শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সুবিনয় পায়চারি করছে ছাদে। ছাদের রেলিং ঘেঁষে বেশ কয়েকটি ফুলের টব। তাতে গাঁদা-চন্দ্রমল্লিকা-ডালিয়া ফুটে রয়েছে। ওরা বাপ-বেটি যে যখন সময় পায় পরিচর্যা করে ওদের। প্রিয়া ফুল খুব ভালোবাসে। বড় দুঃখী তার মেয়েটা। জন্মের মাত্র ছ’মাস পরেই মাকে হারাল। সুমিতা না থাকলে কী করে যে প্রিয়াকে মানুষ করত, ভাবতেও ভয় করে সুবিনয়ের। কিন্তু ভাইঝিকে মানুষ করতে হবে বলে সুমিতাকে তো আর সারাজীবন আইবুড়ো করে রাখা যায় না! তাই প্রিয়ার যখন দশ বছর বয়স, তখন সুমিতার বিয়ে দেয় সুবিনয়। সুমিতা যদিও খুবই আপত্তি করেছিল। বারবার বলত, “তোমাদের কে দেখবে দাদা? প্রিয়া তো এখনও খুব ছোটো, ও কি পারে সবদিক সামলাতে?”
সুবিনয় হেসে জবাব দিয়েছিল, “ও ঠিক হয়ে যাবে। প্রিয়া বড়ো হতে হতে তোর বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাবে যে! আর বিয়ে তো তোর আমি খুব দূরে দিচ্ছি না। বরের গাড়ি আছে। মনে হলেই চলে আসবি। আধঘণ্টার তো রাস্তা।”
সুমিতা চিন্তিত মুখে বলেছিল,”যদি ওরা আসতে না দেয়?”
“দেবে… দেবে। আমি কমলেশকে সব বলেছি। তোর যে প্রিয়ার জন্য খুব মন খারাপ করবে, এ বাড়িতে আসতে ইচ্ছে করবে, সে কথাও জানিয়েছি। কমলেশ আমাকে বলেছে, তোর যখনই আমাদের দেখতে ইচ্ছে করবে গাড়ি নিয়ে চলে আসবি। ও ড্রাইভারকে সেই রকমই বলে রাখবে।”
সত্যিই কমলেশ কথা রেখেছে। আজ বারো বছরে সুমিতার এত ঘনঘন এ বাড়িতে আসা নিয়ে একবারের জন্যও বিরক্তি প্রকাশ করেনি সে। ওর মতো ছেলের হাতে সুমিতাকে তুলে দিয়ে যার পর নাই নিশ্চিন্ত হয়েছে সুবিনয়।
আরও পড়ুন:

শারদীয়ার গল্প: তখন বিকেল/২

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৯: সুন্দরবনের পাখি—পানকৌড়ি

এখন প্রিয়াকে সিদ্ধার্থের হাতে তুলে দিতে পারলে ওর সব দায়িত্ব শেষ। আর ছ’মাস চাকরি আছে, এর মধ্যেই প্রিয়ার বিয়েটা দিয়ে দিতে হবে। বড় ভালো ছেলে সিদ্ধার্থ। বড় আপন মনে হয়। কেমন যেন একটা টান অনুভব করে ওর প্রতি। অফিস থেকে ফিরে যেদিন শোনে প্রিয়াকে পড়িয়ে চলে গেছে সিদ্ধার্থ, সেদিন মনটা খারাপ হয়ে যায়। ইদানীং অবশ্য পড়ানো শেষ হয়ে গেলেও সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা করবে বলেই অপেক্ষা করে ও। সুবিনয় ফিরলে ওর সঙ্গে কথা বলে, একসাথে এক কাপ চা খেয়ে তবে যায়। যখন প্রিয়াকে পড়ায়, বা ওরা দু’জন কাছাকাছি থাকে, আড়াল থেকে সুবিনয় লক্ষ্য করেছে প্রিয়ার প্রতি ওর দৃষ্টিতে এতটুকু অশোভনীয় ইঙ্গিত নেই, বরং আছে একটা স্নেহ… অনাবিল ভালোবাসা।
আরও পড়ুন:

বাংলাকে ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি: বাংলা বুকের ভিতরে

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৬২: সত্যজিৎ রায় রুপটান শিল্পীকে বলেছিলেন, উত্তমকুমারের কোনও মেকআপ করার

