শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

সারাদিনের ঘটনায় পূষণ ও রিমিতা দুজনেই খুব ক্লান্ত ছিল। যদিও বাথরুমে গিজার আছে, কিন্তু যেহেতু এখানে রাতে পাওয়ার কাট হয়, থাকলেও ভোল্টেজ লো থাকে, ফলে গরম জলের ব্যবস্থা আলাদা করে রাখতে হয়। ম্যানেজার ওদের জন্য এত রাতে সে ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সারাদিন যদিও খাওয়া হয়নি, কিন্তু এত কিছুর পরে ওদের শরীরে আর খিদে নামক বস্তুটাই ছিল না। অন্তত তার কোনও তাগিদ ওরা অনুভব করতে পারছিল না। যদিও কাপাডিয়া রোস্টেড চিকেন, চিজ গার্লিক ব্রেড আর ফ্রুটস কাস্টার্ড পাঠিয়ে দিয়েছেন ওদের জন্য। ওরা ফ্রেশ হয়ে কিছু মুখে দিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিয়েছিল। এঁটো বাসনপত্র কাল সকালে লোক এসে নিয়ে যাবে। এত রাতে আর তাদের বিরক্ত করবে না কেউ, এই আশ্বাস দিয়ে ‘গুড নাইট’ জানিয়ে চলে গিয়েছিলেন কাপাডিয়া।

পূষণ শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। আজকের এই রাতটার জন্য কত কিছু পরিকল্পনা করেছিল সে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। সে রিমিতার দিকে তাকাল। পাশ ফিরে শুয়ে আছে রিমিতা। ঘরে একটা জিরো পাওয়ারের নাইট বাল্ব জ্বলছিল। সেই আলোয় দেখতে পেল রিমিতার চোখ বন্ধ, মাথার চুল ছড়িয়ে আছে, কিছু মুখের উপর এসে পড়েছে। গায়ে একটা সাদা রাতপোষাক। পূষণ জানে তার নীচে কিছু নেই, কোনও অন্তর্বাস কিংবা আর কিছু। অন্য সময় হলে এই শরীরের আকর্ষণে সে উন্মত্ত হয়ে উঠতে দেরি করত না। তার নিজের পরনে নেভি-ব্ল্যু বক্সার ব্রিফ আর রাউন্ড নেক টি’জ। খুলে ফেলতে এক মিনিটও লাগবে না তার। কিন্তু সে উত্তেজনা অনুভব করলো না। লিঙ্গ অনুত্তেজিত অবস্থায় আছে, শরীরের কোনও তাগিদ সে অনুভব করছে না আপাতত। বরং রিমিতার জন্য তার মায়া হচ্ছিল।
সারা রাত ট্রেন জার্নি করে তারপর ক্লান্তিকর বাসযাত্রা আর রাস্তায় ঘটে যাওয়া বীভৎস সেই ঘটনা—রিমিতার দেহ-মন একেবারে ভেঙে পড়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। এবারের ট্রিপে এই রকম একটা অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হবে, এ তো তাদের দু’ জনের কারও কল্পনাতেও আসেনি কখনও। তারপর থানায় অকারণ হ্যারাস করা। যত খারাপ অভিজ্ঞতা কি আজকেই হতে হল? মনটা অসাড় হয়ে আছে। সারাদিনের ঘটনাগুলির কথা মনে পড়লেই পূষণের মাথার মধ্যে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। বিছানায় শুয়ে থাকতে পারলো না সে। উঠে পড়ল। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে ধীরে ধীরে বারান্দার দিকের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এল।

