বৃহস্পতিবার ৫ ডিসেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পিতার মৃত্যু ও জ্যেষ্ঠ রাম ও সীতা, লক্ষ্মণের বনবাস এবং তার কারণ জেনে, কৈকেয়ীপুত্র ভরত, শোকে বিধ্বস্ত ও উত্তেজিত হলেন। বাগ্বিশারদ, ঋষি বশিষ্ঠ ভরতকে সান্ত্বনা দিলেন। হে রাজপুত্র মহাযশস্বি ভরত, শোকার্ত হয়ো না। সময় হয়েছে। নৃপতি দশরথের পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন কর। অলং শোকেন ভদ্রং তে রাজপুত্র মহাযশঃ। প্রাপ্তকালং নরপতে কুরু সংযানমুত্তমম্।। ঋষির কথাশুনে, ভূলুণ্ঠিত ভরত, রাজার শেষকৃত্য সম্পন্ন করতে ব্যবস্থা নিলেন। তেলপূর্ণ কাঠের পাত্রে সংরক্ষিত প্রয়াত রাজার শবদেহ, ভূমিতে শায়িত হল। রাজার মুখমণ্ডল পীতবর্ণ, রাজা যেন ঘুমিয়ে আছেন। নানা রত্ন বিভূষিত বিচিত্র শয্যায় শায়িত হল মৃতদেহ। গভীর দুঃখে, কুমার ভরত কেঁদে উঠলেন। হে মহারাজ, কেন আপনার এমন মতি হল? আমার অনুপস্থিতিতে, ধার্মিক রাম ও মহাবীর লক্ষ্মণকে নির্বাসিত করলেন আপনি, সেই পুরুষসিংহ রাম, যিনি কাউকে কষ্ট দেননি,তাঁর অভাবে,আমার মতো দুঃখীকে ছেড়ে কোথায় চলেছেন আপনি? কিং তে ব্যবসিতং রাজন্ প্রোষিতে ময্যনাগতে। বিবাস্য রামং ধর্ম্মজ্ঞং লক্ষ্মণঞ্চ মহাবলম্।। ক্ব যাস্যসি মহারাজ হিত্বেমং দুঃখিতং জনম্। হীনং পুরুষসিংহেন রামেণাক্লিষ্টকর্মণা।।

ভরত চিন্তান্বিত হলেন, পিতা প্রয়াত, রামও বনবাসী,এখন কে উৎসুকভাবে প্রজাদের যোগ (অলব্ধ বস্তুর লাভ) ও ক্ষেমের (লব্ধ বস্তুর রক্ষণ) ব্যবস্থাপনায় থাকবেন? আর এখন যেন পৃথিবীর বৈধব্যদশা, রাজাহীন রাজ্য নিষ্প্রাণ হয়েছে। এই নগরী চাঁদহীন আকাশতুল্য প্রতিভাত হচ্ছে। এমন অনেক দুশ্চিন্তায় আক্রান্ত ভেঙ্গে পড়া, শোকাতুর, ভরতকে, মহামুনি বশিষ্ঠ বললেন, মহাভুজ ভরত,তাঁর কর্তব্য, পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ যা কিছু আছে, কোনও রকম বিচার না করে, সেগুলি তিনি যেন সম্পন্ন করেন। তথাস্তু তাই হোক বলে ভরত, ঋত্বিক্, পুরোহিত, আচার্য্যগণকে তাড়া দিলেন। রাজার অগ্নিগৃহ হতে যে সব অগ্নি বহিষ্কৃত হয়েছিল, ঋত্বিক্ ও যাজকবৃন্দ সেগুলিতে হবন শুরু করলেন। বিমনা, রুদ্ধকণ্ঠ, পরিচারকেরা নিষ্প্রাণ রাজাকে শিবিকায় স্থাপন করলেন। জনগণ, মৃতদেহের সম্মুখে চন্দন, অগরু, সোনা, বিবিধ বসন, দেবদারু কাঠ প্রভৃতি রাজপথে বিতরণ করতে করতে চলতে লাগলেন। কেউ কেউ চন্দন অগরু,বিবিধ নির্যাস, সরল পদ্ম দেবদারু কাঠ প্রভৃতি নিক্ষেপ করলেন।
অতঃপর ঋত্বিকগণ রাজার শবদেহ চিতায় স্থাপন করলেন। তাঁরা, অগ্নিতে আহুতি দিয়ে মন্ত্র জপ করতে লাগলেন। সামবেদজ্ঞ ব্রাহ্মণরা যথাশাস্ত্র সামগান শুরু করলেন। মহিলারা, বৃদ্ধগণ পরিবেষ্টিত হয়ে, শিবিকায় ও অন্যান্য বাহনে আরোহণ করে পুরী হতে নির্গত হলেন। ঋত্বিক্-গণ ও কৌশল্যা প্রমুখ শোকসন্তপ্ত স্ত্রীরা অগ্নিপরিবেষ্টিত রাজাকে প্রদক্ষিণ করলেন। যেন শত শত ক্রৌঞ্চীদের করুণ আর্তচিৎকারতুল্য, শোকার্তা মহিলাদের, করুণ ক্রন্দনধ্বনি, শ্রুত হতে লাগল। বিবশা রাজাঙ্গনারা কাঁদতে কাঁদতে সরযূতীরে নিজ নিজ যান থেকে অবতরণ করলেন। রাজপরিবারস্থ মহিলারা, মন্ত্রীপুরোহিতসহ ভরতের সঙ্গে, একযোগে উদকাঞ্জলিরূপ ক্রিয়া সম্পন্ন করে, রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন। তাঁরা, অশ্রুপরিপূর্ণনয়নে ভূতলে শয়ন করে, অতিদুঃখে দশ দিন অতিবাহিত করলেন।

