মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

অরণ্য তখন তার ঘরে দেওয়ালজোড়া আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছিল। তৃধা স্নানঘরে। তার মিহিন গলার গান ভেসে আসছে। সে চেয়েছিল একসঙ্গে স্নান করতে। কিন্তু ঝরনার ধার থেকে ফিরে আসা ইস্তক তৃধার মেজাজ কেমন তিরিক্ষি হয়ে গিয়েছিল। সে সঙ্গে সঙ্গেই নাকচ করে দিয়েছিল সে প্রস্তাব। অরণ্য বুঝেছিল, এখন তাকে রাজি করানো আসম্ভব। অতএব, তৃধা স্নানঘরে ঢুকতেই সে প্রথমে মোবাইলে মন দিয়েছিল। একটা পপুলার সোশ্যাল সাইটে সে নিজের ফোটো, রিল ইত্যাদি শেয়ার করে ভালোই রোজগার করে। তার ফলোয়ারের সংখ্যা কিছুদিন হল পঁচাত্তর হাজার ছাড়িয়ে গিয়েছে। একটা নতুন পোস্ট করলেই হাজার খানেক শেয়ার নিমেষেই হয়ে যায়। আজকাল যুগ বদলেছে। কেবল যে-সব মেয়েরা স্বল্পবসনা হয়ে ফোটো শেয়ার করে, পোস্ট দেয়, তারাই নয়, স্বল্পবাসের পুরুষশরীরেরও অসংখ্য লাইক পড়ে, শেয়ার হয়। একটা ওইরকম ছবি পোস্ট করতে পারলে ফলোয়ারের সংখ্যাও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে জিম টোনড ছেলেদের শরীর দেখতে চায় নারী থেকে সমকামী কিংবা উভকামী পুরুষেরাও। নানা অশ্লীল কমেন্টস করে তারা তাদের অবদমিত কামেরও তৃপ্তি পেতে চায়।

প্রথম প্রথম অরণ্য এইসব ব্যাপারে অস্বস্তি বোধ করলেও, এখন সে পুরোপুরি মুক্তমনা। ফলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেমি ন্যুড সেলফি তুলে পোস্ট করতে সে এখন আর লজ্জা পায় না। বরং প্রতিটা ফোটোশ্যুট কীভাবে বোল্ড হবে, কীভাবে অনেক ভিউয়ার পাবে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। টনি বলে তার জিমে এক ফোটোগ্রাফার ওয়ার্কয়াউট করতে আসে, সে অরণ্যর বেশ কয়েকটি ফোটো সেশন করে দিয়েছে। তার নিজস্ব ‘হট চিলি ফোটোগ্রাফি’-র ট্যাগ-সহ সে-সব পোস্ট ওই বিশেষ সোশ্যাল অ্যাপে রীতিমত ঝড় তোলে। সেখানেই অরণ্যর প্রথম ন্যুড ফোটশ্যুট পোস্ট করা হয়। ফ্রন্টাল ন্যুডিটি নয়, তবে সেমি নিউড পোস্ট, তাতেই তার ইনবক্স ভরে উঠেছিল মেসেজের পর মেসেজে। ভিউয়ারের সংখ্যাও রাতারাতি হাজার দুয়েক বেড়ে গিয়েছে। এ নিয়ে মনে মনে তার ভালো লাগা ও অহংবোধের সীমা নেই।

এখন তো অনলাইনে ওয়ার্ক আউট, ট্রেনিং ইত্যাদির কাজও চলে। অরণ্য অবশ্য এর জন্য নির্দিষ্ট একটা সাইট খুলেছে। সেখানে বেশ কয়েকজন ট্রেনার আছে, যারা তার জিমের সঙ্গে যুক্ত, তারাই অনলাইন ট্রেনিং দেয়। অরণ্য নির্বাচিত কয়েকজনকে কেবল অনলাইন ট্রেনিং দেয়। তারা সকলেই অর্থবান এবং তার ভাষায় ‘স্পেশাল’।
এই ক’দিন অবশ্য তাদেরকেও অনলাইন ট্রেনিং দেওয়ার কোনও গল্পই নেই। সকলেই জানে, অরণ্য শর্ট ট্রিপে এখানে এসেছে। সকালবেলা তোলা ভিডিও ইতিমধ্যেই লাইক ও শেয়ারের ভিড়ে জমজমাট। অরণ্য এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অন্য কিছু পোজে সেলফি তোলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু কোনওটাই মনঃপূত না হওয়ায় মাঝেমধ্যেই ‘ডিসগাস্টিং’, ‘হোপলেস’, ‘নাথিং স্পেশাল’ ইত্যাদি শব্দ অস্ফুটে বলছিল। আয়নার উল্টো দিকেই ওয়াশরুমের দরজা। যেটা এখনও বন্ধ এবং সেখান থেকে মাঝেমধ্যে তৃধার গাওয়া গানের কলি ভেসে আসছে। হঠাৎ করেই তার কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। কেউ যেন দেখছে তাকে? যেন তার প্রতিটি কাজ মেপে নিচ্ছে সতর্ক দৃষ্টি মেলে। কিন্তু এই ঘরে এখন সে একা, আর ওয়াশরুমে তৃধা ছাড়া আর কেউ নেই। বারান্দার দিকের দরজা বন্ধ। কাঠের পাল্লা, উপর দিকে যদিও গ্লাস লাগানো আছে, তবে ভিতরের দিক থেকে সেই জায়গায় পর্দা টানার ব্যবস্থা আছে। এখানে প্রচণ্ড গরম পড়ে, সে সময় দুপুরবেলা বোর্ডারের যাতে অসুবিধে না হয়, সেই জন্যই এই ব্যবস্থা। সেটাও এখন টানা। তাহলে এটা কী তার নিছকই মনের ভুল। নাহলে কে দেখবে তাকে? কেনই বা দেখবে?
আরও পড়ুন:

পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭: ওখানে কে?

বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-১০: অমিতাভদাকে মাস্টারমশাই হিসেবে নয়, আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিল বাবুদাদা

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৩: বাইগা বস্তি হয়ে ভোরামদেব মন্দির

সে ডিভানের ধার, কাবার্ড সব খুঁটিয়ে দেখল, কিন্তু কেউ নেই কোথাও। থাকবার কথাও নয়। সাদা দেওয়ালে কোথা দিয়ে সার সার কালচে লাল পিঁপড়ে বাইছে, নিশ্চয়ই এ ঘরের কোথাও বাসা আছে তাদের। অবশ্য তাদের সকলের রুকস্যাকেই শুকনো খাবার কিছু থাকে। তার লোভেও তারা জুটতে পারে। দেখে নেওয়া দরকার যদিও এখন তার ইচ্ছে করল না। কাল সকালে দেখলেই হবে। আচ্ছা, রাত্রে যে ক্যাম্পফায়ার আছে, হুল্লোড় হবে, কই তার জন্য কেউ তো ডাকছে না? সকলেই এখনও ঘুমাচ্ছে না কি? ভাবল অরণ্য। পরমুহূর্তেই ভাবল, ধ্যুস, ডাকবে যখন তখন দেখা যাবে। আপাতত ইচ্ছে করছে না। বরং একটা ক্যান বিয়ার সাবাড় করা যেতে পারে। তার জন্য সে ঝুঁকে পড়ে তার রুকস্যাক হাতড়াচ্ছিল। সে যদি দেওয়ালের দিকে দেখত, তাহলে দেখতে পেত, সার সার লালচে পিঁপড়েরা এক জায়গায় জড়ো হয়ে একটা বীভৎস মুখের আদল ফুটিয়ে তুলছে। আর ওরা কেউ পিঁপড়ে নয়, ওরা হল…!

উন্মেষা অঞ্জনকে বলল, “জান, আমার কেমন একটা ভয় ভয় করছে!”

“ভয়? কেন ডার্লিং? আমি থাকতে ভয় কিসের? ম্যায় হুঁ না!” বলে তাকে হাত দিয়ে কাছে টেনে অঞ্জন তার বুকে মুখ ডলার চেষ্টা করে।

উন্মেষা তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল, “আই অ্যাম সো টায়ার্ড জান। এখন এসব ভালো লাগছে না।”

“ওকে, ওকে, সরি,” অঞ্জন স্যারেন্ডার করে, “কিন্তু কিসের ভয় তা তো বললে না?”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৪: পঞ্চমকে সিনেমা হলে বসিয়েই বেরিয়ে যান রীতা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

“আমার কেবল মনে হচ্ছে, কিছু যেন একটা ঘটতে যাচ্ছে, কিন্তু তুমি-আমি-আমরা কেউই জানি না সেটা কী? তুমি তো জানো অঞ্জন, এ-ব্যাপারে আমার একটা আলাদা সাবকনশাস ফিলিং আছে। হিরণ্ময়ের অ্যাকসিডেন্টের আগেও ঠিক এমনই মনে হয়েছিল। কিছু একটা ঘটবে, ভয়ানক কিছু, কিন্তু সেটা যে কী তা ধরতে পারিনি। তাও আমি হিরণ্ময়কে বলেছিলাম, ও অমূলক চিন্তা বলে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর যা ঘটার তা ঘটল। সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল, আমি কিন্তু পুরোপুরি হইনি। কেন না, আমি মনে মনে খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। হ্যাঁ, সেটা নিশ্চয়ই হিরণ্ময়ের ওরকম একটা ডেথ নয়, তা যদি জানতাম, তবে কি আমি তাকে যেতে দিতাম? তবুও…! আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। আবার যেন কী ঘটবে?”

অঞ্জন কিছু জবাব দেওয়ার আগে কেউ একজন দরজায় নক করল। ওরা দুজনেই ফ্রেস হয়ে ঘরোয়া পোশাক পরে বসেছিল। দরজায় নকের আওয়াজ শুনে অঞ্জন উন্মেষার দিকে তাকাল।

উন্মেষা বলল, “নিশ্চয়ই অরণ্যরা। যাও, খোলো। ওদের নিচে নামতে বলো, আমরা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে যাচ্ছি।” বলে সে উঠল। কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। কোন পোশাক পরে সে আর অঞ্জন রাতের পার্টিতে যাবে, তা আগেই সে বার করে রেখেছিল।

অঞ্জন দরজা খুলেই চমকে গিয়ে অবাক হয়ে বলল, “আরে অরণ্যরা নয় তো ? অ্যাই, কে তুই?”

