শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

পরের দিন সকাল হতে না হতেই চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল সত্যব্রতর। ঘুমচোখে মোবাইল হাতে নিয়ে সে সময় দেখল, ভোর চারটে দশ। এখানে এখনও ভোরের দিকে ভালোই ঠান্ডা পড়ে। গায়ে কম্বল না চাপিয়ে শুয়ে থাকা যায় না। এই আদুরে ঠান্ডায় কম্বলের তলা থেকে বেরুনো কষ্টকর। কিন্তু ডাক্তারদের জীবনে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। এখানে যদিও বিরল, তবে আগে যে হেলথ সেন্টারে ছিল সেখানে রাতবিরেতে প্রায়শই পেশেন্ট পার্টি এসে হাঁকডাক করত। তার মধ্যে বেশিরভাগ লেবার-পেইনের কেস। পাশেই বাচ্চাদের নিয়ে মনোরমা ঘুমাচ্ছে। সে দেখল সামান্য বিরক্ত মনোরমা পাশ ফিরে শুল। বাচ্চারা অবশ্য অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সে কোনরকমে একখানা আলোয়ান গায়ে জড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে এল।

বাইরে তখন গোবিন্দ, রেশমা এবং শেফালিকাদি তিন জনেই উদ্বিগ্ন এবং ভয়ার্ত মুখে দাঁড়িয়েছিল। সে একটু অবাক হল। এই হেলথ্‌ সেন্টারে তেমন রোগী আসে না বলে, রাতবিরেতে কারও তেমন ডিউটি থাকে না। কেবলমাত্র লগবুক ঠিক রাখার জন্য দুজন নার্সের কোন একজনের নাম এন্ট্রি করা হয়। তবে রাতবিরেতে কেউ এসে পড়লেও অসুবিধা নেই। তাঁরা দুজনেই যেহেতু সেন্টারের বাউন্ডারির মধ্যেই কোয়াটার্সে থাকেন, অতএব তাঁদের ডেকে নিলেই হল। কিন্তু কালকের ব্যাপারটা অন্য। কাল বুধন এখানে বেডে ভর্তি ছিল। অতএব, তার জন্য একজন কাউকে থাকতেই হত। রেশমা স্বেচ্ছায় নিজেই ডিউটি নিয়েছিল। সে একাই থাকে।

শেফালিকাদির বয়স হয়েছে, তার উপর ভাইঝি আছে। তাছাড়া শেফালিকাদি যখন ডিউটিতে থাকেন, তখন নিজেই সব কাজ করে দেন। রেশমা জুনিয়ার বলে তার উপর চাপিয়ে দেন না। সত্যব্রত আর এই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামায়নি। লগবুকে রেশমার নাম লিখে, পেশেন্টের ব্যাপারে কিছু নির্দেশ দিয়ে যে যার কোয়াটার্সে চলে গিয়েছিল। রাতে কোনওরকম সমস্যা হলে রেশমা নিজেই ডাকত। তাহলে? হঠাৎ করে বুধনের অবস্থা কি আরও খারাপ হল? রেশমা যেহেতু ডিউটিতে ছিল, ফলে তাকেই জিজ্ঞাসা করল সত্যব্রত, “কী হয়েছে রেশমা? পেশেন্ট ঠিক আছে তো?”
তার কথা শুনেই রেশমা হাঁউমাউ করে উঠল। জড়িয়ে মড়িয়ে, কেঁদেকেটে কী যে সব বলল, ঠিক বোঝা গেল না। শেফালিকাদি তার হতভম্ব মুখের ভাব দেখে নিজেই এগিয়ে এসে বলল, “একটা খারাপ খবর আছে ডাক্তার আচার্য!”

খারাপ খবর? আকাশ থেকে পড়ল সে। তবে কি বুধনের সিরিয়াস কিছু হয়েছে? সে কোনওরকমে জিজ্ঞাসা করল, “কী হয়েছে?”

“বুধনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। হি ইজ মিসিং!”

“হোয়াট?” এত জোরে চিৎকার করে উঠেছিল কথাটা শুনে সে কাছেই একটা ঘোড়ানিমের গাছে সদ্য জাগতে শুরু করা কাকেদের একটা দল ‘কা কা’ করে ডাকতে শুরু করল।

শেফালিকাদি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “আজ্ঞে যা শুনছেন, সেটাই ঠিক। বুধন তার বেডে নেই। আমি গোবিন্দকে নিয়ে আশেপাশে যতটা সম্ভব খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। তারপরেই আপনাকে খবরখানা দিতে এলাম। আমি বুঝতে পারছি না, সে তার বাড়িতে চলে গেল কি না!”

