শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

কাপাডিয়া অবাক হলেন। এত কষ্ট করে তিনি রাতের পার্টির আয়োজন করলেন, এখন হোস্ট বলছে যে, তার সমস্যা, ফলে পার্টিতে জয়েন করতে পারবে না। অবশ্য ট্যুরিস্ট পার্টির অনেকেই এরকম খামখেয়ালি হয়, বিশেষ করে বাঙালিরা। ক্ষণে ক্ষণে তাদের মুড স্যুইং করে। তবে শেষ মুহূর্তে জানালে কিছু সমস্যা হয়। যদিও এ ক্ষেত্রে তেমন সমস্যা হবে না, কারণ, দু’জন ছাড়া বাকিরা ক্যাম্পফায়ারে আসবে বলেছে। তবে বোঝাই যাচ্ছে, হুল্লোড় যেমনটা ভাবা গিয়েছিল, তেমনটা হবে না। শেষ মুহূর্তের তদারকি করছিলেন তিনি। সেলারে যা যা দামি ব্র্যান্ড ছিল, তার একটা তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পার্টি যা যা বেছে নিয়েছে, তেমনটাই রাখা হয়েছে। অপর্যাপ্ত বনমোরগের আয়োজন আছে। অতএব রোস্টেড চিকেনের অভাব হবে না। পর্কের একটা মশলা দিয়ে আগেই ম্যারিনেট করে রাখা হয়েছে, সেটাকে আগুনের তাতে শিকে গেঁথে ঝলসে দেওয়া হবে। গার্লিক-চিজ ব্রেড আর ক্যারামেল কাস্টার্ডেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেড়াতে এলেই বাঙালিদের কেউ কেউ সাহেব হয়ে ওঠেন। কাপাডিয়া নিজে বিশুদ্ধ শাকাহারি। ডাল-রোটি হলেই তাঁর চলে যায়। তবে রোজ দু’-পাত্তর না গলায় ঢাললে তার হয় না। এখানে মহুয়াও মেলে সহজেই। তাতেও অরুচি নেই তাঁর। তবে নিজে নিরামিষাশী বলে আমিষের আয়োজন করতে কোনো ত্রুটি হয় না তাঁর। ব্যস্তসমস্ত হয়ে তিনি পিছনের বাগানে শেষ মুহূর্তের তদারকি করছিলেন।

বড় বড় গার্ডেন আমব্রেলার নীচে টেবিল-চেয়ার পাতা হয়েছে। যদিও সাহেব-মেমসাহেবেরা সবাই আগুনের চারপাশে গোল হয়েই বসবেন জানিয়েছিলেন। একটু দূরেই কাঠ দিয়ে উনুন প্রস্তুত। সাহেবরা এলেই আগুন দেওয়া হবে। ঠান্ডা পরিবেশ ধীরে ধীরে উষ্ণ হয়ে উঠবে। এই রিসর্টে রান্নার জন্য একজন কুক আর তার একজন হেল্পার আছে। অন্যান্য কাজের জন্য দু’জন আছে, তাদের একজন সাফসুতরো করে, আবার টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে। আর একজন মালির কাজ করে, সেইসঙ্গে যখন যা দরকার খাটে। তার আঠারো-উনিশ বছরের ছেলেটি রুম বয় হিসেবে কাজ করে। আগে একজন গেটম্যান ছিল, তবে সে কাজ ছেড়ে দিয়ে তার পাওনাগণ্ডা না নিয়েই একদিন কোথায় সরে পড়েছে, কেউ জানে না। সেই থেকে কাপাডিয়া নিজে রাতের বেলায় রিসর্টের মেইন গেটে তালা দেন। পার্টি কেউ পরে এলে খুলে দেওয়া হয়, সে যত রাতই হোক। এই যেমন আজকেই এক কাপলের আসার কথা। যদিও রাস্তার মাঝে কী এক গণ্ডগোলে তারা আটকে পড়েছে, অনেক রাত হতেও পারে, আবার কাল ভোর হয়ে যেতেও পারে। সে যখনই তারা আসুক, কাপাডিয়া নিজে গেটে দাঁড়িয়ে তাদের ওয়েলকাম করবেন। এটাই তাঁর দস্তুর।
এই রিসর্টটির শেয়ার দু’জনের। সেভেন্টি পার্সেন্ট শেয়ার রায়বাবুর। রায়বাবু বাঙালি। অনেকদিন বিদেশে ছিলেন। তবে তিনি টাকা দিয়েই খালাস। এখানে আসেন খুব কম। কাপাডিয়াকে তিনিই খুঁজে পেতে নিয়ে এসে তাঁকে তিরিশ শতাংশের শেয়ার দিয়েছেন। কাপাডিয়ার পুঁজি ছিল সামান্যই। বলতে গেলে, তিনি কোনো টাকা দেননি বলেই গায়ে-গতরে খেটে, ম্যানেজারগিরি করে পুষিয়ে দেন। পাশেই ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে তাঁর পরিবার আছে। তবে কাপাডিয়া যে আসলে মালিক না, রায়বাবু যে আসল মালিক, এই সত্য এখানকার কাজের লোকেদের কেউ জানে না। রায়বাবুর নিষেধ আছে। মালিক অন্যজন এবং তিনি বাইরে থাকেন জানলে লোকেরা কাজে ফাঁকি দেবে, প্রফিট বলে কিছু থাকবে না, বারো ভূতের কারবার হয়ে যাবে। ফলে সকলেই জানে, আদতে কাপাডিয়া তথা ম্যানেজারবাবুই মালিক। সেই মতোই দেখে তাঁকে সবাই।

