মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল

রিমিতা ভাবতেই পারছে না যে, এবারে সে আর পূষণ কার মুখ দেখে যাত্রা করেছিল ! লোকে বলে, কারুর কারুর মুখ দেখে যাত্রা করলে তা আর যাত্রা থাকে না, অযাত্রায় পরিণত হয়। এ সব কথার কোনও ভিত্তি নেই সে জানে, কিন্তু এ বারে অন্তত সে বিশ্বাস করতে চাইছিল যে, এমনটাই কিছু ঘটেছে। পরশু রাতে তাদের ট্রেন জার্নির সময়টুকু ছাড়া কাল বিকেল থেকে যা শুরু হয়েছে সে আর নিতে পারছে না। কালকের ওইরকম অভিজ্ঞতার পর সে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যেতে সে উঠে পড়েছিল, তারপরেই পূষণের গাঢ় আলিঙ্গন এবং ঘণ্টাখানেকের শাওয়ার-সেক্স তাকে পুরোপুরি এনার্জেটিক করে তুলেছিল। সে ভেবেছিল, কাল যা হওয়ার হয়েছে, আজকের সারা দিন তারা এনজয় করবে নিজেদের মতো, সেই তো কাল থেকে আবার রোজকার অফিস, দৌড়ঝাঁপ ইত্যাদি চলতেই থাকবে। সে বেশ সুন্দর করে নিজেকে সাজিয়ে তুলবে ভেবেছিল। তার আগেই সে যখন নিজেকে সাজাচ্ছে আর পূষণ তৃপ্ত মুখে সিগারেট ধরিয়ে মোবাইল ঘাঁটছে, তখনই নক্ করল কেউ দরজায়।
রিমিতা তাড়াতাড়ি একটা চাদর জড়িয়ে নিয়েছিল। ব্রা-প্যান্টিতে সে বসে বসে সৌন্দর্যচর্চা করছে, এটা সবাইকে দেখানোর বিষয় নয়। পূষণ দরজা খুলে দিল তারপর। ততক্ষণে রিমিতা নিজেকে ঢেকে নিয়েছে মোটের উপর। দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে ছিল একজন অল্পবয়সী ছেলে। হাতে টি-পট, চায়ের অন্যান্য সরঞ্জাম। এই হোটেলে কেতা বেশ আধুনিক ধরণের সে শুনেছিল। অন্যান্য জায়গার মতো নয়। ছেলেটি প্রথমে ‘গুড মর্ণিং স্যার’ বলে তারপর জিজ্ঞাসা করল—
“চা স্যার?”
“হ্যাঁ, এসো।”
ছেলেটি ঘরে ঢুকে রিমিতাকেও “গুড মর্ণিং ম্যাডাম” বলে টি-পট পাশের একটা টেবিলে রাখল। তারপর বলল, “স্যার, আপনারা নিজেরা চা বানিয়ে নেবেন না আমি সার্ভ করে দিয়ে যাবো?”
পূষণ নয়, রিমিতাই জবাব দিল, “না থাক, আমরা নিজেরাই বানিয়ে নেবো। তুমি বরং ব্রেকফাস্টের অর্ডারটা নিয়ে যাও।”
“আচ্ছা ম্যাডাম। তবে আজ নাস্তা সময়ে হয়তো পাবেন না!” বলে সে পকেট থেকে নোটবুক আর পেন বার করল নাস্তার আইটেম লিখে নেবে বলে।
“কেন?” অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল পূষণ।
“আজ্ঞে রিসর্টে গন্ডগোল হয়ে গিয়েছে!”
“গন্ডগোল? আবার কী হল? না কি কালকের সেই ঘটনার জের চলছে?”
ছেলেটা বলল, “সে তো জানি না স্যার। তবে রিসর্টে কাল রাতে ভয়ানক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। একজন ট্যুরিস্ট এবং আমাদের রিসর্টের একজন রুম বয়—সুবলদা মার্ডার হয়েছে!” সে যে-ভাবে মার্ডার শব্দটা উচ্চারণ করল, তাতে বোঝা যায় সে শিক্ষিত ছেলে। এই রিসর্টে একেবারে অশিক্ষিত কাউকে অ্যাপয়েন্ট করা হয় না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৮: সত্যব্রতর ছানবিন