ক্রমে ক্রমে দশদিন অতিক্রান্ত হল। অশৌচান্তে দ্বাদশ দিনে, রাজপুত্র ভরত, শ্রাদ্ধকাজ সম্পন্ন করলেন। শ্রাদ্ধোপলক্ষ্যে তিনি, ব্রাহ্মণদের ধন-রত্ন, প্রভূত অন্ন, প্রচুর শুক্ল বসন, অগণিত গাভী, দাস-দাসী, যান-বাহন, অনেক বিশাল গৃহ, দান করলেন। ত্রয়োদশ দিবসে, প্রভাতবেলায়, শোকে মূর্ছিতপ্রায়, মহাবাহু ভরত, বিলাপ করতে লাগলেন। শোধনার্থে চিতায় সমীপবর্তী হয়ে, অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে অতিদুঃখে তিনি বলে উঠলেন, পিতা, আপনি যে রাঘব ভ্রাতার কাছে আমায় রেখে গেলেন, তিনি আজ বনবাসী, এই শূন্যে পরিত্যক্ত হলাম আমি। তাত যস্মিন্ নিসৃষ্টোঽহং ত্বয়া ভ্রাতরি রাঘবে। তস্মিন্ বনং প্রব্রজিতে শূন্যে ত্যক্তোঽস্ম্যহং ত্বয়া।। যে অনাথার একমাত্র গতি, তাঁর পুত্র, তিনি আজ অরণ্যে প্রস্থান করেছেন। সেই জননী কৌশল্যাকে পরিত্যাগ করে, পিতা, আপনি কোথায় গেলেন? যস্যা গতিরনাথায়াঃ পুত্রঃ প্রব্রাজিতো বনম্। তামম্বাং তাত কৌসল্যাং তক্ত্বা ত্বং ক্ব মতো নৃপ।।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৯১: একটি বিবাহের শুভ ও অশুভ প্রতিক্রিয়া

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০২: দ্বারকানাথের বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি

