রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় হেলথ্‌ সেন্টারের দায়িত্ব নিয়ে আজ মাস তিনেক হল এসেছে সত্যব্রত। জায়গাটা গঞ্জ ধরণের। ব্যাঙ্ক, পোস্টঅফিস, থানা, দুটি প্রাইমারি স্কুল, একটি হাইস্কুল, বাজার সবই আছে। সপ্তাহে দুই দিন হাটও বসে। বাসিন্দার সংখ্যা যে খুব বেশি এমন নয়। এখানে আসার পর একদিন সে সাইকেল রিকশোয় চড়ে গোটা জনপদ এধার থেকে ওধার চষে ফেলেছিল। খুব বেশি সময় লাগেনি। জনপদটির শহুরে রূপটা খুব সামান্য অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ। তার পরেই শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়াল, খয়ের, শিমূল ইত্যাদির ফাঁকে ফাঁকে ছোট ছোট গ্রাম, দেহাতি মানুষের বাস সেখানে। চারধারে কঠিন কঠোর মাটিকে চিরে চাষের উপযোগী করে নেওয়া আবাদি জমি, রাস্তার দু’ ধারে খেজুর, বাবলা আর শাল-সেগুনের চন্দ্রাতপ। পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে ঘন জঙ্গলের বুক চিরে সাপের মতো এঁকে বেঁকে দূরে হারিয়ে গিয়েছে রেলের লাইন। দিনের মধ্যে দু’টি করে মোট চারটি লোকাল ট্রেন কাছের জংশনে পৌঁছে দেয়। স্থানীয় লোকেরা কাছাকাছি যেতে হলে হাতে গোনা কয়েকটি বাস, ট্রেকার কিংবা মালবোঝাই ট্রাক ইত্যাদির উপর নির্ভর করে, নয়ত এগারো নম্বর তো আছেই। এখানকার সেই সব বাস, ট্রেকার দেখলে মনে হবে সার্কাসে কেউ ট্র্যাপিজের খেলা দেখাচ্ছে। যানবাহন চোখেই পড়ে না, মনে হয় চলন্ত মানুষের একখানা পাহাড় যেন কোনমতে ছুটে চলেছে।
এখানকার আশেপাশে অনেক খনি আছে, কয়লা, অভ্র ইত্যাদির। সেইসব খনিতে দেহাতি মানুষেরা কাজ করতে যায়। অনেকে সেখানেই থাকে বসতি করে, ছুটিছাটায় আসে। আবার এদিক থেকেও কাজের সন্ধানে যায়। বয়স্করা অনেকে ক্ষেতখামারের কাজই করে। বছরে একবার ধান হয়। ইরিগেশনের একটা কাটা খাল আছে, সুবর্ণরেখার একটা স্রোত এদিক দিয়ে বয়ে গেছে, সেখান থেকেই জল আসে খালে। যতদিন জল, ততদিন চাষবাস। বাকি সময় জঙ্গলই ভরসা। বুনো ধুঁধুল, খামালুর মতো নানারকম কন্দ, এছাড়া ক্ষেতে ফলানো ঝিঙে, পেঁপে, কিছু না জুটলে সময়ের মহুয়ার ফল, কুসুম বীজের দানা আর চিনা ঘাসের বীজ। এত অভাব, এত কষ্ট, তবুও দেহাতি মানুষের মুখে হাসি মরে না। এদের জীবনে জঙ্গল হল এক দেও, আর এক দেও হল যিশুবাবা। শহর থেকে একটা পিচরাস্তা রেললাইনকে ডিঙিয়ে চলে গেছে পশ্চিমের জঙ্গলের ভিতরে। সেই রাস্তা ধরে খানিকটা গেলেই চোখে পড়বে অনেকটা এলাকা জুড়ে রয়েছে মিশনারিদের চার্চ, স্কুল, অরফ্যানেজ হোম, দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র, আর বেশ বড়সড় একখানা কমিউনিটি হল। দেহাতি মানুষগুলির জীবনে এই মিশনারিরা না থাকলে হয়তো আজও তাঁরা পড়ে থাকতেন গভীর অন্ধকারে। বিশেষ করে এই হেলথ্‌ সেন্টার তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত কেবল দেহাতি মানুষগুলিই নয়, এলাকার সাধারণ বাসিন্দাদের জীবনেও এই চার্চের স্কুল, হাসপাতাল—এর ভূমিকা ছিল প্রধান। এমনকি হেলথ্‌ সেন্টার তৈরি হওয়ার পরেও সত্যব্রত এসে দেখেছে, মিশনারিরা যে সার্ভিস দিচ্ছেন, তেমন সুযোগ-সুবিধা এখনও সরকারি হেলথ্‌ সেন্টারও দিতে পারেনি। অথচ আজ বছর আটেক হল এই হেলথ্‌ সেন্টার তৈরি হয়েছে। কিন্তু এলাকার গরীব গুর্বো থেকে অবস্থাপন্ন ধনী মানুষেরা পর্যন্ত আজও চার্চ-হাসপাতালেই ভিড় জমান। নেহাত দায়ে না পড়লে হেলথ্‌ সেন্টারের দিকে ঘেঁষে না কেউ। সেইজন্য এখানে এসে সত্যব্রত হাঁফিয়ে উঠেছে। ডাক্তার বলতে সে একা, সঙ্গে দু’জন নার্স, একজন ঝাড়ুদার এবং একখানা অ্যাম্বুলেন্স-সহ একজন ড্রাইভার। এই অ্যাম্বুলেন্স রাত-বিরেতে দরকার পড়লে তবেই কেউ কেউ আসে এখানে। চার্চের দুখানি অ্যাম্বুলেন্স আছে। সেগুলি না পেলেই এমারজেন্সিতে লোকে হেলথ্‌ সেন্টারের দিকে ঘেঁষে। সত্যব্রতর জীবন কাটে মাছি তাড়িয়ে আর নার্স দিদি—শেফালিকা বিশ্বাস ও রেশমা ডায়াল, ঝাড়ুদার নাথানিয়েল গোবিন্দ সোরেন আর ড্রাইভার ড্যানিয়েল হরিপদ মাহাতোর পারিবারিক কথা শুনে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ

