ্রদ খনন করা হল। সুধাধবল কুটির ও কুসুমিতবিশাল তরুরাজি সমন্বিত, তরুশাখায় কলতানমুখর বিহঙ্গবিশিষ্ট, পথটি ছিল পতাকাশোভিত, চন্দন জলে সিক্ত, নানা পুষ্পবিভূষিত। বহু সেনার গমনোপযোগী পথটি যেন দেবলোকের পথ হয়ে উঠল।

আদেশানুসারে আজ্ঞাপ্রাপ্ত কর্মীরা বহু সুস্বাদু ফল যেখানে সহজলভ্য, এমন মনোরম স্থানে ভরতের অভীপ্সিত আবাস নির্মাণ করলেন এবং পুনরায় ভূষণ দিয়ে সজ্জিত করলেন যেন সেগুলি পথের অলঙ্কার হয়ে উঠল। নক্ষত্রের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে যাঁদের জ্ঞান আছে এমন নক্ষত্রবিদেরা শুভ মুহূর্ত গণনা করে, মহান ভরতের শিবিরগুলি প্রতিষ্ঠা করলেন। শিবিরগুলি চতুর্দিকে বহু পরিখা সমন্বিত ও প্রাকারবেষ্টিত। পথগুলি নীলকান্তমণিসদৃশ উজ্জ্বল। মিনারের চূড়াগুলি ছিল প্রাচীরের আস্তরণ দ্বারা সুরক্ষিত, সৌধগুলি ছিল পতাকা শোভিত, অভ্যন্তরে সুনির্মিত প্রশস্ত পথসমূহ, বহুতল প্রাসাদগুলির উঁচু তলায় পায়রার খোপ সেখানে শূন্য ভ্রমে ইতস্তত উড়ন্ত পায়রা, সবমিলিয়ে শিবিরগুলি যেন ইন্দ্রালয়ের শোভা ধারণ করেছে। ক্রমশ তীরবর্তী তরুকাননপ্রাচুর্যে ভরা রাজপথ, প্রসারিত হল গঙ্গা অবধি, যে জাহ্নবীর জল নির্মল, শীতল এবং মীনসঙ্কুল। উত্তম শিল্পীদের নির্মিত সেই সুন্দর সুপরিষ্কৃত রাজপথটি যেন রজনীতে চন্দ্রতারকাখচিত নির্মল গগনমণ্ডলের মতো ঔজ্জ্বল্যে শোভা বিস্তার করল।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯৩: পাণ্ডবদের ওপরে আধিপত্যবিস্তারের পক্ষে বিরুদ্ধবাদীর অভিমত ও তার প্রাসঙ্গিকতা

