রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

“অ্যাই মেয়ে তুই দুধটা ফেলে দিলি যে বড়? ভিক্ষে চাইতে এসেছিস, তার আবার এত দেমাক?”

সক্কাল সক্কাল মনোরমার চিৎকার শুনে অবাক হয়ে গেল সত্যব্রত। এমনিতে মনোরমা ঠান্ডা মাথার মানুষ এমন কেউ বলবে না, কিন্তু অকারণে সে রাগ করবে এমনটাও নয়। তার উপর এখানে তারা নবাগত। বিছানায় গড়াচ্ছিল সে। ওপাশে তাকিয়ে দেখল বিছানায় এখনও গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে, সত্যবান—তার ছেলে। তবে মেয়েটিকে দেখতে পেল না সে। বিবি নিশ্চয়ই উঠে পড়েছে এবং মায়ের কাছে ঘুরঘুর করছে। কোনমতে ঘুম চোখে উঠে এল। এসে দাঁড়াল বারান্দায়। দেখল কাঠের নড়বড়ে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। গায়ের রঙ মিশ-কালো, ঝকঝকে সাদা দাঁত, অদ্ভুত ক্ষুরধার চোখ-মুখ, সচরাচর এমন মুখ-চোখের গড়ন দেহাতিদের মধ্যে দেখা যায় না। মেয়েটিকে সে চেনে। নুনিয়া। মাঝেমধ্যেই কথা নেই বার্তা নেই হাজির হয়। পরণে একখানা সস্তার লাল গ্রাউন আর পকেটওয়ালা জীর্ণ ব্রাউন জামা। এটা ওটা দিলে খায় না। কিন্তু নিয়ে জামার পকেটে ঢুকিয়ে ফিক্‌ করে হেসে বলে, “থ্যাঙ্ক ইউ!”
প্রথম দিন শুনে হাঁ হয়ে গয়েছিল সত্যব্রত। এই মেয়ে যে কেউ কিছু দিলে বা উপকার করলে থ্যাঙ্ক ইউ বলতে হয়, তা জানে, বিষয়টা তার কাছে অস্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। তবে তার অবাক ভাবটা দূর হয়ে গিয়েছিল যখন কাজের দিদি ক্যাথরিন ললিতা সিং জানাল, মেয়েটি স্থানীয় মিশনারিদের অরফ্যানেজ হোমে থাকে। পাশের গ্রামেই বাড়ি ছিল ওদের। ওর মা-বাবা নেই। মিশনারিদের হোমে থাকে বটে, কিন্তু তাকে রাতদিন টো টো করে ঘুরে বেড়াতেই দেখে সবাই। ললিতা শুনেছে, নিয়ম না-মানার জন্য নুনিয়াকে এবার হোম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। মিশনারিদের দোষ দেওয়া যায় না। তারা প্রায় রাস্তা থেকে তুলে এনে না কি আশ্রয় দিয়েছিল। মিশনারিদের কাছে ইংরাজি শিখেছে কিছু মেয়েটি। ভারি দুরন্ত। একদম স্কুলে ক্লাস করতে চায় না। ওর বয়সীরা বছর বছর নতুন ক্লাসে উঠছে, সেদিকে ওর ভ্রূক্ষেপ নেই। ফাদার ওকে এত বকাঝকা করেন, তবুও ও স্কুলে ক্লাস করার ভয়ে পালিয়ে ঘোরে এদিক ওদিক। প্রায়ই ওর খোঁজে মিশনারিদের পাঠানো লোকজন এদিক ওদিক ঘোরে। এক-একদিন পড়ার ভয়ে লুকিয়ে থাকে সারা দিনরাত। হয়তো ফিরল, পরের দিন ভোরের বেলায়।

সত্যব্রত অবাক হয়ে বলল, “তুমি এত কিছু কী করে জানলে?”

“জানব না?” হাসল ললিতা, “আমার ছ্যানাটাও তো ফাদারের ইস্কুলে পড়ে, ওরই কেলাসে ছিল আগে। এখন যদিও সে উঁচা কেলাসে উঠে গিয়েছে। কিন্তু ওই নুনিয়া সেই যেখানে ছিল, সেখানেই পড়ে আছে।”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮: ‘বাইরে বেরুলেই বিপদ!’

উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১১: রাত বাড়লে গুলি-বোমার শব্দ, দরজায় অচেনা লোক এলে সন্দেহ হতো

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৪২: বাস কোথা যে পথিক — এবার কি গন্তব্য সুতীক্ষ্ণমুনির আশ্রম?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩০: দিনের পরে দিন গড়ে যায় ‘বিধিলিপি’

সত্যব্রত তাকাল নুনিয়ার দিকে। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের কাছে একখানা কলাই করা গ্লাস পড়ে আছে। মনোরমার কটুবাক্য শুনে সে মনে মনে অনুশোচিত না কি থড়াই কেয়ার, মেয়েটির মুখ দেখে তা বোঝার উপায় নেই।

সত্যব্রত মনোরমাকে থামতে বলল, “বাচ্চা মেয়ে। কোনও কারণে পড়ে গিয়ে থাকবে। অ্যাই নুনিয়া, আর কোনওদিন দুধ ফেলবি না। জানিস, দুধের কত দাম। তোর মতো কত বাচ্চা দুধে খেতে চেয়েও পায় না!”