দশভুজা: আমি বনফুল গো: তিনিই ছিলেন ভারতীয় ছবির প্রথম সিঙ্গিং সুপারস্টার/১

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৬: রতনপুর মহামায়া দর্শন

সত্যব্রতর কোয়ার্টার হেলথ্‌ সেন্টারের একটেরে। দু’খানা মাঝারি ঘর, রান্নাঘর ও ওয়াসরুম। বাড়ির সামনে প্রশস্ত বাগান, পিছনদিকে কুয়ো। তার চারধারে বেশ কিছু ফুল ফলের বড় গাছ। কলাঝাড়ও আছে একটা। বাকিদের জন্য একখানা ব্যারাক মতো আছে। ছোট ছোট দু’ কামরার ঘর, সামনে একফালি বাগান, আর একখানা কুয়ো। হেলথ্‌ সেন্টারের পিছন দিকে অনেকটা অনাবাদী রুক্ষ জমি, তারও পরে শাল-সেগুনের ছোট জঙ্গল, আর তার পিছনে ধূসর কালো স্লেটের মতো টিলা; এরা বলে পিচাশ-টিলা।

সত্যব্রতর বেশ অবাক লেগেছিল। ‘পিচাশ’ মানে নিশ্চয়ই ‘পিশাচ’। কিন্তু একটা নিরীহ টিলাকে পিশাচ বলার কারণটা কী? এই নিয়ে সে প্রশ্ন করেছিল নাথানিয়েল গোবিন্দ সরেনকে। গোবিন্দকে লোকাল গেজেটিয়ার বলা যায়। এই জনপদ, আশেপাশের আর চার-পাঁচটা জনপদের হাঁড়ির খবর সে যেমন রাখে, আর কেউ না। এমনকি সত্যব্রতর মনে হয়, কার বাড়িতে কী রান্নাবান্না হয়, তার খবর বুঝি কেমন করে পৌঁছে যায় তার কাছে। সে মিশনারিদের স্কুলে পড়েছে। কথায়-বার্তায় সামান্য টান থাকলেও তার কথা শুনে বোঝা যায় না সহজে যে সে দেহাতি মানুষদেরই একজন। এটাই তার ইউএসপি। নিজের লোকেদের কাছে সে তো ঘরের ছেলে, আবার শিক্ষিত ভদ্র মানুষরাও তার কথাবার্তা শুনে সহজে তাকে গ্রহণ করে নেয়। এইভাবেই তার কাছে খবরাখবর চলে আসে। বাকি দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়ে সে বেশ খবরের ফাঁকফোকর পূরণ করে নেয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-১: রাজার ছেলেদের রাজনীতি-কূটনীতি শেখানোর জন্যই লেখা হয়েছিল এই গ্রন্থ

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭: ভারতের উত্তরাধিকার, কৌরব ও পাণ্ডবগণ