“দিদি! বুধন যথেষ্ট অসুস্থ ছিল। তার উপর তার বেবি বুমও তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। আমরা তাকে যে ইঞ্জেকশন দিয়েছি, তাতে তার তো সারারাত মরার মতো ঘুমানোর কথা! তাহলে? তাছাড়া রেশমা যখন ডিউটিতে ছিল, সে নিশ্চয়ই কিছু বলতে পারবে?” বলে সত্যব্রত রেশমা ডায়ালের দিকে তাকাল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৬: সাদা ধবধবে মার্বেলের ওপর ভিজে পায়ের ছাপ ওয়াশরুম থেকে ঘরের দিকে গিয়েছে

রেশমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। কেঁদেকেটে তার চোখ-মুখ ফুলে গিয়েছে। কর্তব্যে গাফিলতির জন্য তাকে সাজা পেতে হবে, হয়তো এই ভাবনাতেও তার মুখখানা আতঙ্কিত। কেঁদে-কঁকিয়ে, থেমে-না থেমে, স্ফুট অর্ধস্ফুট বাক্য থেকে মোটের উপর বোঝা গেল, ইঞ্জেকশন দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই পেশেন্ট ঘুমিয়ে পড়েছিল। রেশমা তার জায়গায় বসে ক্রুশের কাঁটা দিয়ে ডিজাইন তুলছিল। আজ দুপুরেই শেফালিকাদি তাকে ডিজাইনটা শিখিয়েছিলেন।

রাত্রি আন্দাজ সাড়ে ন’টার সময় সে রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়ে আধঘণ্টার জন্য কোয়ার্টারে যায় রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। সে বজরঙ্গবলীজির দিব্যি খেয়ে বলতে পারে বড়জোর চল্লিশ মিনিট পরেই সে ফিরে এসেছিল এবং তখনও পেশেন্টকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেছিল। সে তখন একবার পেশেন্টের পাল্‌স রেট চেক করে খাতায় লিখেও রেখেছে। তারপর বসে বসে আবার সে ডিজাইন তুলছিল। অনেকে বই পড়ে, কিংবা ম্যাগাজিন। কিন্তু তার বই পড়ার নেশা নেই। মোবাইলে নেট প্যাক শেষ হয়ে গিয়েছিল ক’দিন আগে। সে ইচ্ছে করেই প্যাক ভরায়নি। ফলে মোবাইল দেখে যে সময় কাটবে, তাও সম্ভব ছিল না। আন্দাজ দেড়টা দুটোর সময় হঠাৎ তার খুব ঘুম পেতে থাকে। অস্পষ্ট মনে পড়ছে, কোনও একটা ফুলের তীব্র গন্ধ ভেসে আসছিল রুমে। তারপর তার আর কিছু মনে নেই। এমনিতে তার ঘুম পাতলা, কিন্তু কাল তাকে যেন মরণ ঘুম পেয়ে বসেছিল।

তিনটের দিকে হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যায়, রুমের মধ্যে তখন সে একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পায়। ঠিক কেমন গন্ধ সে বলতে পারবে না, তবে উগ্র নানা ধরণের গন্ধ মিলেমিশে মাথা ধরিয়ে দেওয়ার মতো গন্ধ ছিল সেটা। আর তারপরেই তার চোখ যায় পেশেন্টের বেডের দিকে। সেটা ছিল সম্পুর্ণ খালি। সে ভেবেছিল, পেশেন্টের হয়ত ঘুম ভেঙে গিয়েছে, সে ওয়াশরুমে গিয়েছে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরেও যখন পেশেন্ট ফিরল না, তখন সে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখে সেখানে কেউ নেই। ওয়াশরুম শুকনো খটখট করছে। তার মানে দীর্ঘক্ষণ এটা কেউ ব্যবহার করেনি। তারপর সে আশেপাশে খুঁজে না পেয়ে শেফালিকাদিকে ডেকে আনে কোয়ার্টার থেকে। দিদি আবার গোবিন্দকে ডেকে নেয়। তিনজনে আতিপাতি করে খুঁজেও কোথাও পেশেন্টের খোঁজ পায়নি। তারপরই তারা সত্যব্রতর কাছে এসেছে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-১: কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়…

“গোবিন্দ, এই কম্পাউন্ডের বাইরেটা কি দেখেছ? মানে বড়রাস্তা পর্যন্ত? হয়তো এখানে ওর মন কেমন করছিল, বাড়ি ফেরার জন্য বড় রাস্তার দিকে গিয়েছে। এই সময় ভোরের বেলা অনেক গাড়িটাড়ি যায়, হয়তো সে তেমন একটা কিছু ধরে বাড়ি ফিরেও যেতে পারে।”

গোবিন্দ বলল, “আমি গিয়েছিলাম স্যার। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। তবে…!”

“তবে…?”

