রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

কাল রাতে অনেকখানি কাবাব খেয়ে ফেলেছিল অঞ্জন। সঙ্গে বেশ কয়েক পেগ। আসলে এই ওয়াইনটায় এত জমাটি নেশা হয়, আর টেস্টও এত ভালো যে, সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেনি। নিজেদের রুমে ঢুকে কোনরকমে জামাকাপড় ছেড়ে সেই যে বিছান নিয়েছিল, তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই নেই। উন্মেষা কী করছিল কে জানে? পার্টির মুড যদিও কাল কারওই ছিল না, কেমন যেন সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তার উপর পার্টি জমে ওঠার মুখে পুলিশের আগমন, মিসিং অর্কর হেড ছাড়া বডি পাওয়ার কথা শোনা, সবার সব মুড নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। দিয়েওছিল। উন্মেষা অবশ্য পার্টিতে সারাক্ষণ উপস্থিত ছিল। এমনকি অঞ্জনের মনে পড়ছে, বার-দুই তাকে পেগ তুলেও দিয়েছে সে। তারপর আর কিছু মনে পড়ছে না অঞ্জনের।

উন্মেষার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর এই প্রথম তাদের এতদূরে আসা। অঞ্জন ভেবেছিল একটা দুর্দান্ত ট্রিপ হবে। জমিয়ে সেক্স আর মস্তি করবে তারা সকলেই। অর্ক আর অনিল ছাড়া বাকিরা সে কারণেই জোড়ায় জোড়ায় এসেছিল। অনিলের আবার কল গার্লদের সঙ্গে বেড শেয়ার করতে ভালো লাগে। এক সময় তারও লাগত। এখনও মাঝে মাঝে সে স্বাদ বদলের জন্য কল গার্লদের নিয়ে ফূর্তি ফার্তা করে না এমন নয়। কিন্তু তার এখন ভালো লাগে কম বয়সী উইডো কিংবা অসহায় গৃহবধূ কিংবা কলেজ গার্লদের সঙ্গে ফূর্তি করতে। কল গার্ল যতই আলাদা আলাদা জন হোক না কেন, তাদের সার্ভিসের কতগুলি মনোটোনাস টাইপ আছে। একঘেঁয়ে লাগতে বাধ্য। সেটা বাকিদের ক্ষেত্রে হয় না।
উন্মেষার ব্যাপারটা কিছুটা আলাদা। অঞ্জন ঠিকই করেছে, উন্মেষাকে সে বিবাহ করবে। তার অফিসে সকলেই জানে বিষয়টা। প্রাইভেট সেক্রেটারির সঙ্গে অনেক বসই সম্পর্ক তৈরি করে কিংবা করতে বাধ্য করে, কিন্তু অঞ্জন সেই চেনা পথ থেকে আর-একটু বেশি এগোতে চায়। বিয়েই করতে চায়। কারণ, উন্মেষার মধ্যে এমন একটা ডিগনিটি আছে যে, চাইলেই তার সঙ্গে শোয়ার কথা ভাবা যায় না। অদ্ভুত এক ব্যক্তিত্ব আর মেলানকলিক এক সম্মোহিনী শক্তি তার চারদিকে একটা অদৃশ্য বলয় তৈরি করে রাখে। আগুনের মতো। মনে হয়, সেই বলয় পার হওয়া অসম্ভব। অঞ্জনকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি, উন্মেষাকে রাজি করাতে। তবে উন্মেষা শর্ত দিয়েছে, বিয়ের আগে তারা যেখানে খুশি ঘুরতে যেতেই পারে, কিন্তু কোন রকম শারীরিক সান্নিধ্য যেন অঞ্জন আশা না করে। তা সে পারবে না। তার মূল্যবোধ এবং পারিবারিক শিক্ষায় বাধে।

প্রথম যেদিন উন্মেষা বলে এই কথাটা অঞ্জনের মুখে খিস্তি এসে গিয়েছিল। এই রকম কত সতী-সাবিত্রীকে সে বিছানায় ক্ষতবিক্ষত করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। উন্মেষাকে চাইলেও পারে। কিন্তু ওই যে, উন্মেষার মধ্যে একটা সম্মোহিনী শক্তি আছে, যা সামনে দাঁড়ানো হিংস্র বাঘকেও কাবু করে দিতে পারে। ফলে চাইলেও অঞ্জন কিছু করতে পারেনি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৫: খটকার পর খটকা

গল্পের ঝুলি: নীল রঙের বিগ-শপার

উন্মেষার আদি বাড়ি উত্তর কলকাতায়, বাগবাজারের কাছে। তবে শরিকি সেই বাড়িতে অনেক দিন থাকলেও, যাদবপুরে পড়ার সময় থেকে তারা শরিকি বাড়ি ছেড়ে কসবা অঞ্চলে ফ্ল্যাট কিনে উঠে যায়। তার এক দাদা আছে, থাকে বেঙ্গালুরুতে, আর এক ভাই সে এখনও কসবার ফ্ল্যাটেই থাকে। বিয়ের পর উন্মেষারা বাইপাসের ধারে একটা অভিজাত আবাসনে ফ্ল্যাট কিনে থাকতে শুরু করেছিল। হিরন্ময় বেঁচে থাকলে আজ উন্মেষার জীবনটা যে অন্যরকম হতো সন্দেহ নেই। অঞ্জনের পিএ-র চাকরি করে নিশ্চয়ই তাকে দিন গুজরান করতে হতো না। হিরন্ময়ের মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসেবে বিদেশি এয়ারলাইন্সের কাছ থেকে মোটা টাকা পেলেও উন্মেষা সেটা উড়িয়ে দেয়নি। এমনিতেই সে খুব হিসেবী। বুঝেশুনে খরচা করে। অঞ্জনকেও তার জন্য অপ্রয়োজনীয় খরচা করতে দেয় না। বলে, “বিয়ের পর যা দরকার হিবে, কেবল সেইটুকুই নেবো। বাকিটুকু অসময়ের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে হয়। তাহলে আর পরে অসুবিধার মুখে পড়তে হয় না। আমার জীবনের অভিজ্ঞতা আমাকে এমনটাই শিখিয়েছে।”

