
ছবি: প্রতীকী।
রামের দর্শনাভিলাষী রাজপুরোহিত বশিষ্ঠ রাজা দশরথের পত্নীদের সম্মুখে নিয়ে রামের বাসস্থানের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলেন। রানিরা মন্দাকিনীর দিকে ধীরে যেতে যেতে রামলক্ষ্মণের বিচরণভূমি, নদীতীর্থ দেখতে পেলেন। দেবী কৌশল্যা বিশীর্ণ অশ্রুপূর্ণ বদনে দুঃখিনী সুমিত্রা ও অন্যান্য রাজ্ঞীদের কাছে হয়তো দুঃখভার লাঘবের চেষ্টা করলেন, অরণ্যের পূর্বদিকের এই তীর্থে বিচরণ করত, প্রভুত্বহীন, অসহায়, দুর্ভাগারা যাঁদের কোনও দেশ নেই। এখান থেকেই সুমিত্রাপুত্র লক্ষ্মণ নিরলসভাবে কৌশল্যার পুত্রের জন্যে জল আহরণ করতেন। এই নীচ কাজ করলেও সেই কাজ গর্হিত নয়। ভাইয়ের কারণে কৃতকর্ম তাঁর গুণের সূচক, তাই নিন্দনীয় নয়। দেবী কৌশল্যার সুমিত্রার প্রতি আকুতি, লক্ষ্মণের যোগ্য নয় এমন কষ্টকর এই কাজ আর নয়, এই ক্লেশদায়ক কাজ থেকে সে মুক্ত হোক।
আয়তনেত্রে কৌশল্যা মাটিতে দৃষ্টিপাত করলেন, দেখলেন, দক্ষিণাগ্রভাগ এমন কুশঘাসের স্তূপে, স্বর্গত পিতার উদ্দেশ্যে ন্যস্ত ইঙ্গুদিফলের পিণ্ড। তিনি রাজা দশরথের অন্যান্য পত্নীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। রাঘব রাম, কেমন পিতা ইক্ষ্বাকুকুলপতি মহান দশরথের উদ্দেশ্যে নিষ্ঠাভরে পিণ্ড দান করেছেন। দেবতাদের পর্যন্ত সম্মানীয় মহান রাজা যথাযথ (রাজকীয়) ভোজ্যদ্রব্যগ্রহণে অভ্যস্ত ছিলেন, এই ভোজ্য (পিণ্ড) তাঁর উপযুক্ত নয়, বলে রানি মনে করেন। ইন্দ্রতুল্য যে রাজা চতুর্দিকে সমুদ্রবেষ্টিত পৃথিবী ভোগ করেছেন, তিনি এই ইঙ্গুদিপিণ্ড ভোজন করবেন? গভীর দুঃখের সঙ্গে দেবী কৌশল্যা জানালেন, বিপুল বৈভবের অধিকারী রাম পিতাকে ইঙ্গুদিপিণ্ড দান করলেন,এর থেকে শোকের বিষয় আর কীই বা আছে? এই দৃশ্য দেখে, কৌশল্যার হৃদয় সহস্রধারায় বিদীর্ণ হল না কেন? লৌকিক সত্য এই যে, পুরুষের ভোজ্য অন্ন, নিশ্চয়ই তা দেবতাদেরও গ্রহণীয়।
আয়তনেত্রে কৌশল্যা মাটিতে দৃষ্টিপাত করলেন, দেখলেন, দক্ষিণাগ্রভাগ এমন কুশঘাসের স্তূপে, স্বর্গত পিতার উদ্দেশ্যে ন্যস্ত ইঙ্গুদিফলের পিণ্ড। তিনি রাজা দশরথের অন্যান্য পত্নীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। রাঘব রাম, কেমন পিতা ইক্ষ্বাকুকুলপতি মহান দশরথের উদ্দেশ্যে নিষ্ঠাভরে পিণ্ড দান করেছেন। দেবতাদের পর্যন্ত সম্মানীয় মহান রাজা যথাযথ (রাজকীয়) ভোজ্যদ্রব্যগ্রহণে অভ্যস্ত ছিলেন, এই ভোজ্য (পিণ্ড) তাঁর উপযুক্ত নয়, বলে রানি মনে করেন। ইন্দ্রতুল্য যে রাজা চতুর্দিকে সমুদ্রবেষ্টিত পৃথিবী ভোগ করেছেন, তিনি এই ইঙ্গুদিপিণ্ড ভোজন করবেন? গভীর দুঃখের সঙ্গে দেবী কৌশল্যা জানালেন, বিপুল বৈভবের অধিকারী রাম পিতাকে ইঙ্গুদিপিণ্ড দান করলেন,এর থেকে শোকের বিষয় আর কীই বা আছে? এই দৃশ্য দেখে, কৌশল্যার হৃদয় সহস্রধারায় বিদীর্ণ হল না কেন? লৌকিক সত্য এই যে, পুরুষের ভোজ্য অন্ন, নিশ্চয়ই তা দেবতাদেরও গ্রহণীয়।