“আজিব ব্যাপার স্যার। আমি পিছনের দিকের জঙ্গলে আগে গিয়েছিলাম। ওই যার ব্যাক পোর্শানে পিচাশ টিলা। তা সেদিকে যেতে গিয়ে দেখি ওই নুনিয়া এত ভোরের বেলায় চার্চ চমকে উঠল সত্যব্রত। এই কাকভোরে বাচ্চা মেয়েটা পালিয়ে এসে জঙ্গলে ঘোরাঘুরি করছে? তাও আবার পিচাশ টিলার জঙ্গলে? চার্চের সিকিউরিটি ব্যবস্থা তাহলে খুব ভালো নয় বলতে হবে! তা না হলে এত ভোরে চার্চের মেইন গেট তো বন্ধ থাকার কথা। সেক্ষেত্রে নুনিয়া পালায় কী করে? যাক, এটা পরে ভাবলেও চলবে, সত্যব্রত ভাবল, আপাতত কাউকে পাঠিয়ে বুধনের বাড়িতে খাঁজ করতে হবে, সেখানে সে ফিরে গিয়েছে কি না। হরিপদকে পাঠানো যেতে পারে। সে গাড়ি নিয়ে যাক সেখানে। গোবিন্দও তার সঙ্গে যাক। সে বেশ চালাকচতুর।

গোবিন্দ বলল, “আমি স্যার এক্ষুনি হরিপদকে নিয়ে যাচ্ছি খোঁজ করতে। তবে স্যার বুধনের বাড়ি তো আমি চিনি না। মাস্টারবাবুর বাড়ি চিনি। তাঁর কাছে গিয়ে আগে তাঁকে জানাই, তারপর তাঁকে সঙ্গে করেই বুধনের বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি।”
আরও পড়ুন:

দশভুজা: তিনি ‘অরণ্যের বিশ্বকোষ’, ৭৯ বছর বয়সেও পরিবেশ সংরক্ষণে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন তুলসী

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

হরিপদ অবশ্য তার জন্য নির্দিষ্ট কোয়ার্টারে থাকে না। মেন রোডের ধারে সস্তায় কিছুটা জমি কিনে কয়েকবছর সেখানেই বাড়ি করে ফ্যামিলি নিয়ে থাকে সে। সত্যব্রতকেও সে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়েছে। হাঁটা পথে বড় জোর মিনিট পনেরো। সত্যব্রত সায় দিতেই গোবিন্দ সাইকেলে করে তৎক্ষণাৎ রওনা হয়ে গেল।

যতক্ষণ না তারা ফিরে আসে, ততক্ষণ কিছুই করার নেই। বাড়িতে যদি খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে তো ভালোই। না পাওয়া গেলে লোকাল থানায় ইনফর্ম করতে হবে। তাও কি মনে হতে সে কেবিনে ঢুকল। বেডের উপরে পাতা সামান্য পুরানো সাদা কাভার অল্প ভাঁজ হয়ে রয়েছে। কেউ ঘুমালে যেমন হয়। রুমের আর সব কিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। কেউ যে জোরজবরদস্তি করে ধরে নিয়ে গেছে, এমন চিহ্ন কোথাও নেই। ছোট জানালার দিকে এগিয়ে গিয়ে উঁকি মেরে বাইরেটা দেখল সে। সেন্টারের ঘরের চারপাশেই গোবিন্দ আর শেফালিকাদি মিলে ছোট ছোট ফুলগাছ ইত্যাদি লাগিয়েছে। গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা জিনিয়া—এইসব। কিন্তু তাদের গন্ধ এত উগ্র নয় যে বসন্তকালের রাতে ঘরের মধ্যে ঢুকে কাউকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে কিংবা মাথা ধরিয়ে দেবে। ছাতিমের কোনও গাছ থাকলে তাও নাহয় মানা যেত। তাহলে কি রেশমা নিজের অপরাধ ঢাকতে মিথ্যে বলছে? যদি তা না হয়, তবে কিসের গন্ধ ছিল ওটা?

বাইরেটা আবারও ভালো করে দেখল সে। নীচে মাটি ভিজে রয়েছে। সারারাত শিশির পড়েছে। জানালায় মোটা লোহার গরাদ লাগানো, তাতে নেট ঘেরা। অতএব ওই পথে বুধনের চলে যাওয়া অসম্ভব। সুতরাং বুধন স্বেচ্ছায় গিয়ে থাকলে সামনের পথ দিয়েই গিয়েছে। অথচ তাতেও রেশমার ঘুম ভাঙেনি কিংবা ভাঙলেও সে বাধা দেয়নি। কিন্তু কেন?

রেশমার দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যব্রত। মেয়েটা এখনও অপরাধবোধে মাথা নীচু করে আছে এবং কেঁদে যাচ্ছে।—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content