অরণ্যরা নয়! তবে কে? রুম বয় না কি? কিন্তু তারা তো এক কাপ কফির অর্ডার করেছিল। সে কখন দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাপ-প্লেটগুলি নিয়ে যেতে ছেলেটি এলেও তাকে তো অঞ্জন চেনে। কে রে বলে জিজ্ঞাসা করার কথা নয়! কৌতূহলী হয়ে উন্মেষাও দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দেখল দরজার বাইরে আবলুশ কাঠের মতো কালো আর রোগা একটি বাচ্চা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বছর বারো কি চোদ্দ বয়স হবে। পরনে একখানা মলিন ফ্রক। মাথার চুল রুক্ষ কিন্তু দীর্ঘ, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। খালি পা। কেমন একটা ফ্যাকাশে রক্তহীন গায়ের রং। করিডোরের হলুদ বাল্বের আলোয় আরও অস্বাভাবিক লাগছিল তাকে। মেয়েটি বাচ্চা। তবে এই বয়সেই তার মুখখানা কেমন একটু কঠিন, লাবণ্য বলে যে বস্তু থাকলে এই বয়সের মেয়েরা আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, এই মেয়েটি যেন তার ব্যতিক্রম। কাটা কাটা চোখ-মুখ, তবে ঈশ্বর যেন একে বানানোর সময় লাবণ্য দিতেই যেন ভুলে গিয়েছিলেন। তবে মেয়েটির চোখ দু’টি বড় আর বাঙময়। আর সেই সঙ্গেই ক্ষুরধার। মিছরির ছুরি যেন।
আরও পড়ুন:

দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি

স্বাদে-আহ্লাদে: খুদের টিফিনে কী দেবেন ভেবেই মাথায় হাত? ঝটপট বানিয়ে ফেলুন মুগ ডালের চিল্লা!

পেটের ব্যথাকে একেবারেই অবহেলা করবেন না / পর্ব- ১

অঞ্জন আবার রুক্ষ স্বরে বলে উঠল, “অ্যাই কে তুই? ইয়ে সব বেগার কো কৌন ঘুসনে দেতা ইহাঁ? হাম আভি বুলাতা হুঁ কাপাডিয়া কো!”

উন্মেষা অঞ্জনকে শান্ত করল, “আরে, ছাড় না। অভাবী মানুষদের বাস এসব জায়গায়। সব সময় কি আর দরজার দিকে চোখ তাকিয়ে বসে থাকে কেউ? কোনওভাবে ঢুকে পড়েছে, টাকাকড়ি কিছু চায় হয়ত। খিদেও পেতে পারে। দেখে তো মনে হচ্ছে, ভালো করে খাওয়া জোটে না। অপুষ্টিতে ভুগছে। কিছু পয়সাকড়ি হাতে দাও, চলে যাবে। ফালতু এটাকে ইস্যু করে তুলো না!”

অঞ্জন রাগে গজরাতে গজরাতে পার্স আনতে গেল।

উন্মেষা ভাব জমানোর কায়দায় বলল, “কী রে, কত চাস? দশ টাকা? বিশ টাকা? না কি পঞ্চাশ?”

মেয়েটি মাথা নাড়ল।

উন্মেষা অবাক হয়ে গেল, “তুই টাকা চাস না?”

আবারও মাথা নাড়ল মেয়েটি।

“তাহলে? তুই কে? কী চাস এখানে?” অঞ্জন এগিয়ে এসেছে আবার উন্মেষার কথা শুনে।

“আমি টাকাকড়ি কিছু চাই না !”

“তাহলে? অ্যাই তুই চোর-ছ্যাঁচোড় নয় তো?” অঞ্জন গর্জে ওঠে যেন।

“না না। আই অ্যাম নট আ থিপ। আই অ্যাম নুনিয়া!”

“ওহ মাই গড! তুই আবার ইংরাজি জানিস?”

“নট ভেরি মাচ, আ লিটল বিট!”

“নাও দেন ইউ টেল মি, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?” অঞ্জন বলে, “কেয়া চাহতি হ্যায় তু?”

“বাইরে বেরুলেই বিপদ!”

“মানে?” একযোগে দুজনেই চেঁচিয়ে ওঠে।

নুনিয়ার মুখ ভাবলেশহীন। সে আবারও আওড়ায়, “বাইরে বেরুলেই বিপদ!” তারপর এক দৌড়ে সেখান থেকে চলে যায়।

অঞ্জন আর উন্মেষা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মেয়েটা কী সাবধান করে গেল, না কি ভয় দেখিয়ে গেল? বাইরে বেরুলেই বিপদ? কিন্তু কিসের বিপদ? কার বিপদ?—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content