মঙ্গলবার ৩ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

রাত বাড়ছিল। ওরা সবাই ক্লান্ত-বিধ্বস্ত শরীরে বাসের মধ্যেই বসে ছিল। রাত যত ঘনাচ্ছে, বাতাসে হিমের পরশ ততই অনুভূত হচ্ছে। রিমিতার চোখ-মুখ শুকনো। পূষণেরও তাই। পুলিশকে ফোন করে সে-ই খবর দিয়েছিল। এটা নাগরিক হিসেবে তার দায়িত্ব বলে মনে হয়েছিল পূষণের। তার খেসারত হিসেবে থানা থেকে আসা ইনভেস্টিগেটিং অফিসার প্রথমেই সাফ বলে দিয়েছেন, “এখানে এখানকার মতো করে চলুন, এ আপনার কলকাতা নয়! এটা জঙ্গল এবং বর্ডার এরিয়া। কখন কী হয় বুঝতে না বুঝতেই লাফড়ায় পড়ে যাবেন!”

পূষণ তখন নাগরিকের বিপরীতে এই জায়গার অধিবাসীদের একটা পরিচয়জ্ঞাপক শব্দ খুঁজছিল। আচ্ছা নাগরিকের পরিবর্তে যদি জাঙ্গলিক ব্যবহার করা হয়, কেমন হয়? মানে, যারা জঙ্গলে বাস করে? এখানকার পুলিশদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, দেশের আইন নগরের জন্য এক রকম, গ্রামের জন্য আর এক রকম এবং জঙ্গলের জন্য আদতে কোনও আইনই নেই।

ফোন করবার দেড় ঘণ্টা পরে থানা থেকে একখানা জিপ এসে দু’জন অফিসার এবং দু’জন পেটমোটা কনস্টেবল, সঙ্গে একজন ডাক্তার নামলেন। অকুস্থলে গাড়ির হেডলাইট, বাসের হেডলাইট এবং মোবাইল টর্চ জ্বেলে কোনরকমে পরিদর্শন করলেন তাঁরা। এই রকম জঙ্গুলে জায়গায় একটা অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্ত করতে গেলে যে যথোপযুক্ত আলোর ব্যবস্থা করে আসা দরকার, সম্ভবত তা তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন। কিংবা এই তদন্ত করাটাকেই তাঁরা নিষ্প্রয়োজন বলে মনে করেন।
ডাক্তার বডি চেক করে বললেন, ‘বিকেল চারটের পরে কোনও সময়ে মৃত্যু হয়েছে। দ্রুত গতিতে ধাবমান কোন কিছু থেকে ছিটকে পড়ে আগে সম্ভবত মাথায় আঘাত লেগেছে। তাতে মাথাটা থেতলে গিয়েছে একদিকে। জন্তুটা (যদি ধরে নেওয়া যায়, সেটা কোনও জন্তুই ছিল) সম্ভবত রক্ত-মজ্জার লোভে জিভ দিয়ে সেটাই চাটছিল। তবে কী ধরণের জন্তু, তার লালার বিশ্লেষণ না করে বলা সম্ভব নয়। সেটা ফরেন্সিকের কাজ। মৃত ব্যক্তির বয়স আঠাশ থেকে তিরিশের মধ্যে। ছিটকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মারা গিয়েছে। বাকিটুকু ফরেন্সিক করলেই বোঝা যাবে।

বাকি তদন্ত থেকে আর যা যা জানা গেল তা হল, মৃত ব্যক্তি বাইক চালাচ্ছিল এটা হতে পারে। যদিও আশ্চর্যের ব্যাপার, আশেপাশে কোন বাইকের চিহ্ন মাত্র নেই। তার পরণে মোটের উপর ভদ্রস্থ পোশাক, পকেটে পার্সও পাওয়া গিয়েছে। তবে তাতে সামান্যই টাকাকড়ি আছে। যদিও এটিএম কার্ড নেই। থাকলে মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানা অনেকটা সহজ হয়ে যেত। আর একটা ব্যাপার হল, পকেটে মোবাইল পাওয়া যায় নি, যেটা এখনকার দিনে অস্বাভাবিক বলা চলে। শহুরে। পায়ের জুতোটার দাম আহামরি কিছু না হলেও নিতান্ত কমও নয়। অতএব স্বচ্ছল।

একজন অফিসার আর-একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী বুঝছো সুদীপ্ত? পাতি বাইকচোরের কান্ড বলে মনে হচ্ছে কি?”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৯: নুনিয়া

অজানার সন্ধানে: মুছে যাক গ্লানি মুছে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১৫: অসুখের শরীর, সমাজের কাছে ভয় নারীর

