রবিবার ১৯ জানুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

কাপাডিয়া হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। কী করবেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না। থানায় লোক পাঠিয়েছেন ঘন্টাখানেক হয়ে গেল। এখনও সে লোক ফিরে আসেনি। তাকে ফোন করে জানেছেন, থানার বাবুরা সব কোথায় না কি তদন্ত করতে গিয়েছেন, ফিরলে সে রিপোর্ট করবে।

বিরক্ত কাপাডিয়া নিজেই ফোন করেছিলেন। অভিষেক মালাকারের সঙ্গে তাঁদের মাসিক বন্দোবস্ত। এ সমস্ত রিসর্টে অনেকেই এর-ওর-তার বউ কিংবা লাইনের মেয়েদের নিয়ে ফূর্তিফার্তা করতে আসে। রেইড-ফেইড হলে খুব মুশকিল। তা অভিষেকবাবু এ দিক থেকে দয়ার সাগর। মাসিক মাল পৌঁছে গেলেই আর এ দিকে তাকান না, তাকালেও মরুভূমি দেখেন। খচ্চর আছে সেকেন্ড অফিসারটা। ব্যাটাচ্ছেলের খাঁই কত তা ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি এখনও কাপাডিয়া। তবে গভীর জলের মাছ, সে বেশ বোঝা যায়। আপাততো অভিষেক মালাকারই তাঁকে বাঁচাতে পারবেন। কিন্তু তিনি তো ফোনটাই তুললেন না। ঠিক কোথায় আর কিসের তদন্তে গিয়েছেন, সেটাও জানার উপায় নেই।

এ দিকে শিয়রে দু’দুটো লাশ নিয়ে বসে থাকা যে কত যন্ত্রণার, তা যদি কেউ বুঝতো! এই রকম অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম। এর আগে যেখানে ছিলেন, সেখানে সুইসাইড কেস দেখেছেন, কিন্তু এই রকম নৃশংস ভাবে খুন? নাহ, দেখেননি। এই জন্যই তাঁর হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ভয়ে। মালিককে ফোন করেছিলেন, তিনিও ধরেননি। হয়তো বাইরে কোথাও আছেন। সেখানে এখন রাত। তিনি যে কখন কোথায় থাকেন। আজ অবধি তাঁকে চোখের দেখাই দেখলেন না। যাই হোক, মেসেজ করে দিয়েছেন। দেখা যাক, কতক্ষণে রিপ্লাই আসে!
সাতসকাল বেলা খবরটা তাকে দিয়ে ঘুম ভাঙিয়েছিল অনন্ত। অন্যদিন তিনি উঠে পড়েন ছ’টা বাজলেই। কিন্তু কাল অনেকটা রাত হয়েছিল, তার উপর পুলিশের ঝামেলা, ফলে শুতে যেমন রাত হয়েছিল, তেমনি শুয়ে পড়লেও ঘুম আসেনি অনেকক্ষণ। ফলে কখন যে ঘড়ির কাঁটা সাতটা পেরিয়ে আটটার ঘরে গিয়ে পৌঁছেছিল, তা টেরও পাননি তিনি। এমনিতে যদিও পরের দিনের ডিউটি চার্ট থেকে শুরু করে সকালবেলায় ব্রেকফাস্টে কিচেনের মেনু ইত্যাদি আগের দিন সন্ধেতেই বুঝিয়ে দেন তিনি।

নটবরলাল অনেকদিনের কুক, সে ঠিক জানে কী করতে হবে। তার হেল্পার কাম অ্যাসিস্টান্ট চিন্টুও এ-ব্যাপারে বেশ তৈরি ছেলে। মুখের কথা খসতে না খসতেই প্রয়োজনীয় জিনিস এনে হাজির করে। ফলে কোনও কোনওদিন উঠতে সামান্য দেরি হলেও বেশি চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু আটটা মানে অনেকটা বেলা। তার উপর দরজায় এমন করাঘাত করে ঘুম ভাঙাতে তাঁকে কখনও হয়েছে বলে তাঁর মনে পড়ছে না। দরজা খোলার আগে অভ্যাস মতো পাশে রাখা মোবাইল দেখেছিলেন তিনি, দশ দশটা মিসড কল। কে করেনি? অনন্ত, বিকাশ, নটবরলাল, চিন্টু। কেবল সুবলের ফোন থেকে কোন ফোন আসেনি। সে ঘোড়েল ছেলে। নিশ্চয়ই নিজের ধান্দায় আছে। কোন পার্টিকে খুশি করছে আশেপাশের ইনফরমেশান যুগিয়ে, যাওয়ার সময় যাতে ভালো মতো টিপস পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩৩: একেজি সকাশে

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৮: ও দয়াল! বিচার করো!