এত ঘন জঙ্গলের মধ্যে রিসর্টটি বানানোর পরিকল্পনা অবশ্য রায়বাবুরই। তিনি না কি বিদেশে এমন অনেক জায়গা দেখেছেন, যেখানে গহন গহীন জঙ্গলের মধ্যে একটাই মাত্র হোটেল কিংবা রিসর্ট। তার না কি কদরই আলাদা ও-সব দেশে। তাঁর ইচ্ছামতো সরকারের কাছ থেকে, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নিয়ে এই রিসর্টটা খুলেছেন রায়বাবু। রিসর্টের দু’দিকে জঙ্গল। আর একদিকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে একখানা ছোট টিলা। তারও ওপারে বছরের বেশিরভাগ সময়েই শীর্ণ ধারা বয়, এমন একটা নদী। তাতে জল যত না, বালি তার চেয়ে বেশি। আগে যখন জঙ্গলে অনেক হরিণ, চিতা, হাতি ইত্যাদি ছিল, তারা না কি রাতের বেলা সব জল খেতে আসতো। এখন আর তারা নেই। মানুষ কোনো বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক জিনিসকে বিশুদ্ধ রেখে উপভোগ করতে পারে না। যতক্ষণ না তার গায়ে নিজস্ব ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিচ্ছে, ততক্ষণ তার শান্তি নেই। এই জঙ্গলও এখন প্রায় জীবজন্তু শূন্য।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১২: সকালবেলার আগন্তুক

দশভুজা: জীবনে যা কিছু করেছি, প্রত্যয়ের সঙ্গে করেছি: কানন দেবী/২

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১: জলের তলায় তার শরীরের কোনও অস্তিত্ব নেই!

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬১: চাষাবাদ নিয়েও রবীন্দ্রনাথ ভেবেছেন