দগ্ধাবশিষ্ট অস্থিভস্মে অরুণ বর্ণ হয়েছে পিতার চিতা,এই দৃশ্য দেখে বিষাদমগ্ন হলেন, ভরত। দীনভাবে রোদনকারী ভরত, যেন যন্ত্রচ্যুত ইন্দ্রধ্বজতুল্য হয়ে, ভূমিতে লুণ্ঠিত হলেন। অন্তিমকালে অধঃপতিত যযাতির কাছে সমবেত ঋষিদের মতো, শুদ্ধব্রত ভরতের অমাত্যগণ, তাঁর কাছে উপস্থিত হলেন। কুমার শত্রুঘ্নও শোকাতুর ভরতকে দেখে,রাজাকে স্মরণ করে, সংজ্ঞাহীন অবস্থায় ভূপতিত হলেন। পিতার গুণাবলী স্মরণ করে উন্মত্তের মতো, বিমনা শত্রুঘ্ন, দুঃসহ দুঃখে, বিলাপ করতে লাগলেন। মন্থরা হতে যার তীব্র উৎপত্তি,কৈকেয়ী যার গ্রাহতে সমাচ্ছন্ন, সেই বরদানরূপ অতল শোকসাগরে তিনি নিমজ্জিত হয়েছেন। শৈশবে সতত লালিত সুকুমার ভরত, তিনি বিলাপরত। তাঁকে ছেড়ে কোথায় গেলেন পিতা? ভোজ্য, পানীয়, বসন, ভূষণে দিয়ে পুত্রদের সকল কামনা পূর্ণ করতেন যিনি, তাঁর অনুপস্থিতিতে কে আর এ কাজ করবে? এমন ধর্মাত্মা মহান রাজার বিহনে পৃথিবী বিদীর্ণ হল না, কেন? শ্রদ্ধাশীল পুত্রের অনুভব, পিতা স্বর্গলোকে গমন করেছেন,রাম অরণ্যে আশ্রিত,আমার কি আর বাঁচবার মতো সামর্থ্য আছে? আমি বরং আগুনেই প্রবেশ করি। পিতরি স্বর্গমাপন্নে রামে চারণ্যমাশ্রিতে। কিং মে জীবিতসামর্থ্যং প্রবেক্ষ্যামি হুতাশনম্।। পিতৃহীন ও ভ্রাতৃহীন, ইক্ষ্বাকুরাজগণপালিতা শূন্যা অযোধ্যায় আর নয়,বরং তপোবনে প্রবেশ করবেন। অযোধ্যাং নপ্রবেক্ষ্যামি প্রবেক্ষ্যামি তপোবনম্। দুই ভাইয়ের বিলাপ শুনে বিপদের আশঙ্কায়, সব অনুচরেরা অধিকতর ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। বিষাদগ্রস্ত, ক্লান্ত, ভরত ও শত্রুঘ্ন ভগ্নশৃঙ্গ বৃষদ্বয়ের মতো ভূমিতে বিলুণ্ঠিত হলেন।

অতঃপর পিতৃপুরুষদের পুরোহিত, স্থিতধী মহর্ষি বশিষ্ঠ ভরতকে তুলে ধরে বললেন, হে রাজপুত্র, তোমার পিতার মৃত্যুর আজ ত্রয়োদশ দিবস,ভ স্মাবশিষ্ট অস্থিগ্রহণে আর বিলম্ব কেন? প্রাণীমাত্রের তিনটি দ্বন্দ্ব (উৎপত্তি, ক্ষয়, বিনাশ) বিরাজমান, যেগুলি নিয়ত অনিবার্য, সেগুলি তুমিও অন্যথা করতে পার না। ত্রীণি দ্বন্দ্বানি ভূতেষু প্রবৃত্তান্যবিশেষতঃ। তেষু চাপরিহার্য্যেষু নৈবং ভবিতুমর্হসি।। তখন তত্ত্বজ্ঞ সুমন্ত্রও শত্রুঘ্নকে উঠিয়ে, তাঁকে স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনবার লক্ষ্যে, সকল প্রাণীর জন্মমৃত্যুর বিষয়ে অবহিত করলেন। যশস্বী নরোত্তমদ্বয় উঠে দাঁড়ালেন যেন বর্ষাজলে ম্রিয়মাণ ইন্দ্রধ্বজ প্রকাশিত হল। দীনস্বরে আলাপরত, রক্তনয়ন দুই কুমার অশ্রু মুছে ফেললেন। অমাত্যরা, তাঁদেরকে অন্যান্য কার্য সম্পাদনের জন্যে তাড়া দিতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৭: রাতচরা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭৪: শ্রীমার গৃহী ভক্তদের সন্ন্যাসদীক্ষা