এমন দুঃখে কাতর দেবী কৌশল্যাকে আশ্বাস দিয়ে, চললেন তাঁর সপত্নীবৃন্দ। তখনই তাঁরা আশ্রমে স্বর্গচ্যুত দেবতুল্য রামকে দেখতে পেলেন।পুরুষোত্তম,সত্যনিষ্ঠ, রাম জননীদের তুলে ধরে তাঁদের চরণকমল গ্রহণ করলেন। রাম সব রকম ভোগে নিরাসক্ত ও ত্যাগী। এ অবস্থায় তাঁকে দেখে শোকার্ত জননীরা তারস্বরে কেঁদে উঠলেন। মায়েরা, সুখপ্রদ, শুভ, আঙ্গুলবিশিষ্ট হাতে রামের পিঠের ধূলি মুছিয়ে দিতে লাগলেন। রামের পরে, দুঃখিত, সুমিত্রানন্দন লক্ষ্মণ, ধীরে মায়েদের প্রণাম নিবেদন করলেন। সমবেত রাজমহিষীরা দশরথতনয়,প্রিয়দর্শন, লক্ষ্মণের প্রতিও রামের তুল্য ব্যবহার প্রদর্শন করলেন। দুঃখিনী, সীতা শাশুড়িদের চরণ স্পর্শ করে, সাশ্রুনয়নে তাঁদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। বনবাসের কারণে দীনা সীতা। তাঁকে স্নেহালিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে দুঃখিনী কৌশল্যা বললেন, বিদেহরাজদুহিতা, রাজা দশরথের পুত্রবধূ, রামের পত্নী সীতা, তিনি কেন এই নির্জন অরণ্যে দুঃখভোগ করবেন? সীতার মুখখানি তাপদগ্ধ পদ্মতুল্য, ম্রিয়মাণ কমল যেন, ধূলিধূসর কাঞ্চনসম এবং মেঘাচ্ছন্ন চন্দ্রের মতো বিধ্বস্ত ও ক্লিষ্ট। সীতার এমন মুখখানি দেখে, দেবী কৌশল্যা, সীতাকে গভীর দুঃখের সঙ্গে জানালেন, হে বৈদেহি, প্রতিকূলতার অরণি থেকে জাত অন্তরস্থিত শোকানল দগ্ধ করছে আমায়। মুখং তে প্রেক্ষ্য মাং শোকো দহত্যগ্নিরিবাশ্রয়ম্। ভৃশং মনসি বৈদেহি ব্যসনারণিসম্ভবঃ।।
শোকার্তা জননী এমন কথা বলতে থাকলেন। ভরতের জ্যেষ্ঠ রাঘব রাম তখন বশিষ্ঠের সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর পদযুগল গ্রহণ করলেন। ইন্দ্র যেমন দেবগুরু বৃহস্পতির চরণদ্বয় গ্রহণ করেন, তেমনই অগ্নিসম দীপ্ততেজস্বী পুরোহিতের পদদ্বয় ধারণ করে তাঁর সঙ্গে উপবেশন করলেন রাম। অনন্তর নিজ মন্ত্রীগণ, পুরমুখ্য, সৈনিক ও শ্রেষ্ঠ ধর্মজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে, ধার্মিক ভরত, অগ্রজের কাছে উপবেশন করলেন। পাশে উপবিষ্ট অতি বীর্যবান রামকে তপস্বিবেশে দেখে, সৌন্দর্যে জাজ্বল্যমান ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত ইন্দ্রের মতো কৃতাঞ্জলিপুটে রইলেন ভরত। রামকে প্রণাম ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে, ভরত কী সুবাক্য বলবেন? সেখানে উপস্থিত আর্য জনতার, এই বিষয়ে, অসীম কৌতূহল হল। সত্যপ্রতিজ্ঞ রাম, লক্ষ্মণ, মহানুভব ধার্মিক ভরত, ঠিক যেন যজ্ঞভূমিতে সদস্যসহ অগ্নিত্রয়ের মতো, সুহৃদ্গণ পরিবৃত হয়ে বিরাজমান হলেন।