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৯: সুন্দরবনের পাখি: টুনটুনি

অবশেষে পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হবে নান্দীমুখ, তার পূর্বরাত্রি প্রায় শেষ হয়ে এল। স্তুতিপাঠক সূত ও মাগধেরা মঙ্গলময় স্তব পাঠ করে ভরতের স্তুতি-গীতি শুরু করলেন। প্রহর-নির্দেশসূচক স্বর্ণমণ্ডিত কোণের মাধ্যমে বেজে উঠল দুন্দুভি। শত শত শঙ্খ ও উচ্চ সুগভীর বাদ্য ধ্বনিত হল। তূর্যনির্ঘোষ সমস্ত গগনমণ্ডল নিনাদিত করে, শোকার্ত ভরতকে আরও শোকাচ্ছন্ন করে তুলল। ভরত জেগে উঠলেন। তিনি সেই শব্দ নির্ঘোষ বন্ধ করে, বলে উঠলেন, নাহং রাজেতি আমি রাজা নই। শত্রুঘ্নকে বললেন,দেবী কৈকেয়ী লোকের কি মহা অপকার করেছেন, দেখ। রাজা দশরথ আমার ওপরে দুঃখভার ন্যস্ত করে চলে গেলেন স্বর্গে। পশ্য শত্রুঘ্ন কৈকেয্যা লোকস্যাপকৃতং মহৎ। বিসৃজ্য ময়ি দুঃখানি রাজা দশরথো গতঃ।। ইতস্তত জলে ভাসমান কর্ণধারহীন তরণীর অবস্থায় উপনীত হয়েছে ধার্মিক রাজার ধর্মমূলক রাজ্যলক্ষ্মী। যিনি ছিলেন মহান রক্ষক প্রভু, তিনিও ধর্মবিরুদ্ধ উপায়ে ভরতের মায়ের দ্বারা নির্বাসিত হয়েছেন বনে। বিলাপরত ভরত চেতনাহীন হলেন। এমন অবস্থায় তাঁকে দেখে, দুঃখার্ত মহিলারা উচ্চকণ্ঠে কেঁদে উঠলেন। ভরত ক্রন্দনরত, এমন সময়ে, রাজনীতিবিদ বশিষ্ঠ, ইক্ষ্বাকুরাজসভায় প্রবেশ করলেন। ধর্মাত্মা পুরোহিত, সশিষ্য, সেই সুবর্ণকুম্ভ ও মণিহেমমণ্ডিত মনোরম সভায় উপস্থিত হলেন। সর্ববেদবিদ বশিষ্ঠ, শুভ আবরণে আচ্ছাদিত কাঞ্চনময় পীঠে আসন গ্রহণ করে, দূতদের আদেশ দিলেন। দ্রুত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, অমাত্য, যোদ্ধা, অমাত্য, সেনানায়কদের আনয়ন করা হোক। আমাদের আসন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাগত প্রায়। ব্রাহ্মণান্ ক্ষত্রিয়ান্ যোধানমাত্যান্ গণবল্লভান্। ক্ষিপ্রমানয়ত ব্যগ্রাঃ কৃত্যমাত্যয়িকং হি নঃ।। রাজপুত্র মহাযশস্বী ভরত, শত্রুঘ্নতো আছেনই, যুধাজিৎ, সুমন্ত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে আসা হোক। রথে, ঘোড়ায়, হাতিতে চড়ে বহু ব্যক্তি উপস্থিত হলেন।তুমুল কোলাহল শুরু হল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯৪: পরবর্তী পদক্ষেপ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০৪: আশ্রমের আনন্দময় পিকনিক

অবশেষে এলেন ভরত। যেমন ইন্দ্রকে স্বাগত জানান দেবতারা ঠিক তেমনভাবেই,ভরতকে রাজা দশরথের মতোই অভিনন্দিত করলেন প্রজাবৃন্দ। দশরথপুত্র, ভরত, সভা অলঙ্কৃত করলেন। তিমি-নাগ প্রভৃতিতে পরিপূর্ণ, মণি-শঙ্খ-শর্কর সমাকীর্ণ সংক্ষোভহীন জলবিশিষ্ট শান্ত সমুদ্রের মতো প্রতীয়মান যেন সেই পূর্বের সভা,ভরত যেন স্বয়ং দশরথ, তিনিই এখন সভার শোভা।

ভরত দেখলেন, আর্যগণপরিপূর্ণ সভা যেন চন্দ্রশোভিত রাত্রির শোভা ধারণ করেছে। বসনভূষণে সজ্জিত সভাসীন আর্য জনগণ, সব মিলিয়ে উত্তম সভা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই মনোহর সভায় বিদ্বজ্জনের উপস্থিতি সম্পূর্ণতা এনে দিল, শরতকালীন চন্দ্রালোকিত রাত্রির মতোই সভার সৌন্দর্য দৃশ্যমান হল। রাজার সাধারণ প্রজাবৃন্দ নিরীক্ষণ করে, রাজপুরোহিত ভরতকে মৃদুস্বরে বললেন, বাছা, ধার্মিক রাজা দশরথ, ধনধান্যে সমৃদ্ধ এই পৃথিবী তোমায় প্রদান করে, পরলোকগমন করেছেন। তাত রাজা দশরথঃ স্বর্গতো ধর্ম্মমাচরন্। ধনধান্যবতীং স্ফীতাং প্রদায় পৃথিবীং তব।। যেমন উদীয়মান চন্দ্র জ্যোৎস্নালোক পরিহার করে না, তেমনই ধর্মনিষ্ঠ রাম, সজ্জনদের ধর্ম অনুসরণ করে, পিতার আদেশ অমান্য করেননি।। পিতা ও ভ্রাতা যে নিষ্কণ্টক রাজ্য দান করেছেন, ভরত যেন সন্তুষ্ট মন্ত্রীদের সহায়তায় সেই রাজ্য উপভোগ করেন, সত্বর তিনি যেন নিজে অভিষিক্ত হন। উত্তর, পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দেশীয় বণিকেরা ভরতকে কোটি কোটি সামুদ্রিক রত্ন উপহার প্রদান করুন। এমন কথা শুনে, ধর্মবিদ ভরত শোকাভিভূত হলেন। তিনি ধর্মলাভের আশায় রামকে স্মরণ করলেন। কলহংসের মতো যাঁর কণ্ঠস্বর, সেই ভরত, সভামধ্যে অশ্রুভারাক্রান্ত স্বরে, পুরোহিতের নিন্দায়,সোচ্চারে বিলাপ করতে লাগলেন। ব্রহ্মচর্য আশ্রমধর্ম পালন করে যিনি কৃতবিদ্য, ধীমান, ধর্মে নিরত, সেই রামের রাজ্য আমার মতো কে হরণ করতে পারে? চরিতব্রহ্মচর্য্যস্য বিদ্যাস্নাতস্য ধীমতঃ। ধর্মে প্রযতমানস্য কো রাজ্যং মদ্বিধো হরেৎ।।
আরও পড়ুন:

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

গল্পবৃক্ষ, পর্ব-১১: কাঁটার মুকুট

দশরথের আত্মজ হয়ে ভরত কী রাজ্য হরণ করতে পারেন? একাধারে আমি এবং এই রাজত্ব উভয়ই রামের অধীন, এমন ধর্মসঙ্গত উপদেশ দান করাই কর্তব্য। রাজ্যঞ্চাহঞ্চ রামস্য ধর্ম্মং বক্তুমিহার্হসি। রাজা দিলীপ ও নহুষের সদৃশ ধর্মজ্ঞ, জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ,রাম। রাজা দশরথ যেমন রাজ্যলাভের যোগ্য ছিলেন তেমন রামও উপযুক্ত রাজ্যাধিকারী। অনার্যদের ধর্ম অনুসরণ করে, ভরত যদি এই পাপাচরণ করেন,তবে তাঁর স্বর্গলাভ আর হবে না, তিনি ইক্ষ্বাকুকুলের কলঙ্ক হয়েই রইবেন। মায়ের পাপকাজ ভরত সমর্থন করেন না। তিনি এখান থেকেই বনদুর্গাশ্রিত রামকে প্রণতি নিবেদন করছেন। তিনি রামের অনুগমন করবেন। রাম পুরুষশ্রেষ্ঠ, তিনি ত্রিলোকের যোগ্য রাজ্যাধিকারী। ভরতের ধর্মসঙ্গত বচন শুনে, রামনামে তদ্গতচিত্ত, সভাসদগণ আনন্দোচ্ছ্বাসে অশ্রুবিসর্জন করতে লাগলেন। ভরত ঘোষণা করলেন,আর্য রামকে যদি তিনি ফিরিয়ে আনতে অসমর্থ হন তবে তিনি লক্ষ্মণের মতো সেই বনেই বাস করবেন। যদি ত্বার্য্যং না শক্ষ্যামি বিনিবর্ত্তয়িতুং বনাৎ। বনে তত্রৈব বৎস্যামি যথার্য্যো লক্ষ্মণস্তথা।। ভরত জানালেন, তিনি সৎস্বভাব, সর্বোত্তম আর্য গুণীজনের পরামর্শ অনুযায়ী রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনবার বিবিধ উপায় অবলম্বন করবেন। তিনি ইতিমধ্যেই, যাঁরা পথনির্মাণকর্মে দক্ষ, তেমন বেতনভোগী শ্রমিক, পাঠিয়েছিলেন। তাই ভরত এখনই যাত্রা করতে ইচ্ছুক। ধর্মপ্রাণ, ভ্রাতৃবৎসল ভরত এমন ঘোষণা করে, মন্ত্রণায় নিপুণ সুমন্ত্রকে বললেন, সুমন্ত্র যেন ভরতের আদেশ অনুসারে সকলকে যাত্রা সম্বন্ধে সত্বর অবহিত করেন, সেই অনুযায়ী সৈন্যদল প্রস্তুত হোক। সুমন্ত্র আনন্দিত মনে সকলকে, ভরতের আদেশটি যথাযথ জানালেন। রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনা হবে—এই বার্তা শুনে প্রজাপুঞ্জ ও সেনাধ্যক্ষ, সকলে আনন্দিত হলেন। যোদ্ধাদের স্ত্রীরা, আনন্দসহকারে, ভরতের সহযাত্রী হওয়ার জন্যে, স্বামীদের তাড়া দিতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব ৪২: রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারত ভাস্কর’ উপাধি দিয়েছিলেন রাজা বীরবিক্রম কিশোর