তবে রায়বাবু এখানে বেশ কায়দা করে রিসর্টটা বানিয়েছেন। তাঁর মতে, এখন ট্যুরিজম চলে ট্র্যাভেল-ব্লগারদের খবর পরিবেশনের কায়দার উপর নির্ভর করে। কোনও নতুন ট্যুরিস্ট স্পট নির্বাচন করো, কিছু পেইড ট্র্যাভেল-ব্লগারদের ভালোমতো টাকাকড়ি দাও, দু’দিনে স্পটের যে অ্যাডিওভার্টাইজমেন্ট হবে, তা কাগজে সাধারণ বিজ্ঞাপন দিয়েও হবে না। আর আছে দু’-একটি ট্র্যাভেল ম্যাগাজিন। সেখানেও কায়দা করে লেখা ছাপাতে পারলে কেল্লা ফতে। এ-ভাবেই এই নতুন জায়গার নাম ইতিমধ্যেই শর্ট ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবে ভালোই জায়গা করে নিয়েছে।
রায়বাবুর মতে, এখানে যারা আসবে, তারা কেউ চিড়িয়াখানা দেখতে আসবে না। জঙ্গলের নিজস্ব রূপ, গন্ধের মাঝখানে হয় কয়েকটা দিন বিশুদ্ধ বিশ্রাম নিতে আসবে, নয়তো মেয়ে বা ছেলে নিয়ে ফূর্তি করতে আসবে। তার অবাধ ব্যবস্থা এবং ফুল প্রাইভেসি অ্যাসিউর করতে পারলেই সকলে আস্তে আস্তে জুটবে। কার্যক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছে। এই রিসর্ট মাত্র চার বছরে হু হু করে জনপ্রিয় হয়েছে। বছরের বেশিরভাগ সময়েই বুকিং পাওয়া যায় না। এখানেও রায়বাবুর কায়দা। হাতে পর্যাপ্ত অর্থ থাকা সত্ত্বেও তিনি রিসর্ট বেশি বড় করেননি। তাঁর মতে বেশি বড় করলেই রুম খালি পড়ে থাকবে। তার চেয়ে এমনভাবে রুম বানাও, যাতে সবসময়েই রিসর্ট হাউসফুল থাকে। কেউ সহজে রিসর্ট বুক না করতে পারে। তাতেই মনে হবে, জায়গাটির এত ডিমান্ড যে সবসময়েই সকলেই এখানে ছুটে আসতে চায়। এতেও আকর্ষণ বাড়বে, লোকেও পাগলের মতো ছুটে ছুটে আসবে। আর বাঙালির মতো এই ব্যাপারে ‘হুজুগে’ খুব কম আছে। একটা হুজুগ উঠলেই হল, তল্পি-তল্পা গুটিয়ে চল পানসি বেলঘরিয়া।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৩: যার কাছে টাকা-পয়সা থাকে এ জগতে সেই হল পণ্ডিত

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫৪: মাছের বাজারের দুনিয়ায় আলিপুরের ‘নেট বাজার’ তালিকায় শীর্ষে

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩২: মঞ্জু ও অনুভা এসে বললেন, ‘আসুন বিকাশবাবু চু-কিত-কিত খেলি’

বসন্তের শুরু। বাগানে নানা রঙের ফুল ফুটে আছে। তার উপর হ্যাজাগের আলো পড়ে রহস্যময় লাগছে। এই রিসর্টে ইলেকট্রিকের কানেকশন থাকলেও, এই অঞ্চলে ইলেকট্রিক সাপ্লাই এত খারাপ যে, সন্ধ্যে নামলেই অন্ধকারে ডুবে থাকে। জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে, তবে সেটা রাত দশটার পরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। গার্ডেন পার্টিতে হ্যাজাগ জ্বালানোর পরিকল্পনা অবশ্য যার ছিল, তিনি এখন নেই। আর্যবাবু আজ কী কাজে কোথাও একটা গিয়েছেন। তিনি না কি কোন আখবারে লেখালেখি করেন। কাপাডিয়ার অবশ্য অন্য খবরে উৎসাহ কম। সময়ও পান না। যেটুকু পান বাড়ির সঙ্গে কথা বলে কিংবা মোবাইলে গান শুনেই কাটিয়ে দেন। সবসময় যে নিরামিষ গান শোনেন বা ভিডিও দেখেন, তা-ও নয়। কিন্তু খবরের কাগজ পড়েন না।

“এ কী! এখনও কেউ আসেনি?”

কারুর গলার আওয়াজ পেয়ে কাপাডিয়া ঘুরে দেখলেন অরণ্যবাবু। সঙ্গে সম্ভবত তাঁর ওয়াইফ কিংবা গার্লফ্রেণ্ড।

তিনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। বললেন, “আইয়ে, আইয়ে। সব ইন্তেজাম হো চুকা হ্যায়। ব্যস, আপলোগোকি আনে কি ইন্তেজার থা। আগ লাগা দে কেয়া?”

কাপাডিয়ার প্রশ্ন শুনে তৃধা আঁতকে ওঠার ভাণ করল, “সে কি ? আপনি আগুন লাগিয়ে দেবেন আমাদের গায়ে?”