শোকার্তা জননী এমন কথা বলতে থাকলেন। ভরতের জ্যেষ্ঠ রাঘব রাম তখন বশিষ্ঠের সাক্ষাৎ পেয়ে তাঁর পদযুগল গ্রহণ করলেন। ইন্দ্র যেমন দেবগুরু বৃহস্পতির চরণদ্বয় গ্রহণ করেন, তেমনই অগ্নিসম দীপ্ততেজস্বী পুরোহিতের পদদ্বয় ধারণ করে তাঁর সঙ্গে উপবেশন করলেন রাম। অনন্তর নিজ মন্ত্রীগণ, পুরমুখ্য, সৈনিক ও শ্রেষ্ঠ ধর্মজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে, ধার্মিক ভরত, অগ্রজের কাছে উপবেশন করলেন। পাশে উপবিষ্ট অতি বীর্যবান রামকে তপস্বিবেশে দেখে, সৌন্দর্যে জাজ্বল্যমান ব্রহ্মার কাছে উপস্থিত ইন্দ্রের মতো কৃতাঞ্জলিপুটে রইলেন ভরত। রামকে প্রণাম ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রদ্ধা জানিয়ে, ভরত কী সুবাক্য বলবেন? সেখানে উপস্থিত আর্য জনতার, এই বিষয়ে, অসীম কৌতূহল হল। সত্যপ্রতিজ্ঞ রাম, লক্ষ্মণ, মহানুভব ধার্মিক ভরত, ঠিক যেন যজ্ঞভূমিতে সদস্যসহ অগ্নিত্রয়ের মতো, সুহৃদ্গণ পরিবৃত হয়ে বিরাজমান হলেন।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১১৩: একটি হিংসা অনেক প্রতিহিংসা, জিঘাংসা, হত্যা এবং মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে সর্বত্র

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১৭: একাকিত্বের অন্ধকূপ/২: অন্ধকারের উৎস হতে
শোকাকুল সুহৃদ্বর্গের সঙ্গে শোকসন্তপ্ত সেই রাত অতিকষ্টে অতিবাহিত হল। রাত্রি প্রভাত হলে, শুভাকাঙ্খিপরিবৃত ভাইয়েরা মন্দাকিনীতীরে হোম ও জপ সমাপনান্তে, রামের কাছে উপস্থিত হলেন। সকলেই নিশ্চুপ, কারও মুখে কথা নেই,সুহৃদ্গণের মধ্যে ভরত রামকে বললেন, পিতা, জননীকে সান্ত্বনা দিয়ে এই রাজ্য আমাকে দিয়েছেন। আমি সেই রাজ্য আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। আপনি সেই নিষ্কণ্টক রাজ্য ভোগ করুন। সান্ত্বিত্বা মামিকা মাতা দত্তং রাজ্যমিদং মম।তদ্ দদামি তবৈবাহং ভুঙ্ক্ষ্ব রাজ্যমকণ্টকম্।।
ভরত জানালেন,বর্ষার আগমনে জলবেগে ভগ্ন সেতুর মতো এই রাজ্য। রামবিনা অন্য কেউ এই অখণ্ড রাজ্যটিকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম। গর্দভ যেমন অশ্বের গতি কিংবা পক্ষী যেমন গরুড়ের গতি অনুকরণ করতে পারে না তেমন মহীপতি রামের তুল্য সামর্থ্য ভরতের নেই। ভরত তাঁর বক্তব্যকে আরও যুক্তিনিষ্ঠ করে তুললেন—তাঁর জীবনই ধন্য,যাঁকে আশ্রয় করে অপরে জীবন যাপন করে থাকেন। তাঁর জীবন দুঃসহ, যিনি অপরের ভরসায় জীবন যাপন করেন। ভরত উদাহরণসহ রামকে বোঝালেন, যেমন একটি বৃক্ষ রোপণ করে, তাঁকে বড় করে তোলা হল। সেই তরু মহীরুহে পরিণত হল যখন, তখন খর্বাকৃতি ব্যক্তির পক্ষে দুরারোহ হয়ে উঠল। কুসুমিত তরুটি কিন্তু ফল উৎপাদন করল না। বৃক্ষটি সেই