তা সত্যব্রতর প্রশ্নের উত্তরে সে বলেছিল, “আপনি জানেন না ডাগদার সাহেব, দেয়ার মাস্ট বি সামথিং মিস্টিরিয়্যাস। আমাদের বাপ-দাদার মুখ থেকে আমরা শুনে আসছি, ওই টিলার গা পর্যন্ত এককালে বেশ বড় গাঁও ছিল। এখন আর নেই। সব জঙ্গল গিলে খেয়েছে। কিন্তু শোনা যায়, পোড়ো ঘর-বাড়ি এসব এখনও আছে দু’-চারটে। আগে ওই টিলা ওখানে ছিল না। হঠাৎ একদিন রাতের আঁধারে ওই টিলা কোথা থেকে উড়ে এসে ওখানে দাঁড়ায়। এমনিতে নর্মাল, কিন্তু অমাবস্যা কিংবা পুনমের রাতে ওই টিলা পিচাশ রূপ ধরে ঘুরে বেড়াত। বেরুত রক্ত খাবার লালচ নিয়ে। গাঁওর যাকে তার পছন্দ হতো, তার নাম ধরে ডাক দিত সে। সেই ডাক যে শুনেছে, সে আর বাঁচত না। এইভাবেই সেই গাঁও বিলকুল খালি হয়ে গেল। যারা জিন্দা রইল, তারা পালিয়ে গেল। অ্যাবান্‌ডানড্‌ ভিলেজকে গিলে খেল জঙ্গল। এরপর থেকে কেউ আর ওদিকে যায় না। আমাদের গাঁওবুড়াদের নিষেধ আছে ওদিকে যাওয়ার ব্যাপারে। যারাই গিয়েছে নিষেধের পরোয়া না করে, তারাই আর ফিরে আসেনি। তাদের লাশটুকুও আর মেলেনি।”

দুপুর গড়িয়ে গিয়েছে। চৈত্র মাস। তবে এখনও গরম তেমন পড়েনি। বসন্তের রেশ চলছে। বাতাসে কুসুম ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। হরিপদ মাহাতোর অ্যাম্বুলেন্স দেখা যাচ্ছে, একদিকের দরজা খোলা, সে সম্ভবত গাড়ির মধ্যেই দিবানিদ্রা দিচ্ছে। শেফালিকাদিদি আর রেশমা ক্রুশের কাঁটা নিয়ে ডিজাইন তুলছে। মনোরমা হয়তো বাচ্চা দু’টিকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে দুপুরের ওম মেখে। সত্যব্রতর ডিউটি। বাইরের বারান্দায় এসে বসেছে। একটু দূরে গোবিন্দ বসে আছে। সে কথা বলতে খুব ভালোবাসে। বিশেষ করে ডাগদার বাবুর মতো কলকাতার বাবু পেলে তো কথাই নেই। একবার-দু’বার সে কলকাতা গিয়েছে। উফফ্‌, ভারি আজিব শহর। হবে না! স্টেট-ক্যাপিটাল বলে কথা!
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৬: লিঙ্গ পরিচিতিতে খাদ্যাভ্যাসের রাজনীতি

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: রোজ খাওয়ার পরে পান খান? অনেক ওষুধ কেনার খরচ বেঁচে যেতে পারে

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে: আপনি কি বডি শেমিং-এর শিকার?

সত্যব্রত বলল, “আচ্ছা, সে-সব তো কুসংস্কার। পিশাচ বল, পিরেত বল, এই শতকে দাঁড়িয়ে সে-সব কেউ বিশ্বাস করে? তুমি তো চার্চের স্কুলে পড়েছ; ফাদার তোমাদের কখনো বলেননি যে এই সব অন্ধ বিশ্বাস থেকে বেরিয়ে না-আসলে তোমাদের মঙ্গল হবে না?”

গোবিন্দ উত্তর দিল, “সব জিনিস কি আর কিতাবে লেখা থাকে? আর যা যা লেখা থাকে, তেমন তেমনই যে হবে সবসময়, তা কি বলতে পারে কেউ? ফাদাররা বলেন চার্চের প্রেয়ারের শেষে অনেক কথাই। কিন্তু একটা কিস্‌সা তো আর এমনি এমনি তৈরি হয় না ডাগদার সাহাব? কোনও না কোনও কারণ তো থাকবেই। এই পিচেশও ঝুট না। আগের ফাদার দেখেছিলেন। তিনি কোনমতে পালাতে পেরেছিলেন, কিন্তু বাঁচতে পারেননি। মরবার আগে বলে গিয়েছিলেন কেবল, সব সত্যি। সে আছে। হি ইজ স্টিল ওয়েট দেয়ার সাহাব!”
সত্যব্রত অবাক হল, “তুমি বলছ, আগের ফাদার পিশাচের আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন? আর সে কথা তিনি বলে গিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ সাব!”

সত্যব্রত তাকে ঘটনাটা জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, এমন সময় একখানা টোটো এসে দাঁড়াল হেলথ্‌ সেন্টারের গেটের সামনে। অবাক হল সে। বিকেলের দিকে কেউ সচরাচর আসে না হেলথ্‌ সেন্টারে। তাছাড়া চার্চ-হসপিটালে না গিয়ে এখানে এসেছে, এটাও তাকে অবাক করল। তা-ও যখন এসেছে কেউ, তাহলে নিশ্চয়ই সিরিয়াস কেস হবে। ঘটনাটা পরে জানবে স্থির করে সে উঠে পড়ে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল গেটের দিকে। তার পিছন পিছন গোবিন্দও। —চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content