শুক্রবার ৮ নভেম্বর, ২০২৪


চিকিৎসক আনন্দী গোপাল।

মহিলা ডাক্তারদের জীবনের গোড়ার কথা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম। একসময় তীব্র মেধা নিয়ে কাজ করতে চাওয়া মেয়েদের চিকিৎসক হতে চাওয়ার পথে কত বাধা এসেছে। আপনা মাংসে হরিণা বৈরির মতো মেয়েদের শরীর হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের কাজের বাধা। এখনও যে এই বাধা বিপত্তি নেই, তা নয়। তবু মেয়েরা প্রবল শক্তিতে কালাপানি পেরিয়েছে, ছিঁড়ে দিয়েছে অন্ধ কুসংস্কারের বাঁধন। রোগিনীদের জীবনের জন্যও দেশ বিদেশের অনেক মেয়ে নিজেদের সাধ্যের অতিরিক্ত লড়াই করেছেন। কখনও পুরুষ তাঁদের পাশে ছিলেন কখনও নয়। সব লড়াইয়ের শেষে জয় আসে নি। কিন্তু তবু সেইসব লড়াই ইতিহাস হয়ে রয়েছে।
সরস্বতীর লীলাকমল বিভাগ মহিলা লেখকদের গল্প বলে। লেখা মানে আবেগ, অভিব্যক্তি। আজ মনে হল মহিলা চিকিৎসকদের শুরুর লড়াইটাও জানা দরকার। আমি বলি আনন্দীকে নিয়ে। চিকিৎসক আনন্দী গোপাল!

মহারাষ্ট্রের আনন্দী বাইয়ের চিকিৎসক হবার গল্পটি খুব অন্যরকম। তাঁর জীবনের গ্রাফ একেবারেই আলাদা। যে সময় তিনি লিখছেন তখন পৃথিবীর কোনো দেশেই মহিলা চিকিৎসকদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ বলত ডাক্তার হবার জন্য মেয়েরা মর্যালি, সাইকোলজিক্যালি অ্যান্ড ফিজিক্যালি অনুপযুক্ত। রবীন্দ্রনাথও তাঁর লেখা ‘দুই বোন’ উপন্যাসে উর্মির ডাক্তারি পড়তে যাওয়ার ইচ্ছাকে ব্যঙ্গ করেছেন। তবু সব ব্যঙ্গ বিদ্রূপের ওপারে গিয়ে মেয়েদের এই লড়াই চলতে থাকে।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৪৩: প্রফুল্লময়ী— একটি বইয়ের লেখক এবং একটি জীবন ভরা ডিপ্রেশন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৮: মংপুর কমলালেবু পেয়ে অসুস্থ কবি খুব আনন্দ পেয়েছিলেন

১৮৬৫ সালে পুনের এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেছিলেন আনন্দি বাই। রূপ ছিল না সমাজের ট্যাবু মেনে। কাজেই ন বছর বয়সে তাঁর বিয়ে হয় ঊনত্রিশ বছর বয়সী বিপত্নীক গোপাল রাও বিনায়ক যোশীর সঙ্গে। গোপাল রাও এনলাইটেনড পার্টনার চেয়েছিলেন। কাজেই আনন্দী স্বামীর ইচ্ছেয় লেখাপড়া শিখলেন। আনন্দীর আসল নাম ছিল যমুনা। ১৮৭৪ সালে যমুনার নাম বদলে হল আনন্দী। পরিবারের ইচ্ছেয়!আনন্দীকে লেখাপড়া শেখানো, স্ত্রী সন্তান নিয়ে ঘুরতে যাওয়া গোপাল রাওয়ের নেশা ছিল। আনন্দীর দোটানা ছিল। একদিকে রক্ষণশীল মারাঠী অন্দরমহল অন্যদিকে স্বামীর উদারপন্থা। তবে কাজের কাজ হল বিদ্যাচর্চা।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৬৪ : অকারণে কেউ অন্যের ভালো করতে যায় না