হ্যালো বাবু! পর্ব-৩: সুষমা দেবীর ঘরের দুটো জানালার উপরের পাল্লা খোলা ছিল

পূষণ ও রিমিতা দু’জনেই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল, “মার্ডার’’?
“হ্যাঁ ম্যাডাম, হ্যাঁ স্যার। তাও একটা নয়, দু’-দুটো! নীচে পুলিশ এসেছে, আর কলকাতা থেকে মানে কলকাতার লালবাজার থেকে একজন গোয়েন্দা-পুলিশও এসেছে, সবাইকে পুছতাচ করছে। আমাদেরও করবে। হয়তো আপনাদেরও ডাকবে! সে জন্য সবাই ব্যস্ত আছে। কিচেনে জাস্ট চা-টুকু হয়েছে। তাও ওই পুলিশ এসেছে বলেই। অন্যদিন এই সময় কত কিছু তৈরি হয়ে যায় অর্ডার মাফিক। আজ এখনো শুরুই করা যায়নি। সবার মাইণ্ড কেমন এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।” ছেলেটির গলায় উত্তেজনার সুর।
“সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ট্যুরিস্ট পার্টির কে মারা গেলেন?”
“অনিলবাবু বলে একজন। উনিই না কি পার্টির বাকিদের নিয়ে এসেছিলেন!”
“কীভাবে?” রিমিতা প্রশ্ন করল।
“কে জানে? উপর থেকে বেকায়দায় পড়ে যেতে পারেন। সকালে সবাই দেখতে পেয়েছে, মাথা পুরো চুরমার হয়ে গিয়েছে, আলাদা করে চেনার উপায় নেই।”
“সে কী!” রিমিতা বিস্ময় প্রকাশ করল।
পূষণ বলল, “আর যে রুম-বয় খুন হয়েছে বললে…”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, সুবল নাম। আমাদের জন্য কোয়ার্টার আছে রিসর্টের একদিকে। সেখানেই নিজের রুমের বাইরে মাথা থেঁতলানো অবস্থায় ভোরবেলা পাওয়া গিয়েছে। একেবারে ডেড!” বলে ছেলেটি বলল, “আপনাদের অর্ডার ম্যাডাম?”
রিমিতার ব্রেকফাস্ট করার ইচ্ছে চলে গিয়েছিল। এ কী বিপদে পড়ল তারা? এ রকম হবে জানলে কলকাতাতেই কোথাও আজ দুপুরের লাঞ্চ সারতো, নিদেনপক্ষে লঙ ড্রাইভে কোলাঘাট গিয়ে সেখানে লাঞ্চ করে ফিরে আসা যেতো! এখন ঘুরতে এসে পুলিশি চক্করে পড়ো! যাচ্ছেতাই!
শেষের কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বলে ছেলেটি চমকে উঠল। বলল, “আজ্ঞে ম্যাডাম, কিছু বললেন?”
রিমিতা নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “নাহ্, তোমায় কিছু বলিনি। আমাদের ব্রেকফাস্ট লাগবে না। এই অবস্থায় ব্রেকফাস্ট খেতেও পারব না। কিছু লাগলে পরে ম্যানেজারকে অর্ডার দিয়ে দেবো। তুমি যাও !”
“আচ্ছা ম্যাডাম। আমি আসছি তা হলে!” ছেলেটি চলে গেল।
পূষণ ধপ্ করে বসে পড়ল বেডে। “আচ্ছা, কার মুখ দেখে এ বারে বেরিয়েছিলাম আমরা মনে আছে? এরকম দুর্গতি তো কখনো হয় নি এর আগে?”
“আমিও সেটাই ভাবছি! একটার পর একটা ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে আর আমরা না-চাইতেও তাতে জড়িয়ে যাচ্ছি!”
“তুমি তোমার মামাকে ফোন করো না! আমাদের যেন পুলিশ ছেড়ে দেয়। আর এ-ব্যাপারে আমরা কীই বা জানি? আমরা তো ওদের চিনি না!”
“চেনো, কী চেনো না, সে তো তুমি আমি জানি, পুলিশ তো আর জানে না। তাছাড়া কথায় কথায় মামাকে ফোন করা উচিৎ হবে না। উনি আমাদের নানা ঝুট-ঝামেলা সামলানোর জন্য বসে নেই, তাঁকে আরো অনেকের ঝামেলা সামলাতে হয়!”
“সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু এবার আমরা কী করব সেটা তো ভাবো !” পূষণের গলায় চিন্তার সুর।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২২: এদিক ওদিক বেড়ায় তবু ভুলের পাড়া বেড়ায় না

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৫: কানে তালায় কানের ড্রপ?

রিমিতা যেন শুনতে পেল না পূষণের কথা। আপন মনেই বলল, “আমরা যে কেন ওই ব্লগ দেখে এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম ! ওই ব্লগে এত সুন্দর সুন্দর ফোটোজ আর ডেসক্রিপশন ছিল যে, জাস্ট কুল! সেটা দেখেই আমরা সাত-পাঁচ না ভেবে চলে এসে কী বিপদেই না পড়লাম!”