রোপণকর্তাকে কোন আনন্দ দিল না, কারণ সেই ব্যক্তি ফললাভের আশাতেই বৃক্ষরোপণ করেছিলেন। ভরত জানালেন, বৃক্ষের এই উপমা রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাম তাঁদের বিশিষ্ট ভরণকর্তা, সেবকদের যথানুরূপ শাসন করছেন না। তাই ভরতের অনুরোধ, হে মহারাজ, রাজ্যের অগ্রগণ্য প্রধান ব্যক্তিরা তেজোদীপ্ত সূর্যের মতো শত্রুদমনকারী আপনাকে রাজ্যে অধিষ্ঠিত দেখুন। শ্রেণয়স্ত্বাং মহারাজ পশ্যন্ত্বগ্রাশ্চ সর্ব্বশঃ। প্রতপন্তমিবাদিত্যং রাজ্যস্থিতমরিন্দমম্।।
ভরত জানালেন,বর্ষার আগমনে জলবেগে ভগ্ন সেতুর মতো এই রাজ্য। রামবিনা অন্য কেউ এই অখণ্ড রাজ্যটিকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম। গর্দভ যেমন অশ্বের গতি কিংবা পক্ষী যেমন গরুড়ের গতি অনুকরণ করতে পারে না তেমন মহীপতি রামের তুল্য সামর্থ্য ভরতের নেই। ভরত তাঁর বক্তব্যকে আরও যুক্তিনিষ্ঠ করে তুললেন—তাঁর জীবনই ধন্য,যাঁকে আশ্রয় করে অপরে জীবন যাপন করে থাকেন। তাঁর জীবন দুঃসহ, যিনি অপরের ভরসায় জীবন যাপন করেন। ভরত উদাহরণসহ রামকে বোঝালেন, যেমন একটি বৃক্ষ রোপণ করে, তাঁকে বড় করে তোলা হল। সেই তরু মহীরুহে পরিণত হল যখন, তখন খর্বাকৃতি ব্যক্তির পক্ষে দুরারোহ হয়ে উঠল। কুসুমিত তরুটি কিন্তু ফল উৎপাদন করল না। বৃক্ষটি সেই রোপণকর্তাকে কোন আনন্দ দিল না, কারণ সেই ব্যক্তি ফললাভের আশাতেই বৃক্ষরোপণ করেছিলেন। ভরত জানালেন, বৃক্ষের এই উপমা রামের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাম তাঁদের বিশিষ্ট ভরণকর্তা, সেবকদের যথানুরূপ শাসন করছেন না। তাই ভরতের অনুরোধ, হে মহারাজ, রাজ্যের অগ্রগণ্য প্রধান ব্যক্তিরা তেজোদীপ্ত সূর্যের মতো শত্রুদমনকারী আপনাকে রাজ্যে অধিষ্ঠিত দেখুন। শ্রেণয়স্ত্বাং মহারাজ পশ্যন্ত্বগ্রাশ্চ সর্ব্বশঃ। প্রতপন্তমিবাদিত্যং রাজ্যস্থিতমরিন্দমম্।।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১১৩: ভাবনা উইদাউট ভদ্কা

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯৮: মা সারদার জন্মতিথিতে তাঁর অপূর্ব অমানবীয় রূপ ফুটে উঠল
ভরত রামের ভাবি রাজ্যের রাজকীয় চিত্র উপহার দিলেন। রামের এই রাজকীয় যাত্রাপথ মুখরিত হোক প্রমত্ত হাতির বৃংহণে, অন্তঃপুরিকারা সুস্থির জীবনে আনন্দে অবস্থান করুন। নাগরিক সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তিরা,বারংবার রামের প্রতি ভরতের প্রস্তাব সঙ্গত বলে “সাধু সাধু”বলে উঠলেন। যশস্বী ভরতকে, দুঃখিত ও বিলাপরত দেখে, স্থিতধী, সংযতচিত্ত রাম, তাঁকে আশ্বস্ত করলেন, মানুষের কোন ক্ষমতাই নেই, সে ইচ্ছানুসারে কোনও কাজ করতে পারে না। চতুর্দিক হতে কৃতান্ত কাল তাকে আকর্ষণ করে চলেছে। সংগৃহীত যা কিছু দ্রব্যের