সপত্নীক সৈন্যাধ্যক্ষরা অশ্ব, গোযান, মনের তুল্য বেগবান রথে সৈন্যবল চালিত করলেন। সজ্জিত সৈন্যবল দেখে, ভরত গুরুর সমীপস্থ সুমন্ত্রকে বললেন, রথং মে তরয়স্বেতি দ্রুত, আমার রথ আনয়ন কর। আনন্দসহকারে, সুমন্ত্র সঙ্গে সঙ্গে আদেশ পালন করলেন। খুশিমনে তিনি উত্তম অশ্বযুক্ত রথ নিয়ে নিকটে উপস্থিত হলেন। সত্যনিষ্ঠ ধৈর্যশীল, শৌর্যবান, দৃঢ় যাঁর সত্যবিষয়ক পরাক্রম, সেই রঘুবংশীয় ভরত, মহারণ্যগত যশস্বী গুরু রামের প্রসন্নতাবিধায়ক যুক্তিযুক্ত বাক্য বললেন। সুমন্ত্র, তুমি সত্বর উদ্যোগ নিয়ে, সৈন্যাধ্যক্ষকে সৈন্যবল প্রস্তুতির জন্যে, বল। জগতের কল্যাণের নিমিত্তে আমি বনবাসী রামকে প্রসন্ন করে, ফিরিয়ে আনতে চাই। তূর্ণং ত্বমুত্থায় সুমন্ত্র গচ্ছ বলস্য যোগায় বলপ্রধানম্। আনেতুমিচ্ছামি হি ত্বং বনস্থং প্রসাদ্য রামং জাগতো ফিতায়।। সূতপুত্র সুমন্ত্র, ভরতের আজ্ঞা পালন করে, পূর্ণমনস্কাম হয়ে, প্রধান প্রধান প্রকৃতি, সৈন্যদলের প্রধান, শুভাকাঙ্ক্ষীদের সেই আদেশ জানালেন। খবর ছড়িয়ে পড়ল কুলে কুলে। ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র, ব্রাহ্মণ নির্বিশেষে সকলে, উট, রথ, খর, হাতি, বিশ্বস্ত প্রজাতির ঘোড়া, সবকিছু সজ্জিত করলেন।

রাজাবিহীন অযোধ্যার অস্তিত্ব সঙ্কটাপন্ন। এই অবস্থায় একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার প্রস্তাব এককথায় নাকচ করলেন দশরথপুত্র সিংহাসনের বৈধ দাবীদার ভরত। ভরতের উত্তরাধিকার বিষয়ে সহমত ছিলেন মন্ত্রীবর্গ ও রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ। প্রজাদের অসম্মতি ছিল না। ভরত পরম্পরাগত ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী। যে কোনও উত্তরাধিকারনির্ণয়ে, উপযুক্ত জ্যেষ্ঠর দাবি চিরকালই অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। রাজত্বের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নেই। তাই সর্বগুণের আকর রামচন্দ্র অযোধ্যার সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী। ভরত মনস্থ করলেন রামকে ফিরিয়ে আনবেন। রাজপথ নির্মাণের নির্দেশ দিলেন সেই পথেই যে পথ ধরে চলে গেছেন উদাসী বিবাগী রামচন্দ্র। রামের গমনপথটি ছিল বন্ধুর। ভরত, ফিরিয়ে আনতে চলেছেন রাজপদে অভিষিক্ত অযোধ্যাপতি রামকে।তাই হয়তো এই রাজকীয় মার্গের বিনির্মাণের উদ্যোগ। ভরতের এই সিদ্ধান্তে, জনগণ প্রসন্ন ও আনন্দিত হয়েছেন। রাজপরিষদবর্গ,অমাত্যগণ, পুরবাসী আর্য জনতা, সকলে যেন সব হারানোর শোক বিস্মৃত হলেন। ভরত তাঁদের বিক্ষুব্ধ মনে সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে পারলেন। ভাবি রাজার আদেশ পালন মাত্র নয়, পথনির্মাণে তাঁদের আন্তরিকতা প্রকাশ, যেন কৃতজ্ঞতার নিরুচ্চার ভাষা হয়ে উঠল। নিজেদের প্রিয় জননায়ক রাঘব রামের প্রত্যাবর্তনের আশায় কী এই পথনির্মাণের উদ্যোগ নয়?