পূষণ বলল, “দেখ, আমাদের কপাল খারাপ, সে জন্য এমন মনে হচ্ছে। এর আগে যারা এসেছেন, তাঁদের এমন অভিজ্ঞতা হয় নি বলেই তাঁরা জায়গাটা সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলেছেন। এর আগেও তো ওই ব্লগ দেখে আমরা এদিক ওদিক গিয়েছি, তাই না ? এমন বিপদে তো পড়তে হয় নি !”
রিমিতা হঠাৎ বলল, “আচ্ছা পূষণ, একটা কথা মনে পড়ছে কি তোমার ?”
“কোন্ কথা ?”
“ওই ব্লগটা তুমি-আমি কেউই প্রথমে ফলোআপ করতাম না। ইন ফ্যাক্ট ওই ব্লগটা যেন নিজের থেকেই আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া পেজে দেখা দিয়েছিল!”
“ধ্যুস্! কেউ নিশ্চয়ই আমাদের রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল কিংবা আর কারুর ওয়ালে দেখে আমরা ইন্টারেস্টেড হই। তা না হলে, ওই ব্লগটা কি জীবন্ত কিছু যে নিজের থেকে হেঁটে আমাদের ওয়ালে এসে গাঁট হয়ে বসে পড়লো?” পূষণের গলায় ব্যঙ্গের সুর। চিন্তারও। বিষয়টা তাকেও ভাবাচ্ছে।
“আচ্ছা পূষণ, তুমি এক বছর আগেও জানতে যে পিশাচ পাহাড় বলে একটা ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন আছে?”
“নাহ্! মনে পড়ছে না!”
“আমার কিন্তু বেশ মনে আছে। আমি প্রথমে নাম দেখে ভেবেছিলাম অলৌকিক কিছু। পরে দেখলাম এটা একটা পাহাড়ের নাম!”
“পাহাড় বলো না, বলো টিলা। পাহাড় বড়সড়ো ব্যাপার। এটা সামান্য একটা টিলা। তার ছবিও তো ছিল ব্লগে!”
“হ্যাঁ। সে যাই হোক। কিন্তু পরে নানা উচ্ছ্বাসময় ফিডব্যাক পড়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এখানে আসব। কিন্তু এখানে আসার পথে তুমি যা-যা শুনলে, আমাকেও তার কিছু কিছু বলেছ, যদিও সবটা বলার সুযোগ পাওনি, তবুও যা শুনেছি তাতে মনে হয়, এখানে সত্যি সত্যিই অলৌকিক কিছু আছে। এমন কিছু যে মানুষজনকে মারছে, খাচ্ছে, আক্রমণ করছে…! কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন কী ঠূঁটো জগন্নাথ ? তারা কিছু তো একটা বলবে! কাল দেখে মনে হল, তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে, এটা আসলে ভূত-প্রেত-পিশাচের কাজ। তাকে সামলানো পুলিশের কম্ম নয়। তাহলে কী এই ভাবে একের পর এক মানুষের মরে যাওয়াই আলটিমেট ফেট?”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫১: সেই ‘পৃথিবী আমারে চায়’

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৯: ইষ্টদেবী জগদ্ধাত্রী

“কথাটা আমি ভেবে দেখেছি রিমি। কিন্তু উত্তর কী দেবো বুঝতে পারছি না। কাল অন স্পট দাঁড়িয়ে ঈশ্বরীপ্রসাদ কালাদেওর অভিশাপ মুক্তির উপায় বাতলেছে, ভবানীপ্রসাদ রায় ইতিহাস শুনিয়েছেন এবং মঙ্গল মাহাতো ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে শুরু করেছেন। সব কিছুর মাঝে দাঁড়িয়ে, সকলের বক্তব্য শুনে পূষণ কনফিউজড্ ! কিন্তু এমন সুন্দর একটা ভোরে কারা কারা মারা গিয়েছে, যারা তাদের অচেনা কেউ, তাদের জন্য শোক করে পূষণ আর রিমিতা কী করবে—তা সে ভেবে পেল না।
চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। রিমিতা বসে ছিল। পূষণ নিজেই এগিয়ে গেল। দেখা যাক, চা খেলে যদি বুদ্ধি বাড়ে।
সবে টিপট থেকে চা ঢেলেছে কাপে, এমন সময় দরজায় আবার নক্ হল। আবার কে? পূষণ অবাক হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খুলতে না খুলতেই আবার নক্ করল কেউ। মৃদু। কিন্তু করল। দরজা খুলে দিয়ে অবাক হয়ে গেল পূষণ!—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content