পরিণতি হল ক্ষয়। উত্থান হলে পতন নিশ্চিত। সংযোগ সর্বদাই বিয়োগান্তক। জীবনের পরিণাম মৃত্যুর গর্ভে নিহিত। ফল সুপক্ক হলে, পতন ভিন্ন অন্য কোনও ভয় নেই তার। মরণশীল মানুষ জন্ম নেয় শুধু মৃত্যুভয় সঙ্গে নিয়ে, তাঁর আর অন্য কোও ভয় নেই। একটি গৃহের স্তম্ভ দৃঢ় হলেও কালক্রমে সেটি জীর্ণপ্রায় হয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, তেমনই মানুষও জন্মমৃত্যুর বশীভূত হয়ে ক্রমশ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। রাত্রি অতিবাহিত হলে আর ফিরে আসে না, যমুনা সর্বদাই পূর্ণ সমুদ্র অভিমুখে যাত্রা করে। গ্রীষ্মে সূর্যরশ্মির জলশোষণের মতো দিবারাত্রির নিয়ত ধাবমানগতি প্রাণীদের আয়ু ক্রমাগত হ্রাস করে চলেছে।
রামের প্রশ্ন, নিজের জন্যে অনুশোচনা কর, অন্যের জন্যে তোমার এই অনুশোচনা কেন? যাঁরা স্থিতাবস্থায় আছেন বা যাঁরা চলমান প্রত্যেকের আয়ুক্ষয় হচ্ছে। আত্মানমনুশোচ ত্বং কিমন্যমনুশোচসি। আয়ুস্তু হীয়তে যস্য স্থিতস্যাথ গতস্য চ।। মৃত্যু সহযাত্রী, মৃত্যু সঙ্গে অবস্থান করে, সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার পরে আবার ফিরে আসে মৃত্যু। শরীরে বলিরেখা, মাথায় পলিত কেশ, জরাগ্রস্ত জীর্ণ পুরুষ কীভাবে অপরকে প্রভাবিত করবে? উদীয়মান সূর্য তার আনন্দের উৎস, অস্তমিত সূর্যও তাকে আনন্দ দেয়। শুধু নিজের জীবনের ক্ষয় সম্বন্ধে সে অবগত নয়।
রামের প্রশ্ন, নিজের জন্যে অনুশোচনা কর, অন্যের জন্যে তোমার এই অনুশোচনা কেন? যাঁরা স্থিতাবস্থায় আছেন বা যাঁরা চলমান প্রত্যেকের আয়ুক্ষয় হচ্ছে। আত্মানমনুশোচ ত্বং কিমন্যমনুশোচসি। আয়ুস্তু হীয়তে যস্য স্থিতস্যাথ গতস্য চ।। মৃত্যু সহযাত্রী, মৃত্যু সঙ্গে অবস্থান করে, সুদীর্ঘ পথপরিক্রমার পরে আবার ফিরে আসে মৃত্যু। শরীরে বলিরেখা, মাথায় পলিত কেশ, জরাগ্রস্ত জীর্ণ পুরুষ কীভাবে অপরকে প্রভাবিত করবে? উদীয়মান সূর্য তার আনন্দের উৎস, অস্তমিত সূর্যও তাকে আনন্দ দেয়। শুধু নিজের জীবনের ক্ষয় সম্বন্ধে সে অবগত নয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৫: রবীন্দ্রনাথ আশুতোষ চৌধুরির বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৫৫: সর্বত্র বরফ, কোত্থাও কেউ নেই, একেবারে গা ছমছম করা পরিবেশ
ঋতুপরিবর্তনে ফলে নবাগত ঋতু দেখে প্রাণীরা পরম হর্ষ অনুভব করে, কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের ফলে তাদের প্রাণক্ষয় হয়ে থাকে। যেমন মহাসাগরের মধ্যে দুটি কাঠ মিলিত হয় আবার কালক্রমে মিলনান্তে একটি সময়সীমায় আবার বিচ্ছিন্ন হয়। এমনই পত্নী, পুত্র, জ্ঞাতিবর্গ, ধনসম্পত্তি সবকিছু একত্রে সম্মিলিত হলেও তারা একসময়ে বিচ্ছিন্ন হয়। সুতরাং এদের