সুদীপ্ত সম্ভবত সেকেন্ড অফিসার। বললেন, “তাই কী? বাইক চোর হলে এমনভাবে বাইকটা হাতাবে, যাতে তা নিয়ে পালানোর মতো কন্ডিশনে থাকে। মানে আমি বলতে চাইছি, বাইক অ্যাকসিডেন্ট ঘটালে হয়ত বাইকচালকের ইনজ্যুরি কিংবা মৃত্যু ঘটবে, তাতে তাদের চিহ্নিত করা কঠিন হবে, কিংবা ধরা পড়লে প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষী দেওয়ারও কেউ থাকবে না। কিন্তু একইসঙ্গে বাইকটা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে মারাত্মকভাবে। তাতে তাড়াতাড়ি বাইকটাকে বেচে দেওয়া কী পাচার করা তো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাছাড়া স্যার, আমি দেখেছি, এই সব বাইক চোরেরা বাইক চুরি করার পর সেই বাইকে চেপেই পালিয়ে যায়। নিজেদের সঙ্গে আলাদা বাইক ইত্যাদি রাখে না। কেউ কেউ অবশ্য গাড়ি করে এসে বাইকটাকে তুলে নিয়ে পালাতে পারে। কিন্তু এত খরচ করে একটা বাইক চুরি করবে, পড়তায় পোষাবে না! একটা সেকেন্ড হ্যান্ড বাইকের দাম কত আর?”

আগের অফিসার জিজ্ঞাস করলেন, “ধর যদি খুব দামি বাইক হয়?”

সুদীপ্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, “পোশাক-আশাক দেখেছেন? আহামরি নয়। আমাদের গোলাবাজারের দোকানেও এই ব্র্যান্ডের শার্ট-প্যান্ট পাওয়া যায়। অতএব নজর তেমন উঁচুতে নয়। এ যদি খুব দামি বাইক কেনে, আমি অবাক হবো। তাছাড়া হাতের নখ কাটে না, মানে নিজেকে সাজিয়ে রাখতে হয় জানে না, নয়তো সময় পায় না। কেবল হাতের ঘড়িটা দামি ব্রান্ডের। যারা দামি বাইক কেনে, তাদের পোষাক-আশাকও তেমনই হয়। এখানে ভিকটিমকে দেখে তা মনে হচ্ছে না!”
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৫: সারদা দাদার থেকে চিল্পিঘাটি

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৬: পঞ্চম-সভার তিন রত্ন বাসু-মনোহারী-মারুতি

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩১: মরুভূমির উপল পারে বনতলের ‘হ্রদ’

অফিসার বললেন, “তাহলে কী এমন হতে পারে যে, ভিকটিম আর কারুর সঙ্গে বাইকে সওয়ার ছিল, তাকে কোনওভাবে বাইক থেকে ছুঁড়ে ফেলা হয়, তারপর ভিকটিমের জিনিসপত্র ও বাইক নিয়ে মার্ডারার চলে যায়। মনে কর, ভিকটিমই হয়তো বাইক চালাচ্ছিল এবং মার্ডারার পিছনে বসে ছিল! এই যুক্তিটাতেও কি ফাঁক আছে বলে মনে হচ্ছে?”
“অনেক ফাঁক!” সুদীপ্ত বলল, “ধরে নিলাম, আততায়ী বিশাল বলশালী কেউ এবং ভিকটিম জানত না যে, সে বাইকের পিছনে যাকে বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, সে তাকে খুন করার ছক কষেছে। কিন্তু বাইক চলতে চলতেই যদি পিছন থেকে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হয়, তাহলে তো বাইকটা বেশামাল হয়ে স্কিড করবে কিংবা ধাক্কা মারবে কোথাও। সেক্ষেত্রে আততায়ী নিজেই তো আহত হতে পারে! এখানে তেমন চিহ্ন কিছু তো দেখছি না! তা-ও সকালে এসে ভালো করে ছানবিন করতে হবে। কোথাও আশেপাশের গাছগুলির গায়ে ধাক্কা মারার চিহ্ন থেকে থাকে! কিন্তু আমি ভাবছি, যদি মার্ডার করাই উদ্দেশ্য হয়, তাহলে মেরে জঙ্গলের গভীরে ফেলে আসাই তো বুদ্ধিমানের কাজ। সহজে কেউ ট্রেস করতে পারবে না। যতদিনে জানাজানি হবে, ততদিনে সে ভাগল্‌বা। সেটা না করে একেবারে রাস্তার মাঝখানে লাশ ফেলে বাইক নিয়ে উধাও হয়ে গেল?”

“চারচাকা যদি হয়?”