মাথা নাড়ল নুনিয়া। জানে সে। তারপর দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলল, “স্যরি আন্টি। আই ডোন্ট ডু দিস এগেইন।”

মনোরমা তবুও গর্জাচ্ছিল। সত্যব্রত বলল, “নুনিয়া যখন বলেছে আর করবে না, ওকে তোমার ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। এই নুনিয়া, লজেন্স খাবি?”

নুনিয়া মাথা নাড়ল। খাবে না।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫: জনমেজয়ের সর্পমারণযজ্ঞ — একটি সাধারণ সমীক্ষা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৯: মিশ্র মাছচাষ পদ্ধতিতে শুধু ফলন বাড়েনি, মাছের বৈচিত্রের সমাহারও নজর কেড়েছে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৭: কবির লেখা, লেখার গল্প

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

এমন সময় ললিতা পিছন থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “ও মিষ্টি জিনিস একেবারে পছন্দ করে না। সারাদিন কেবল নুন চেটে খায়। নোনতা জিনিস পেলে তক্ষুনি খেয়ে ফেলবে। সেই কারণেই তো ওর নাম নুনিয়া বাবু। দেখবেন? অ্যাই নুনিয়া, নিমকি খাবি?”

নিমকির কথা শুনে নুনিয়ার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘাড় কাত করে জানাল খাবে। তারপরেই হাত পেতে দাঁড়িয়ে রইল।

ললিতা বলল, “দেখলেন।” বলে রান্নাঘর থেকে দুটো নিমকি নিয়ে এসে বাগানের গেটের দিকে এগিয়ে গেল। নুনিয়ার হাতে নিমকি দুটো দিতেই সে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরয়ে দেখতে লাগল, যেন কতই না দুর্লভ জিনিস পেয়েছে। তারপর একটার একটুখানি ভেঙে মুখে দিয়ে খেতে লাগল। তারপরেই “থাঙ্কি ইউ” বলে ছুটে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

মেয়েটাকে যা ভেবেছিল, তা নয়। হয়ত দুষ্টু, লেখাপড়া করে না, কিন্তু সহবৎ জানে। নিমকি হাতে নিয়ে সে কারণেই ‘থ্যাঙ্কি ইউ” দিতে ভুলল না। আহা, হোমে হয়ত তার দুষ্টুমির জন্য ভালো করে খেতেই পায় না। সত্যব্রত বলল, “ললিতা, তুমি ওকে দুপুরে ভাত-মাছ যা হবে একটু খেতে দিও। বলে দিও, ও যেন দুপুরে এসে এখানে খেয়ে যায় আজ। ওকে দেখে তো মনে হয় ভালো করে খাবার জোটে না!”
আরও পড়ুন:

হেলদি ডায়েট: দ্রুত রোগা হতে চান? ভরসা রাখুন সুপারফুড ডালিয়াতে

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৫: আরডি-র ‘লাকড়ি কি কাঠি কাঠি পে ঘোড়া’ আজও ছোটদের মধ্যে সমানভাবে জনপ্রিয়

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৪: গরম পড়েছে, যত পারুন ঠান্ডা খান! কী হচ্ছে এর ফলে?

জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ/২

ললিতা হাসল, “যার মা-বাপ নেই, পরের দয়ায় মানুষ, তার অমনই হাল হয় সাব। আর নুনিয়াকে যে দুপুরে খাওয়ার কথা বলব, তাকে পাচ্ছি কোথায়? সে কী আর এক জায়গায় থাকে? দেখুন গিয়ে কোথায় হয়তো পাশের গ্রামে, কিংবা তারও পাশের গ্রামে, নয়তো জঙ্গলে গিয়ে হুটোপাটি করছে। ওকে খাওয়ানোর উপায় নেই সাব।”

“এত দুরন্ত তো ঘরে আটকে রাখতে পারে। আমার তো মনে হিওয় বোঝালেই বুঝবে।”

“আর কবে বুঝবে সাব? ফাদাররা অনেক চেষ্টা চরিত্তির করেছে। কিন্তু ও কি আর শোনবার পাত্র?”

“ওহ্‌!”

“আর ও মানুষ তো নয়, গেছো বাঁদর ছিল আগের জন্মে। এমন গাছ থেকে গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে বাইতে পারে, দেখলে সকলে তাজ্জব হয়ে যায়! গোটা জঙ্গল নিমেষে ঘুরে আসে। গাছ তো বায় না, যেন উড়ে যায়!”

সত্যব্রত হাসলেন। টারজানের গল্প! সত্যি মানুষ মুখে মুখে কত কী গল্প বানাতে পারে। হয়তো মেয়েটা দ্রুত গাছে চড়তে পারে, মানুষ সেটাকে বানিয়ে দিল যে মেয়েটি গাছ থেকে গাছে লেডি টারজান হয়ে জঙ্গলের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে বেড়ায়। যত সব রাবিশ! তবে মেয়েটি বেশ ইন্টারেস্টিং। তাকে নিয়ে ভাবার আছে। কিন্তু এখন আর সেই সময় নেই। পরে ভাবা যাবে ক্ষণ।

সত্যব্রত আর দাঁড়াল না। তাকে রেডি হতে হবে। অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে আজ।—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content