“কেয়া ম্যাডাম?” বেকুবের মতো প্রশ্ন করেন কাপাডিয়া, “কেয়া বাত্‌ বোল রহি হ্যায় আপ?”

অরণ্য হেসে আশ্বস্ত করে, “ম্যাডাম জোক করছেন কাপাডিয়া। আপ তুম আপনা কাম স্টার্ট কর দো!”

বাপের বয়সী কাপাডিয়াকে ‘তুমি’ করে তাচ্ছিল্য করলে একটা আত্মপ্রসাদ অনুবভব করে অরণ্য। এখনও করল।

তৃধা বলল, “কিন্তু অনিল, অঞ্জন আর উন্মেষা তো এল না ? ফোন করবো ? হয়ত এখনও বেডে শুয়ে !”

“শুয়ে না কি আর কিছু করছে দেখ! দুপুরে জঙ্গলে করার পর এখন হয়তো পার্ট টু চলছে। তুমিই কেবল আমাকে সুযোগ দিলে না। এইরকম সতীলক্ষ্মী জানলে আমি আর কাউকে নিয়ে আসতাম!”

“তাই? ওলে বাবা লে? বাচ্চার রাগ হয়েছে। রাত জমুক, তারপর যা চাও পাবে!”

“প্রমিস?”

“প্রমিস।”

“ইয়া হু…!” বলে অরণ্য শাম্মি কাপুরের স্টাইলে ঘুরপাক খেয়ে হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে মুখ দিয়ে শব্দ করল আবার।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৮: শুঁটকি মাছে কি আদৌ কোনও পুষ্টিগুণ আছে?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৩: হৃদয়পুরের লক্ষ্যপূরণ ‘কঙ্কাবতীর ঘাট’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৯: ‘মেরা কুছ সামান…’ গানে সুর দেওয়ার প্রস্তাবে গুলজারকে পত্রপাঠ বিদায় জানান পঞ্চম

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১৩: এখানকার একমাত্র ভারতীয় রেস্তরাঁর মালিকও বাঙালি

এমন সময় কাপাডিয়া জানালেন, “অঞ্জন বাবু অউর ম্যাডাম আসতে পারবেন না। ম্যাডামের শরীর খারাপ। মাথা ধরেছে। শুয়ে আছেন। আপনাদের এনজয় করতে বললেন।”

“সে কী? হোস্ট নিজেই অসুস্থ হয়ে রুমে?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ”, জবাব দিলেন কাপাডিয়া।

“কই আমাদের তো কিছু জানায়নি। একটা ফোন করে দেওয়া উচিত ছিল! এখন তো পার্টিটাই আর জমবে না! তার উপরে অনিলও এখনও আসেনি!”
“আপনারা আগুনের ধারে গিয়ে বসুন। ড্রিংক নিন। ম্যায় অনিলবাবুকো বুলাকে লাতা হুঁ।” কাপাডিয়া অনুরোধ করলেন। ততক্ষণে কাঠে অগ্নিসংযোগ করেছে কুকের হেল্পার ছেলেটি। ওরা সেদিকে এগিয়ে গেল।

হেল্পার ছেলেটির নাম সুবল। সে এগিয়ে এসে একটা প্লেটে চিকেন কাবাবের স্তুপ সাজিয়ে পাশে রাখল।

“ড্রিংকস কী আছে, সার্ভ করো। শ্লা, মেজাজটাই খিঁচড়ে আছে। উন্মেষারা আসবে না শুনে আরও খিঁচড়ে গেল। আর্য হারামিটা আজকেই চলে গেল একটা বাহানা করে। নিশ্চয়ই লোকাল মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করবে। অনিলটাও আসছে না। এভাবে কী পার্টি হয়?”

সুবল চলে গেল ড্রিংকস আনতে। ম্যানেজারবাবু আগেই বলে দিয়েছেন, কখনও কী সার্ভ করতে হবে।

এমন সময় হঠাৎ গেটের কাছে একটা গাড়ি এসে থামল। তার হেডলাইটের আলো জোরালো ভাবে এসে পড়ল অরণ্য আর তৃধার চোখেমুখে।

বাইরে থেকে কেউ কর্কশ গলায় বলল, “থানা থেকে আসছি। পুলিশ। দরজা খোলো।” —চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content