কথাটা যে সে মিথ্যে বলেনি, তা অঞ্জন মানে। নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকেই মানুষ শেখে। এ কারণেই অঞ্জন আর আপত্তি করেনি, করেও না। উন্মেষা ডিমান্ডিং নয়। শাড়ি-গয়না কোনও কিছুই নিজের থেকে চায় না। অঞ্জন কখনও কিছু গিফট্‌ করলে রাগ দেখায়, কিন্তু নিয়ে নেয়, তুলে রাখে। বলে, “আগে সব কিছু ঠিকঠাক এগোক, তারপরে ও-সব নিয়ে ভাববো।” অঞ্জন জোর করে না। তার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জ আছে। নিজের কাছে নিজের করা চ্যালেঞ্জ। উন্মেষাকে সে বিয়ে করেই তার দর্প চূর্ণ করবে। ওকে বুঝিয়ে দেবে, অঞ্জন যা চায়, তা হাসিল করেই ছাড়ে। যদিও উন্মেষাকে ঘূনাক্ষরেও টের পেতে দেয়নি তার মনের কথা। টের পেলে উন্মেষা সেই মুহূর্তে চলে যাবে, একবারও ভাববে না চাকরি কিংবা তার ফিউচারের কথা।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৯: সত্য কাজে কেউ নয় রাজি সবই দেখি তা না না না?

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

মাথাটা ভার ভার লাগছিল অঞ্জনের। বুঝতে পারছিল, তার এখন এক কাপ কড়া কফি দরকার। হ্যাং-ওভার কাটেনি এখনও। উঠে বসল সে। তার পরনে স্লিপিং স্যুট। আগে ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার। চোখে-মুখে ভালো করে জল দিয়ে তারপর কফির অর্ডার দিতে হবে। উন্মেষা সকালে কফি খায় না। তার বেড-টি দরকার। আচ্ছা সেও কী ঘুমিয়ে আছে এখনও। অঞ্জন পাশের বেডের দিকে তাকালো। তারা সিঙ্গল বেডরুম নেয়নি, উন্মেষার ইচ্ছাতেই দুটি সেপারেট বেডওয়ালা সিঙ্গল রুম নিয়েছে। এক বিছানায় বিয়ের আগে না শুতে চাওয়ার সেই বিশুদ্ধ সতীপনা। হাসিও পায় অঞ্জনের। পরপুরুষের সঙ্গে এক ঘর শেয়ার করতে অসুবিধে নেই, কেবল এক বেডে শুলেই যত গণ্ডগোল?

সে তাকিয়ে দেখল, এই মুহূর্তে উন্মেষার বেড খালি। তার মানে অনেক আগেই উঠে পড়েছে সে। জানালায় পর্দা টানা। সরিয়ে দিয়ে বাইরে তাকালো সে। রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে। টেবিলের উপর থেকে মোবাইলটা টেনে নিয়ে সময় দেখল সে। ন’টা ! এত বেলা পর্যন্ত ঘুমাচ্ছে সে! কী যেন করার কথা ছিল আজ সকালে? মনে করার চেষ্টা করতেই মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। রুম সার্ভিসের জন্য ডায়াল করল সে। অদ্ভুত ব্যাপার, কেউ ফোন তুলছেই না। মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছিল তার। এখন তাকে নীচে নামতে হবে এই পোশাকেই। তারপর করা কফির অর্ডার দিতে হবে। সে ভেবেছিল পিশাচ পাহাড় রিসর্টের ব্যবস্থাপনা বেশ ভালো, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, তা নয়। সে দরজা খুলে বেরুতে যাবে, এমন সময় দরজায় কে নক্‌ করল।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৯: আহা, মরি—কেটেলবেরি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৫: সারদা মায়ের রোগ নিরাময়

রুম-সার্ভিস ভেবে সে দরজা খুলে কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। মাথাটা গরম হয়ে গেল তার। এ আবার কী ইয়ার্কি। সে একটা ইংলিশ খিস্তি মেরে দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল, ঠিক তখনই চোখে পড়ল তার দরজার সামনে একটা মুখ বন্ধ বড় এনভেলাপ পড়ে। তবে কী এটা দিতেই কেউ এসেছিল। সে কিছুটা অবাক হয়েই সেটা তুলে নিল। উপরে তার নাম লেখা। আর লেখা—পিশাচ পাহাড় রিসর্ট। এখানকার ঠিকানায় তাকে কেউ এনভেলাপ পাঠাতে পারে, এমন তার ধারণাতেও ছিল না। এটার মধ্যে হালকা শক্ত কিছু আছে। কাগজের মতো। সে মুখ বন্ধ এনভেলাপের সামনের অংশ ছিঁড়ে ভিতরের কাগজ বার করে আনল। সাধারণ কাগজ না, আসলে আর্ট পেপারে ছাপা কয়েকটা ছবি। ছবি তো নয়, যেন আগুনের গোলা। থরথর করে কেঁপে উঠল অঞ্জন। ছবিগুলি পড়ে ছত্রাখ্যান হয়ে গেল করিডোরে।

কে.কে পাঠালো এই ছবিগুলি? তার অন্ধ অতীত যেন তার সামনে জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠল। সে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছবিগুলি কুড়িয়ে নেওয়ার মতো শক্তিও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে!—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content