ঠিক এমন দৃষ্টিতেই দেখেছিল সুবিনয় একজনকে। কত গান শুনিয়ে ছিল তাকে। কত স্বপ্ন আঁকা হয়েছিল দু’জনের চোখে। কিন্তু স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গিয়েছে। সেই স্মৃতিটুকু আঁকড়েই আজও বেঁচে আছে সুবিনয়। বড় ক্লান্তি আসে এখন। ছুটি চায় মন। প্রিয়াকে সিদ্ধার্থের হাতে তুলে দিয়ে তারপর ওর ছুটি। সিদ্ধার্থের মুখে শুনেছে ওর বাবা নেই। প্রিয়াও বলেছে সে কথা। সিদ্ধার্থের কথা শুনে মনে হয়, বাবার প্রতি ওর মনে তেমন শ্রদ্ধাও নেই। ওর জগৎ মাকে ঘিরেই। মা-ই ওর আরাধ্যা।

একদিন তো বলেই ফেলল,”বাবার কথা আমার মনে নেই,তা নয়। বরং সেই মনে থাকাটুকু বড় বেশি জ্বালা দেয়। বাবার জায়গাটা ফাঁকাই থেকে গিয়েছে। আপনাকে সে জায়গায বসিয়ে ফেলেছি অজান্তেই।” আবেগে ধরে এসেছিল ওর গলা। পরম মমতায় হাত রেখেছিল সুবিনয় ওর মাথায়। সত্যি বড়ো ভালো ছেলে। প্রিয়া সুখী হবে… খুব সুখী হবে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

মুভি রিভিউ: মামুটির মাল্টিস্টারার ছবি ‘সিবিআই ৫: দ্য ব্রেন’ গতানুগতিক থ্রিলার

অজন্তা সুবিনয়ের জীবনে অল্পকিছুদিনের অতিথি। বছর দুয়েকের। সে-ও ভালোই ছিল। “তাকে ভালবাসতে পারিনি বলে সে ভাল ছিল না, এ কথা আমি কখনোই বলতে পারি না।” নিজের মনে এই সব কথাই ভাবছে সুবিনয়। অজন্তার কাছে সে মনে মনে অপরাধী থেকে গিয়েছে। যদিও অজন্তার প্রতি কখনওই ঔদাসীন্য দেখায়নি। অজন্তার অসুখের সময় নিজের যথাসর্বস্ব দিয়ে ওর চিকিৎসা করিয়েছে। কোনও ত্রুটি রাখেনি। তবু ভালো ওকে বাসতে পারেনি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮১: তথাকথিত পরিচয়হীন প্রতিভার মূল্যায়ন কী শুধুই সাফল্যের নিরিখে সম্ভব?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সুবিনয় জানে না, অজন্তা বেঁচে থাকলে ধীরে ধীরে ওকে ভালোবেসে ফেলত কিনা। তাহলে কি আর একজনের কাছে অপরাধী হয়ে যেত? জানেনা সুবিনয়। অজন্তা এই সংশয় থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে তাকে। অজন্তার শেষ কথাগুলো আবার মনে পড়ে। সুবিনয়ের হাত দুটো ধরে বলেছিল, “মনে মনে এত কষ্ট বয়ে বেড়াও! আমি বেঁচে থেকে কিছুতেই তা দূর করতে পারতাম না। আমি চলে যাচ্ছি। কোনও অভিমান নেই আমার। তুমি তো আমার কখনও অযত্ন করনি। আমার শেষ চাওয়া, তোমার বুকের ফাঁকা জায়গাটা যেন একদিন ভরে ওঠে।”
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সুবিনয়। নিচে প্রিয়ার গলা পেয়ে চমক ভাঙল। ওর পিসিমণিকে ফোন করে বলছে, “তুমি এখনও এলে না পিসিমণি! মা তো এখুনি এসে পড়বে।” মা বলে ছোটো থেকে কাউকে ডাকতে পায়নি তো, তাই সিদ্ধার্থের মাকে কী আন্তরিকতায় ‘মা’ সম্বোধন করছে! ভদ্রমহিলা নাকি খুব ভালো। খুব নাকি আপন করে নিতে জানেন। উনি যে ভালো, সিদ্ধার্থকে দেখলেই তা বোঝা যায়। মা ভালো না হলে ছেলে কি অত ভালো হয়! তার দুখি মেয়েটা খুব সুখী হবে… খুব সুখী হবে।—চলবে।
* শম্পা দত্ত সঞ্চালিকা ও আবৃত্তি শিল্পী।

Skip to content