এখানে প্রতিটি রুমের সঙ্গেই একটা ছোট বারান্দা রয়েছে। বারান্দায় দু’টি করে চেয়ার, একটি ছোট টেবিল, তার উপরে অ্যাসট্রে, একটা গ্লাস উল্টে রাখা। বারান্দার সামনের অংশে সিলিং থেকে ঝোলানো টবে বাহারি গাছ। চারপাশ থমথম করছে। বাতাসে হিমের স্পর্শ। সিগারেট ধরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে সামনে তাকাল সে। কম্পাউন্ডের পিছন দিকে ডান দিক ঘেঁষে সার সার চারটি একই প্যাটার্নের ঘর। এখন সব দরজা-জানালা বন্ধ। তারও পরে কুয়োতলা। সেখানে জলের মতো তরল অন্ধকারে একখানা বালতি রাখা আছে দেখতে পেল সে। আকাশে চাঁদ উঠেছে, যদিও কুয়াশার জাল ভেদ করে তার আলো ফ্যাকাশে ভাবে এসে পড়েছে চারদিকের চরাচরে। একটু দূরেই বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরে প্রাচীন বনস্পতিরা দাঁড়িয়ে রাত ফুরানোর অপেক্ষা করছে। অনেক দূরে টিলা আছে, যদিও এই অন্ধকার আর কুয়াশার প্রেক্ষাপটে তা চোখে পড়ছে না এখন। বাতাসে মাদকতাময় অজানা সৌরভ ভেসে বেড়াচ্ছে। কেমন যেন মাথা ঝিমঝিম করা তার আবেদন। মাথাটা একবার ঝাঁকিয়ে সেই নেশা কাটানোর চেষ্টা করল পূষণ। সারাদিনের কথা ভাবার চেষ্টা করল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২০: জীবন্ত লাশ?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

আজ সারাদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে তার মনে অনেকগুলি প্রশ্ন জেগেছে। এই প্রশ্নগুলি তার নিজের কাছে সঙ্গত হলেও এগুলি সে কাকে জিজ্ঞাসা করবে বা অন্তত যাকে শেয়ার করা বলে, তা করবে সে বুঝে উঠতে পারছে না। আদৌ জিজ্ঞাসা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে কি না সেটাও ভাববার বিষয়। সে যা হয় দেখা যাবে ভেবে এখন আবার তার মনে জেগে ওঠা প্রশ্নগুলিকে এক, দুই করে সাজানোর চেষ্টা করল সে।

প্রথম যেটা তার মনে হয়েছে, সেটা হল, ঘটনাটা ঠিক কখন ঘটেছে? যদি ধরে নেওয়া যায় বাস আসবার সামান্য আগেই ঘটেছে, তাহলে যখন ঘটনাটা ঘটছে, তখন দিনের আলো ছিল। এটা প্রধান সড়ক। যে কোনও মুহূর্তে যে-কেউ চলে আসতে পারত। কালাদেও কিংবা অন্য আততায়ী কি সেটা মাথায় রাখেনি? না কি বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল কোনও কারণে? চিতা হলে অবশ্য আলাদা কথা। কিন্তু চিতাই যদি হবে তবে মঙ্গল “ওটা কী?” বলে চেঁচিয়ে উঠল কেন? মঙ্গল কি চিতা চেনে না?

দ্বিতীয় ব্যাপারটা হল, মঙ্গল মাহাতো কি সত্যিই কিছু দেখেছিল? না কি, সেটা ছিল তার চোখের ভুল? এটা একটা ভাইটাল প্রশ্ন বলে মনে হল তার।

তৃতীয়ত, ভিকটিম শহুরে লোক বলে মনে করছেন সেকেন্ড অফিসার সুদীপ্ত। কিন্তু তার পরিচয় জানা যাবে কী করে? ওই জুতো-জামা দেখে? না কি, যাতে তার পরিচয় জানাটা সহজে না হতে পারে, এই জন্যই কায়দা করে তার মাথাটাকেই ‘নেই’ করে দেওয়া হয়েছে? অন্যত্র খুন করে এখানে এনে মাথা থেঁতলে ফেলা রাখা হয়েছে, যাতে তার আসল পরিচয় কোনোদিন জানা না যায়! এমনটা কী হতে পারে না?
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬২: মাছের পোনার পুষ্টির গুণমান ও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে নিশ্চিত আয় সম্ভব

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৯: মোহাবিষ্ট মায়াবী কণ্ঠস্বর, চেনা বলার ঢং, তবে কি মোহিনী?

পরের প্রশ্ন যেটি জেগেছে, সেটি হল— যে বাসযাত্রী কয়েকদিন আগে জঙ্গলে চিতা দেখার কথা বলেছিল, তার কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে চিতা কীভাবে মাথায় আক্রমণ করে সেটাকে একেবারে থেতলে দিলো? সেকেন্ড অফিসার সুদীপ্ত মনে করেন, ভিকটিম শহুরে এবং বাইকে করেই এসেছিল। সেই বাইকটা যদি কোথা পাওয়া যায়নি, তবে জঙ্গলের দিকে পরে একখানা হেলমেট খুঁজে পেয়েছিল পুলিশের লোকজন। অতএব সুদীপ্তের অনুমান যে সঙ্গত তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেউ যদি ইচ্ছে করে ঘটনাকে নিজের মতো করে সাজানোর জন্য একটা হেলমেট এনে ফেলে রেখে যায়, তাহলে?