বিচ্ছেদ নিশ্চিতরূপে চিরন্তন। যা ঘটবে তা কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই যিনি প্রয়াত, সেই ব্যক্তির জন্য অনুশোচনারত মানুষের কোন (নিজের মৃত্যুর জন্যে শোকপ্রকাশের) সামর্থ্যই নেই। যেমন কোন যাত্রীদলের উদ্দেশ্যে পথে অপেক্ষমান কোনও পান্থ বলেন, “আমিও তোমাদের পশ্চাতে আসব” ঠিক সেভাবেই পিতৃপিতামহের ক্রম অনুসরণ করেছেন যিনি তিনি শোক প্রকাশ করবেন কেন? এ যে অন্যথা হবার নয়। বয়স বহমান স্রোতধারার মতো ফিরে আসে না। সুতরাং আত্মাকে সুখের কোন বিষয়ে নিয়োগ করাই বিধেয়,কারণ শোনা যায়, মানুষের সুখভোগের জন্যেই জন্ম হয়েছে।পিতা ধর্মাত্মা রাজা দশরথ, দরাজমনে দক্ষিণা দান করে, বহু যজ্ঞ করে, সজ্জনের সুকৃতির ফলস্বরূপ স্বর্গলাভ করেছেন। তাঁর জন্যে শোক করা সমীচীন নয়। জীর্ণ পার্থিব মানুষের দেহ ত্যাগ করে,আমাদের পিতা ব্রহ্মলোকে অবস্থানের আশীর্বাদধন্য হয়েছেন। কোনও প্রাজ্ঞের এমন শোকপ্রকাশ যোগ্য কাজ নয়। তোমার ও আমার মতো কোনও জ্ঞানী, শিক্ষিত, বিশিষ্ট বুদ্ধিমান মানুষের এমন শোকপ্রকাশ অসঙ্গত। যাঁরা বুদ্ধিমান ও ধীর তাঁদের এই দুঃখ, বিলাপ ও রোদন এবং বহুবিধ শোক, সর্বদাই পরিহার করা উচিত।
ভরতের প্রতি রামের অনুরোধ, হে শ্রেষ্ঠ বাগ্মী, তুমি সুস্থির হও, শোক নিয়ন্ত্রণে রাখ, জিতেন্দ্রিয় পিতার আদেশানুবর্ত্তী হয়ে, সেই নগরীতে (অযোধ্যায়) ফিরে যাও। রাম জানালেন, তিনি নিজেও সেই পুণ্যকর্মা পিতার আদেশকে সম্মান জানিয়ে সেইমতো কাজ করবেন। পিতার আদেশ অমান্য করা ন্যায্য কাজ নয়। যত্রাহমপি তেনৈব নিযুক্তঃ পুণ্যকর্ম্মণা। তত্রৈবাহং করিষ্যামি পিতুরার্য্যস্য শাসনম্।। ন ময়া শাসনং তস্য ত্যক্তুং ন্যায্যমরিন্দম।
ভরতের প্রতি রামের অনুরোধ, হে শ্রেষ্ঠ বাগ্মী, তুমি সুস্থির হও, শোক নিয়ন্ত্রণে রাখ, জিতেন্দ্রিয় পিতার আদেশানুবর্ত্তী হয়ে, সেই নগরীতে (অযোধ্যায়) ফিরে যাও। রাম জানালেন, তিনি নিজেও সেই পুণ্যকর্মা পিতার আদেশকে সম্মান জানিয়ে সেইমতো কাজ করবেন। পিতার আদেশ অমান্য করা ন্যায্য কাজ নয়। যত্রাহমপি তেনৈব নিযুক্তঃ পুণ্যকর্ম্মণা। তত্রৈবাহং করিষ্যামি পিতুরার্য্যস্য শাসনম্।। ন ময়া শাসনং তস্য ত্যক্তুং ন্যায্যমরিন্দম।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৭৮: রক্তে ভেজা মাটিতে গড়ে ওঠে সত্যিকার প্রাপ্তি

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১১৬: শান্তিনিকেতনে কবির প্রথম জন্মোৎসব