ছবি: প্রতীকী।

পারিবারিক বৃত্তে বা আরও বৃহৎ রাষ্ট্রীয় পরিসরে এক একজন থাকেন যাঁরা নিজের প্রাপ্যের সীমা অতিক্রম করেন না। জ্যেষ্ঠর প্রাপ্য রাজত্ব, তা কোনওমতেই তাঁর নিজের নয়, এই ভাবধারায় বিশ্বাসী ভরত, সেই বিরল প্রজাতির একজন। অযাচিত কিন্তু ন্যায়সঙ্গত প্রাপ্তিতে অযথা আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠেন না। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যানেই তাঁর যত আত্মতুষ্টি। তাই সূতমাগধের স্তুতি গীতি তাঁকে শোকাহত করে তোলে, এই রাজত্ব যে তাঁর নয়, তাই এই মঙ্গলময় স্তুতিগীতির যোগ্য তিনি নন। ধার্মিকরাজা নির্বাসিত হয়েছেন বনে। রাজপূরোহিত বশিষ্ঠ নিষ্ঠাভরে বিদ্বজ্জন ও হিতৈষীদের উপস্থিতিতে ভরতের অভিষেক সম্পন্ন করতে চেয়েছেন। তিনি অযোধ্যার রাজপরিবার তথা প্রজাবর্গকে নিশ্চিন্ত করতে, প্রয়াত রাজা দশরথের মনোনীত একজন সুশাসককে, রাজসিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। পুরোহিত বশিষ্ঠ, ভরতের অনুরাগী হলেও, পিতার আদেশ পালনকারী সজ্জন রামের প্রতিও তিনি গভীর শ্রদ্ধাশীল।

ভরত পুরোহিতের এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন শুধু নয়, তিনি তাঁর ক্লাস বা শ্রেণি চিনিয়েছেন। ধার্মিক পরম্পরার অধিকারী ভরত অধর্মাচরণ করতে পারেননি। প্রকৃত রাজ্যাধিকারী রাম। তাঁর রাজত্ব ভরত গ্রহণ করলে, অপহরণজনিত চৌর্যবৃত্তির পাপ তাঁর বংশকে কলঙ্কিত করবে। তাই রামকে ফিরিয়ে আনতে তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শুভ উদ্যোগে সামিল হয়েছেন, সামরিক বাহিনী,বর্ণ নির্বিশেষে সব প্রজাবৃন্দ।ভরতের মতো আত্মত্যাগী, লালসাজয়ী, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিত্ব যেমন সংসারে তেমনই রাজনীতির পরিসরে বিরল। ভরতের মতো ব্যক্তি পারিবারিক জীবনে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হন,রেখে যান পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে, মূল্যবোধের লিগাসি বা উত্তরাধিকার। যেটি অন্যের, তাতে অধিকারবোধ নয়, নিস্পৃহ ঔদাসীন্যে বর্জনই কাম্য। যোগ্যতমকে স্থান ছেড়ে দিতে হয়, তাঁর মধ্যে আছে মহত্ত্ব ও ঔদার্য,সেটি পারিবারিক জীবনেই হোক বা রাজনীতির বৃহত্তর পরিসরেই হোক। সবাই ভরত হতে পারেন না। ভরতরা চিরকালই নিজেদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও ঔদার্যের বিভায় আলোকিত, অনন্য।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content