অনন্তর ভরত সেখান হতে যাত্রা করতে উদ্যোগী হলেন। শত্রুঘ্ন শোকে তাপিত ভরতকে বললেন, যিনি সর্বপ্রাণীর আশ্রয়, তিনি নিজের দুঃখের প্রতিবিধান করতে পারতেন না? সেই শক্তিমান রাম, এক স্ত্রীলোকের কথায়, বনে নির্বাসিত হলেন। বলশালী, শৌর্যবান লক্ষ্মণ, পিতাকে নিগৃহীত করে,কেন রামকে মুক্ত করতে পারলেন না? রাজা পূর্বেই নারীর বশীভূত হয়েছিলেন যখন, ন্যায়মার্গ হতে বিচ্যুত হয়েছিলেন তিনি, তখনই ন্যায়-অন্যায় বিচার করে, তাঁর নিগ্রহ করা উচিত ছিল। এমন আলাপচারিতার মাঝে, দ্বারদেশে হাজির হল সর্বালঙ্কারে সজ্জিতা মন্থরা। মন্থরা চন্দনচর্চিতা, পরিধানে তার রাজকীয় বসন। তার সঙ্গে মানানসই বিচিত্র আভরণে সে বিভূষিতা। বিচিত্র মেখলা ও অন্যান্য শ্রেষ্ঠ অলঙ্কারে সজ্জিতা মন্থরা, যেন রজ্জুবদ্ধ বানরীর শোভা ধারণ করেছে। ভয়ঙ্কর অঘটনপটীয়সী মন্থরাকে দেখামাত্র দৌবারিক তাকে নিষ্ঠুরভাবে টেনে নিয়ে শত্রুঘ্নর কাছে সমর্পণ করলেন। এই সেই পাপিষ্ঠা নির্দয়া, যাঁর কারণে রাম বনবাসী হয়েছেন, আপনাদের পিতার দেহান্তর হয়েছে। যা উচিত ব্যবস্থা নেওয়ার সেটি গ্রহণ করুন। যস্যাঃ কৃতে বনে রামো ন্যস্তদেহশ্চ বঃ পিতা। সেয়ং পাপা নৃশংসা চ তস্যাঃ কুরু যথামতি।। শত্রুঘ্ন সেই কথা শুনে, চরম দুঃখ পেলেন। দৃঢ়সঙ্কল্প শত্রুঘ্ন, অনুচরবর্গকে বললেন, যে আমার পিতা ও ভ্রাতাদের তীব্র দুঃখোৎপাদনের কারণ, সে, সেই নিষ্ঠুর কর্মের ফল ভোগ করুক। তীব্রমুৎপাদিতং দুঃখং ভ্রাতৃণাং মে তথা পিতুঃ। যয়া সেয়ং নৃশংসস্য কর্ম্মণঃ ফলমশ্নুতাম্।। কুমার শত্রুঘ্ন, তৎক্ষণাৎ সখীজনপরিবৃতা কুব্জাকে সবলে ধরে ফেললেন।কুব্জার আর্ত চিৎকার নিনাদিত হল সেই গৃহ। ভয়ঙ্কর ক্রোধান্বিত শত্রুঘ্নকে দেখে, কুব্জার সখীরা, চতুর্দিকে ছুটে পালাল।
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-১৪: আমি তাইতে কি ভয় মানি!

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

আমরা বরং দয়াবতী, উদারমনা, ধর্মজ্ঞা, যশস্বিনী, দেবী কৌশল্যার শরণাপন্ন হই, তিনিই আমাদের নিশ্চিত আশ্রয়। ক্রুদ্ধ, শত্রুহননকারী, শত্রুঘ্ন, আর্তনাদকারিণী কুব্জাকে ভূতলে আকর্ষণ করলেন। কুব্জাকে আকর্ষণের সময়ে, বিচিত্র সব ভাণ্ড ভগ্নাবস্থায়, গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত, সেই ভাণ্ডগুলি রাজভবন পরিব্যাপ্ত করে যেন শারদ-গগনতুল্য শোভা বিস্তার করল। বলবান, পুরুষশ্রেষ্ঠ, কুমার, ক্রোধভরে, সবলে, মন্থরাকে আকর্ষণ করে, কৈকেয়ীর ভর্ৎসনায় মুখর হলেন।তিনি বহু কর্কশবাক্য প্রয়োগ করতে লাগলেন। সেই রূঢ় বাক্য শুনে, অত্যন্ত ব্যথিতা, শত্রুঘ্নর ভয়ে সন্ত্রস্তা, কৈকেয়ী, পুত্র ভরতের শরণাপন্ন হলেন। ভরত, ক্রুদ্ধ শত্রুঘ্নকে দেখে বললেন, নারী মাত্রই সর্বপ্রাণীদের অবধ্যা। তাই তাঁরা ক্ষমার যোগ্যা। তিনি অকপটে ঘোষণা করলেন, হন্যামহমিমাং পাপাং কৈকেয়ীং দুষ্টচারিণীম্। যদি মাং ধার্মিকো রামো নাসূয়েন্মাতৃঘাতকম্।।