ভরতেরও সেই আদেশ মান্য করা উচিত, পিতা আমাদের একাধারে বন্ধু এবং পিতা। স ত্বয়াপি সদা মান্যঃ স বৈ বন্ধুঃ স নঃ পিতা।। রাম তাঁর বক্তব্যকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করলেন—রাম, ধর্মচারিগণের সম্মত পিতৃবাক্য,বনবাসের কার্যক্রমানুসারে পালন করবেন। পরলোকজয়ের আকাঙ্খা থাকলে,ধার্মিক, অনৃশংস এবং গুরুর আজ্ঞানুবর্ত্তী হওয়া উচিত। রামের উপদেশ—হে নরোত্তম,পিতা দশরথের সুকর্মের নিরিখে,তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে নিজের স্বভাবানুসারে কাজ কর। আত্মানমনুতিষ্ঠ ত্বং স্বভাবেন নরর্ষভ।নিশাম্য তু শুভং বৃত্তং পিতুর্দশরথস্য নঃ।। মহাত্মা রাম,পিতার আদেশপালনের জন্যে কনিষ্ঠ ভরতকে, এমন সব অর্থপূর্ণ কথা বলে, মুহূর্তকাল বিরাম নিলেন।
বনবাসী রাম তাঁর সাধ্যানুসারে পিতার উদ্দেশ্যে ইঙ্গুদিফলের উপাচার দিয়ে পিণ্ড নিবেদন করেছিলেন। সেই শ্রাদ্ধোপাচারে না ছিল রাজকীয় আড়ম্বর, ছিল না কোনও উপাচারের বাহুল্য, ছিল শুধু পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবনত এক পুত্রের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের আর্তি। এখনও এ প্রশ্ন বোধ হয় প্রাসঙ্গিক, অনুষ্ঠানবাহুল্যে ভরা স্মরণে কী আন্তরিকতা আছে? না, একান্তে মনের মাধুরী মিশিয়ে, অশ্রুবিন্দুর উপাচার সাজিয়ে, স্মরণের মধ্যে আছে আন্তরিক শ্রদ্ধার প্রকাশ? তাই কুশঘাসের স্তূপে ইঙ্গুদিফলের পিণ্ড, রানি কৌশল্যার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল সেটি রাজোচিত আড়ম্বরে অভ্যস্ত স্বামীহারা এক রানির শোকোচ্ছ্বাসমাত্র। হয়তো সেখানে, আশানুরূপ আয়োজন বা প্রাচুর্যের অভাববোধ ছিল।কিন্তু একজন মায়ের হৃদয় স্পর্শ করেছিল ধার্মিক পুত্রের আন্তরিক পিতৃস্মরণে, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রলেপের গভীরতা। তাই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়, সপত্নীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আবেগাপ্লুত গর্বিত রামজননী বলেছিলেন, ইদমিক্ষ্বাকুনাথস্য রাঘবস্য মহাত্মনঃ। রাঘবেণ পিতুর্দ্দত্তং পশ্যতৈতদ্ যথাবিধি।। দেখ, রাঘব রাম কেমন মহান ইক্ষ্বাকুকুলপতির উদ্দেশ্যে নিষ্ঠা সহকারে যথাবিধি পিণ্ড দান করেছেন।
বনবাসী রাম তাঁর সাধ্যানুসারে পিতার উদ্দেশ্যে ইঙ্গুদিফলের উপাচার দিয়ে পিণ্ড নিবেদন করেছিলেন। সেই শ্রাদ্ধোপাচারে না ছিল রাজকীয় আড়ম্বর, ছিল না কোনও উপাচারের বাহুল্য, ছিল শুধু পিতার প্রতি শ্রদ্ধাবনত এক পুত্রের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের আর্তি। এখনও এ প্রশ্ন বোধ হয় প্রাসঙ্গিক, অনুষ্ঠানবাহুল্যে ভরা স্মরণে কী আন্তরিকতা আছে? না, একান্তে মনের মাধুরী মিশিয়ে, অশ্রুবিন্দুর উপাচার সাজিয়ে, স্মরণের মধ্যে আছে আন্তরিক শ্রদ্ধার প্রকাশ? তাই কুশঘাসের স্তূপে ইঙ্গুদিফলের পিণ্ড, রানি কৌশল্যার মনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল সেটি রাজোচিত আড়ম্বরে অভ্যস্ত স্বামীহারা এক রানির শোকোচ্ছ্বাসমাত্র। হয়তো সেখানে, আশানুরূপ আয়োজন বা প্রাচুর্যের অভাববোধ ছিল।