ঈশ্বরীপ্রসাদ লোকটি সুবিধের নয়। এই গণ্ডগোলের সুযোগেও সে তার মন্দিরের প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল। সে কী সত্যিই কাউকে জঙ্গলে ঢুকে পড়তে দেখেছিল? না কি সমস্তই তার মনগড়া?

পূষণের বেশ ভালো লেগেছে, ভবানীপ্রসাদ রায়কে। সহজ-সরল মানুষটি। চেহারা এবং কথাবার্তাতেও শিক্ষাদীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। ইতিহাসের শিক্ষক। আঞ্চলিক ইতিহাস, মিথ, কিংবদন্তী সম্পর্কে বিশেষরূপে ওয়াকিবহাল। খোঁজখবর রাখেন আরও নানা বিষয়ে। তবে এখানকার বাকি মানুষজনের মতো কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নন। সংস্কারকে শ্রদ্ধা করেও চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে অপারগ। আসবার সময় মানুষটি নিজের ঠিকানা জানিয়েছিলেন তাকে। বলেছিলেন, পারলে দেখা করতে। তাঁর সেই ঠিকানা এবং ফোন নম্বর নিজের ফোনে সেভ করে রেখেছে সে। এই সব ঘটনার পর ঘটনার মধ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করা হয়তো হয়ে উঠবে না, কিন্তু ফোনে কথা তো বলা যাবে!
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৩: ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ

হাতের সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছিল। সে দিকে খেয়াল ছিল না পূষণের। আঙুলে ছ্যাঁকা লাগতেই তাড়াতাড়ি সে টেবিলের উপর রাখা অ্যাসট্রেতে সেটা ফেলে দিল। তারপর ঘুরে বাইরের দিকে তাকাতেই তার শরীর শক্ত হয়ে গেল। এক ঝলকের জন্য দেখল সে, একটা কালো কাপড়ে ঢাকা কেউ বা কিছু যেন বাউণ্ডারি ওয়ালের উপর দিয়ে উড়ে ওপারে চলে গেল। চোর না কি? কিংবা খুনি? পুলিশের চর? কিন্তু অমন করে কোনও মানুষ উড়ে যেতে পারে? স্কুলজীবনে পড়া ড্রাকুলার গল্পের কথা মনে পড়ে গেল তার। রাত্রি নামলেই বাদুড়ের রূপ ধরে ড্রাকুলা হানা দিত শিকারের উপরে এবং তখন সে মনুষ্যমূর্তি ধারণ করত। দিনের পর দিন শ্বদন্ত দিয়ে রক্তপান করে ছিবড়ে করে দিত শিকারকে। শিকারের মৃত্যু ঘটত। কোনও কোনও শিকার নিজেই হয়ে যেত ভ্যাম্পায়ার। সেই রকম কিছু না কি? আচ্ছা, কালাপাহাড় নয় তো? তাহলে কি কাল সকালেই তারা শুনতে পাবে, এই রিসর্টের কেউ রাতে মারা গিয়েছে। কিংবা কালাদেও তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছে। সকালে তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! নিজেই আবার মাথা ঝাঁকিয়ে নাকচ করে দিল কালাদেওর তত্ত্ব। ওই সব বুজরুকি এই একবিংশ শতাব্দীতে খুব কম জনেই বিশ্বাস করবে। আসলে আজ বিকেল থেকে এত বার সে কালাদেওর গল্পের মুখোমুখি হয়েছে যে, তার মাথায় সবসময় ওই নামটিই ঘুরছে। চিন্তিত মুখে সে বেড রুমের দিকে ফিরল।

বাউন্ডারি ওয়ালের গা ঘেঁষে থাকা ঝাঁকড়া গাছটার ডালপাতার আড়াল থেকে দুটি গোপন চক্ষু তাকে যে জরিপ করছিল, তা সে জানতেও পারল না।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content