“তাহলে হতে পারত। কিন্তু এখানকার রাস্তার অবস্থা দেখেছেন। মনেই হবে না যে পিডব্লিউডি বলে কিছু আছে! এই রাস্তায় খুব বেশি স্পিড তুলতে পারবে না চারচাকারা। তাতে গাড়িরই ক্ষতি হবে। আর তা যদি হয়, তাহলে ভিকটিম পড়ে একদিক সামান্য ছড়ে যেতে পারে, হেমারেজ হয়ে মারাও যেতে পারে, কিন্তু একেবারে থেতলে মাথা বাদ যেতে পারে না। আমি বলছি না যে, এ রাস্তায় বাইক খুব স্পিড তুলতে পারবে, কিন্তু চার চাকার চেয়ে বেশি তুলতে পারবে, সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আসলে এখানে এমন কিছু হয়েছিল, যা আমাদের ভাবনার বাইরে কিংবা আমরা ঠিক ধরতে পারছি না!”
আরও পড়ুন:

হোমিওপ্যাথি: গর্ভাবস্থায় গলা-বুক জ্বালা, বমি ভাব? এমন সময় কী করবেন, কী করবেন না

শুধু গরমে তেষ্টা মেটাতেই নয়, সব ঋতুতেই সুস্থ থাকতে সঙ্গী হতে পারে আখের রস

হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকে বিগড়ে যায় কিডনি, মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, বিশ্বকে অবাক করে অসাধ্যসাধন করে দেখাচ্ছেন গবেষকরা

একজন কনষ্টেবল কৌতূহলী বাসযাত্রীদের সামলাচ্ছিল। আর একজন লাশ পাহারা দিচ্ছিল। ডাক্তার, এবং কিছুদূরে পূষণ, ভবানীবাবু এবং ঈশ্বরীপ্রসাদ দুই অফিসারের কথোপকথন শুনছিল। পূষণ খুব মনোযোগ দিয়ে কথাবার্তা শুনছিল তাদের দু’জনের। সে বলে উঠল, “আচ্ছা অফিসার, যদি এমন হয়? ধরুন আমি তাড়াতাড়ি করে বাইক চালাচ্ছি, হয়তো কোন গন্তব্যে তাড়াতাড়িই আমাকে পৌঁছতে হবে, এমন সময় রাস্তার মাঝখানে আচমকা এমন কিছু চলে এল কিংবা দেখল সে, যে তার হাত কেঁপে উঠল এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে বেমক্কা পড়ে গিয়ে মাথা থেতলে গেল! হতে পারে না?”

প্রথম অফিসার বাহবা দেওয়া তো দূর, দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বলে উঠলেন, “আরে আপনাকে কে কথার মাঝখানে কথা বলতে বলেছে? তদন্ত কি আপনি করবেন, না আমরা? আপনার কী মনে হয়, সেটা আপনি আপনার মধ্যে রাখুন। যান, বাসে গিয়ে বসুন। মনে রাখবেন, এখানে উপস্থিত কেউই আপনারা সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। তাছাড়া ভিকটিম স্থানীয় লোক নয়, কে বলতে পারে লোকটা কলকাতা থেকে আসেনি। আর আপনি তাকে কাউকে দিয়ে মার্ডার করিয়ে অন স্পটে এসেছেন বাসে চড়ে!”

তাঁর কথা শুনে পূষণ হতভম্ব হয়ে গেল। সে আগ বাড়িয়ে খবর দিল থানায়, বাকিরা কেউই রাজি ছিল না। আর এখন ইনভেস্টিগেটিং অফিসার সন্দেহ করছেন কি না, সেই-ই খুনী!

সুদীপ্ত নামের অফিসারটির বয়স কম, বিবেচনাবুদ্ধি আছে। সে বলল, “স্যার, উনি সম্ভাবনার কথা বলেছেন। আর কথাটার মধ্যে যুক্তিও আছে। আমাদের সবরকম সম্ভাবনার কথাই মাথায় রাখতে হবে। যান, আপনি বাসে গিয়ে বসুন। পরে আপনার সঙ্গে কথা বলবো।” পূষণের দিকে তাকিয়ে বলল সে।

ঈশ্বরীপ্রসাদ হাত জোড় করে গদগদ ভঙ্গিতে বলল, “আর আমরাও কি বাসে গ্যে বসব ছ্যার?”

সুদীপ্ত কড়া চোখে তার দিকে তাকাল। ঈশ্বরীপ্রসাদ সুড়সুড় করে বাসের দিকে এগিয়ে গেল।—চলবে
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।
 

গল্প ও উপন্যাস পাঠানোর নিয়ম

‘সময় আপডেটস’-এর এই বিভাগে যাঁরা গল্প ও উপন্যাস পাঠাতে চান তাঁরা ছোটদের ও বড়দের আলাদা আলাদা গল্প পাঠাতে পারেন৷ বুঝতে সুবিধার জন্য ইমেলের ‘সাবজেক্ট’-এ বিভাগের উল্লেখ করবেন৷ ছোটদের গল্পের জন্য ১০০০ শব্দ ও বড়দের গল্পের জন্য ১০০০-১৫০০ শব্দের মধ্যে পাঠাতে হবে ইউনিকোড ফরম্যাটে। সঙ্গে ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর দিতে ভুলবেন না৷ গল্প বা উপন্যাস নির্বাচিত হলে যোগাযোগ করা হবে৷ ইমেল: samayupdatesin.writeus@gmail.com


Skip to content