কিন্তু একজন মায়ের হৃদয় স্পর্শ করেছিল ধার্মিক পুত্রের আন্তরিক পিতৃস্মরণে, শ্রদ্ধা ও ভালবাসার প্রলেপের গভীরতা। তাই প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায়, সপত্নীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, আবেগাপ্লুত গর্বিত রামজননী বলেছিলেন, ইদমিক্ষ্বাকুনাথস্য রাঘবস্য মহাত্মনঃ। রাঘবেণ পিতুর্দ্দত্তং পশ্যতৈতদ্ যথাবিধি।। দেখ, রাঘব রাম কেমন মহান ইক্ষ্বাকুকুলপতির উদ্দেশ্যে নিষ্ঠা সহকারে যথাবিধি পিণ্ড দান করেছেন।

ছবি: প্রতীকী।
অযোধ্যার রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারে রামের অগ্রাধিকার এবং তাঁর শাসনের অপরিহার্যতা নতশিরে স্বীকার করেছেন ভরত। নাগরিক সমাজ ভরতকে সমর্থন জানিয়েছেন। ভরতের প্রস্তাবের উত্তরে স্থিতধী সংযতচিত্ত রাম ভরতকে জীবনের অসাড়তা ও নশ্বরতা বিষয়ে অবহিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন। একান্ত নিভৃতযাপন বোধ হয় মানুষকে জগত ও জীবন সম্বন্ধে নির্লিপ্ত উদাসীন করে তোলে। এই বৈরাগ্য যেন নিজের গভীরে আত্মিক পরমার্থসন্ধান। ক্ষয়িষ্ণু জীবন এগিয়ে চলেছে মৃত্যুর দিকে এক অনিবার্য, অমোঘ লক্ষ্যে। রাম ঋতু পরিবর্তনে, আবহমান কালের প্রবহমানতা অনুভব করেছেন। কালস্রোতে ভাসমান অনিশ্চিত জীবনের একত্র সম্মিলন আবার বিচ্ছেদ, যে বিচ্ছেদ চিরন্তন, এই সত্য মেনে নিতে হয়।এর জন্যে শোক নয়, নয় বিষাদ। জীবনমৃত্যুর এই আসা যাওয়ার ক্রমাগত আবর্তন, অনস্বীকার্য।তাই ধার্মিক পিতার মৃত্যুশোক রামকে স্পর্শ করলেও স্থিতধী, প্রাজ্ঞ রাম শোককে সংযমের বাঁধনে বেঁধে জাগতিক কর্তব্যবিষয়ে তৎপর হন। পিতার আদেশটিকে, কার্যে পরিণত করবার মধ্যেই আছে সন্তানের পিতার প্রতি সগৌরব সশ্রদ্ধ আনুগত্য ও মান্যতাদান। উত্তরাধিকারীদের কর্তব্যপালনের মধ্যে, প্রয়াত মাননীয় গুরুজনদের নীতিবোধ, আদর্শ, অনুশাসনের পরম্পরাগত ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার গৌরববোধ লুকিয়ে থাকে। রাম সেই পরম্পরার অধিকারী। এই মূল্যবোধের অবক্ষয়ের যুগেও সাধারণ ভারতীয়দের জীবনাদর্শে পিতার আদর্শবোধের অনুপ্রেরণা আজও কাজ করে থাকে, তাই এখন সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেলেও পিতামাতার ছত্রছায়ায় কাঙাল হয় অনেকেই এবং আদর্শগুলিও পরমনিষ্ঠায় আত্মস্থ করে, যাপনে ধরে রাখে।—চলবে।
* মহাকাব্যের কথকতা (Epics monologues of a layman): পাঞ্চালী মুখোপাধ্যায় (Panchali Mukhopadhyay) অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা, সংস্কৃত বিভাগ, যোগমায়া দেবী কলেজে।