ধার্মিক রাম যদি আমায় মাতৃহন্তারূপে ঘৃণা না করেন, তবে এই পাপিষ্ঠা দুর্বৃত্তা কৈকেয়ীকে, আমি হত্যা করতে পারি।ভরতের অভিমত, রঘুনন্দন ধার্মিক রাম যদি জানতে পারেন, এই কুব্জা নিহতা হয়েছে, তাহলে তিনি হয়তো আমাদের সঙ্গে কোনরূপ আলোচনাই করবেন না। ইমামপি হতাং কুব্জাং যদি জানাতি রাঘবঃ। তাঞ্চ মাঞ্চৈব ধর্ম্মাত্মা নাভিভাষিষ্যতে ধ্রুবম্।। ভরতের বচন শুনে,রামানুজ লক্ষ্মণ নিজের দুষ্কর্ম হতে বিরত হলেন। তিনি, সংজ্ঞাহীনা কৈকেয়ীর দাসী মন্থরাকে, মুক্ত করলেন। কৈকেয়ীর চরণপ্রান্তে পতিতা, দুঃখার্ত্তা, কষ্টসহকারে শ্বাস পরিত্যাগরতা, মন্থরা, দীনকণ্ঠে বিলাপ করতে লাগলেন। ভরতজননী কৈকেয়ী, শত্রুঘ্নের আকর্ষণহেতু মূর্চ্ছিতা, ক্রৌঞ্চীতুল্যা আক্রান্তা, কুব্জাকে, ব্যথিতা বিবেচনা করে, ধীরে ধীরে তাকে আশ্বস্ত করতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৪৬: আলাস্কার আকাশে অহরহ ব্যক্তিগত বিমান ওঠানামা করে

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৫: ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা এবং চলচ্চিত্র

প্রিয়জনের মৃত্যর অভিঘাত কাটিয়ে ওঠা দুষ্কর, ভরতও পিতার প্রয়াণের আকস্মিকতা মেনে নিতে পারেননি। পিতৃশোক ও জ্যেষ্ঠভ্রাতার অনৈতিক নির্বাসন,তাঁকে আলোড়িত করেছে,বিধ্বস্ত করেছে। এই দুটির কারণানুসন্ধানে তৎপর হয়ে, মূল কারণ যে, মা কৈকেয়ী, সেটি জেনে মর্মাহত হয়েছেন। রাজাহীন রাজ্যের চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন, ভরত। প্রাজ্ঞ, বিজ্ঞ অমাত্যগণ এবং পুরোহিত বশিষ্ঠের উপদেশক্রমে তিনি সম্বিত ফিরে পেয়েছেন। পিতার পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ যথারীতি সম্পন্ন করলেও শূন্যতা তাঁকে প্রতিনিয়ত গ্রাস করেছে। পিতা দশরথ ও জ্যেষ্ঠ রামের অভিভাবকত্বের অভাব বোধ করেছেন। এই অবস্থাতেও পুত্রবিচ্ছেদকাতরা রামজননী কৌশল্যার বেদনাবোধ তাঁর বিবেকযাতনা বৃদ্ধি করেছে। ভরতের ছায়াসঙ্গী শত্রুঘ্নও ভরতের মতোই বেদনাতুর হয়েছেন।দশরথপুত্র হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে আগুনে প্রবেশ করে আত্মহননের কথাও ভেবেছেন, তপোবনবাসীদের বৈরাগ্য তাঁর কাম্য, এমন ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।