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭০: ভানুপিসি ও শ্রীমার ভক্ত

মেধাবী আনন্দী দিব্যি লেখাপড়া শিখতে লাগলেন। বিদ্যালয়েও যেতেন। এইসময় তাঁর জীবনে ঘটে গেল দুর্ঘটনা। একমাত্র পুত্রসন্তান উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মারা গেল। ঠিক এইসময় থেকে আনন্দী শুরু করলেন চিকিৎসক হওয়ার সংগ্রাম। এইসময় আনন্দী পাশে পেয়েছিলেন স্বামীকে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে গোপাল রাও চেষ্টা চালাচ্ছিলেন স্ত্রীকে বিলেত পাঠানোর জন্য। শেষে অনেক যুদ্ধের পর আনন্দী একিই বিলেত গেলেন। সাহায্য পেলেন মিসেস কার্পেন্টার নামের এক বিদেশিনীর। ১৮৮৩ সালের ৭ এপ্রিল আনন্দী একাই বিদেশ গেলেন। জাহাজে নেটিভ বিশেষণ এবং অশালীন প্রস্তাবের সঙ্গে মোকাবিলা করে ঊনষাট দিন পর বিদেশের মাটিতে পা রাখলেন আনন্দী, আসলে যমুনা।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১০: ভার্জিনিয়া ও লিওনার্ড উলফ—উন্মাদনা ও সৃষ্টি /২

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

মহিলা পরিচালিত পেনসিলভ্যানিয়ার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন আনন্দী। স্কলারশিপ পাওয়া,আলোবাতাসহীন ঘরে কষ্ট করে থেকে লেখাপড়া করা, স্বদেশকে ভালোবেসে যাওয়া— সবকিছুর পর ১৮৮৬ সালে তিনি ডাক্তার হলেন। কিন্তু আনন্দীর লড়াই চলতে থাকলো। এইবার গোপাল রাও বিলেতে এলেন তাঁর একরাশ মেল ইগো নিয়ে। আনন্দীর সম্পর্কে এতটাও আশা করেন নি তিনি। ঈর্ষাপরায়ণতা তাঁদের সম্পর্কের ভাঙচুর ঘটালো। বিদেশে এসে বিদেশি মহিলাদের নিন্দা, অ্যালোপ্যাথি নয়, আয়ুর্বেদের প্রশংসা শুরু করলেন। যেন আনন্দীর সাফল্যকে ছোট করতেই যত আয়োজন। যাই হোক এম ডি আনন্দীকে সাদা বেনারসী পরিয়ে ভারতীয় গয়নায় সাজিয়ে পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন আরেক ভারতীয় চিকিৎসক রমা বাই।
আরও পড়ুন:

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭৩: সুন্দরবনের পাখি—কোঁচ বক

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৮৭: যুগধর্মের সমর্থনহীন ধর্মচিন্তার স্থান কোথায়?

তারপর? স্বপ্নের দিকে দ্রুত এগিয়ে চললেন চিকিৎসক আনন্দী। ঠিক যে জায়গা থেকে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়েছিল, সন্তানের মৃত্যুর পর সেখানেই চিকিৎসক হিসেবে ডাক পেলেন। কালাপানি পার হয়ে এসেছেন বলে মাঝে এসে দাঁড়ালো কুটিল রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজ। আপাতভাবে তাদেরই জয় হল। কারণ কোলাপুরে কাজে যোগদান করলেও যক্ষা আক্রান্ত হয়ে আনন্দী প্রাণ হারালেন। বিলেত যাওয়ার অপরাধে তাঁর চিঈিৎসাও কেউ করে নি। এইভাবেই এক লড়াকু মেয়ের লড়াই থামিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু সময় তাঁকে মনে রেখেছে। তাঁকে নিয়ে উপন্যাস লেখা হয়েছে। চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। তাঁর পৈত্রিক বাসভবন সংরক্ষিত হয়েছে। ইতিহাসের পাতায় আনন্দী এক লড়াইয়ের নাম। জীবনই তাঁর লেখা।
* ড. মহুয়া দাশগুপ্ত, শিক্ষক এবং লেখক। রবীন্দ্রনাথের দেবলোক, জোড়াসাঁকোর জার্নাল, আমি নারী আমি মহীয়সী, কথানদীর কূলে, লেডিজ স্পেশাল, পথে পুরুষ বিবর্জিত, পরীক্ষায় আসবে না এবং ভুবনডাঙার বাউল তাঁর লেখা একক বই। বাংলা কথকতা নিয়ে একক ভাবে কাজ করছেন।

Skip to content