তবে প্রাথমিক শোকের তীব্রতা হ্রাস পেলে শুরু হয় কারণানুসন্ধান ও একাধারে মৃতের আচরণগত গুণ ও ত্রুটির তাত্ত্বিক বিচার। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, মৃত্যু কোনও দুরূহ পারিবারিক সম্পর্কের জটিলতার কারণে ঘটে যদি, তবে পারস্পরিক সম্পর্কের চুলচেঁড়া বিচারের সম্মুখীন হতে হয় পারিপার্শ্বিকে থাকা প্রিয়জনদের। মানসিক অত্যাচার ও সম্পর্কের টানাপোড়েনের ফলে পুত্রবিচ্ছেদজনিত শোক ও প্রিয় পুত্রকে বঞ্চনাজনিত ক্ষোভ ও অনুতাপ,এ দুটিই ধার্মিক রাজা দশরথের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল।

ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

পিতার মৃত্যুর কারণ জেনে আর পাঁচ জন সাধারণের মতোই শত্রুঘ্নের মনে প্রশ্ন জেগেছে। জ্যেষ্ঠ রামের শৌর্যের প্রতি অপরসীম আস্থা রেখে ভেবেছেন, কেন শক্তিধর রাম স্ত্রীলোকের কথায়, বনে নির্বাসন বরণ করেছেন,রাম কেন নিজের প্রবঞ্চনার প্রতিকার করেননি? রামের ছায়াসঙ্গী লক্ষ্মণ,ইতিমধ্যে জেনেছেন, নীতিজ্ঞানহীন রাজা, ন্যায়পথ হতে বিচ্যুত হয়েছেন, তবু লক্ষ্মণ পিতাকে নিগৃহীত করেননি কেন? কেন লক্ষ্মণ, জ্যেষ্ঠকে বনবাসের শর্তমুক্ত করতে পারেননি? পিতার অভাববোধ ও তাঁকে হারানোর শোক, বোধ হয় ন্যায়-অন্যায়বোধের ঊর্দ্ধে নয়। পিতার বিচ্ছেদবেদনা এক দিকে, অপর দিকে পিতার অনৈতিক সিদ্ধান্ত, এই দুয়ের দ্বন্দ্ব, সম্পর্কের এক নতুন দিগদর্শন যেন। সম্মুখে উপস্থিত মন্থরা, রামের বনবাস ও পিতার মৃত্যুর মূর্তিমতী কারণ। শত্রুঘ্ন, তাঁর প্রতি উগরে দিলেন যত বিদ্বেষ, ক্ষোভ, ঘৃণার বিষ। তাঁর লক্ষ্য ভরতমাতা কৈকেয়ীও।

ভরত কিন্তু সম্বিত হারাননি। নারীনিগ্রহ শাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং এই অমানবিক কাজে নিষেধাজ্ঞা আছে, এ কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। রামের যোগ্য ভাই ভরত। বিবেকবান, কর্তব্যনিষ্ঠ, স্থিতধী, ভরত যেন রামের ছায়াশ্রিত পুরুষ। রাম যে কাজ নিন্দনীয় বলে মনে করেন, সে কাজ ধার্মিক ভরতের কাছে বর্জনীয়।রামের স্মরণে,ভরতের নিষেধাজ্ঞার মান্যতা দিয়েছেন অনুজ শত্রুঘ্ন।পিতার অভাবজনিত শূন্যতা নয়,রামের বিচ্ছেদ জনিত অভিভাবকত্বের অভাব যেন দীর্ঘতর হয়ে ঢেকে দিয়েছে ভরত ও শত্রুঘ্নের জগত ও জীবন। এমন কত ভরত, শত্রুঘ্ন, লক্ষ্মণের মতাদর্শকে প্রভাবিত করে চলেছেন জ্যেষ্ঠ কোন রাম। ভারতীয় সমাজ তথা পারিবারিক জীবনে, সেই ঐতিহ্য বয়ে চলেছে আবহমান, নিত্য, অনন্তধারায়, গ্রামে গঞ্জে, প্রত্যন্ত ভারতীয় গৃহকোণে, এখনও।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।

Skip to content