কিন্তু বাকিরা এমন ভাবে তাঁকে ফোন করে, দরজায় ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙাতে চেষ্টা করছে কেন বুঝতে পারলেন না। তারপর মনে হল, কোনওদিন এত বেলা অবধি তাঁকে ঘুমাতে দেখেনি, ফলে তারা খারাপ কিছু ঘটেছে ভেবে উদ্বিগ্ন হয়ে ফোন আর দরজায় ধাক্কা মারছে। এ-কথা মনে হতেই মনটা একটু খুশিয়াল হয়ে উঠলো। বেশ হাসি হাসি মুখেই দরজা খুলেছিলেন তিনি। ঠোঁটের ডগায় এসেই গিয়েছিল, “আরে এত চিন্তিত মত হো… ম্যায় ঠিক হুঁ…”, কিন্তু ওদের প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ আর নটবরলালের থরথর করে কাঁপতে থাকা শরীরখানা দেখে তাঁর মুখের কথা মুখেই রয়ে গিয়েছিল। বরং একটু ধরা গলায় উৎকণ্ঠিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন, “ক্যা হুয়া? সভেরে সভেরে…”।

তার মুখের কথা খসতে দিল না অনন্ত, বলল, “বহুত গজব হো গ্যায়া মালিক! বাহার মে দো দো লাশ পড়ি হুয়ি হ্যায়!”

“ক্যা?” কাপাডিয়ার এবারের প্রশ্নটা আসলে জিজ্ঞাসা নয়, আর্ত চিৎকার !

“জি মালিক!” অনন্ত বাঙালি হলেও মালিককে খুশি করতে মাঝেমধ্যেই হিন্দি বলে। যদিও তাতে কাপাডিয়া আজ অবধি খুশি হয়েছেন কি না বোঝা যায়নি। অনন্তের মাসিক প্রাপ্য এক টাকাও বাড়েনি অন্তত।

কাপাডিয়া অখুশি মুখে বললেন, “সভেরে সভেরে দিল্লাগি করতে হুয়ে শরম নেহি আতি তুঝে? কী হয়েছে ঠিক করে বোল?”

বিকাশ বলল, “স্যার, বাগানে দু’ দুটো লাশ পরে রয়েছে। তার মধ্যে একজন সুবল। মনে হচ্ছে কালাদেও। মাথা একেবারে কেটে খেয়ে গিয়েছে। বডির বাকি অংশ দেখে যদিও বোঝা যাচ্ছে সুবলই !”

“কী বলছিস? সুবলকে কালাদেও কাহে খায়েগা? ক্যা কিয়া উনহোনে?”

“সে তো আমরাও ভাবছি। সুবল তো কারুর সাতে পাঁচে থাকত না। কালাদেওর থানে সেই কবে এখানে
আসবার পর পর একবার গিয়েছিল। ফল-মিষ্টি দিয়ে পূজাও চড়িয়ে এসেছিল। তারপর আজ অবধি আর তো কোনওদিন তাকে সে দিক মাড়াতে দেখিনি। তাহলে?”

“আমিও তো কিছুই বুঝতে পারছি না!” হতভম্ব কাপাডিয়া বললেন, “কিন্তু আর একটা লাশ বললি, উয়ো কৌন হ্যায় রে?”

“ওই যে, যে ভদ্রলোক পার্টির সঙ্গে এসেছিলেন। সিঙ্গল রুমে ছিলেন, তিনি।”

অনন্ত এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে। বিশুদ্ধ মাতৃভাষায় বলল, “আমি জানি, অনিলবাবু। উনিই তো ওদের লিডার। ওদের হয়ে যাবতীয় কথাবার্তা তো উনিই আমাদের সঙ্গে বলেন। হ্যায় না মালিক?”
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৮: চোখিধানির জগৎখানি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৩: নহবতবাড়ির ‘এতটুকু বাসা’

“কী? অনিল বাবু?” কাপাডিয়ার মনে হল তিনি এ বার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন না। পড়ে যাবেন। আজ সকালেই মর্গে এদের সকলের লাশ দেখতে যাওয়ার কথা। অর্ক নামের যে ছেলেটি মিসিং আছে, তার লাশ কি না, তা দেখার জন্য পুলিশ সকালে সকলকে মর্গে গিয়ে আইডেন্টিফাই করতে বলেছে। তার আগে অবশ্য থানায় সকলকে কিছু এজাহার দিতে হবে। এত তাড়াতাড়ি মর্গের কাজ মিটোবে না। কাল সন্ধের ব্যাপার। পুলিশ রাতে লাশ উদ্ধার করেছে। সকালে ডাক্তার আসবেন, তারপর বডি কাটাছেঁড়া হবে। তারপর তো পার্টি দেখবে। কিন্তু সে-সব এখন বহুত দূর! লাশ দেখতে যাওয়ার আগেই আর একজন লাশ হয়ে গেল। তার উপর সুবলকে কালাদেও খেলো! এ তো ভয়ানক ব্যাপার।

কাপাডিয়া কোনরকমে জিজ্ঞাসা করলেন, “অনিল বাবু কো ভি কালাদেও নে মারা ক্যা?”

কেউ উত্তর দেওয়ার আগে বলল চিন্টু, “আমার মনে হয় স্য্যার, স্যুইসাইড করেছেন। উপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে!”

“এই রিসর্টের দোতলা থেকে ঝাঁপ দিলে কেউ মরে না, বড় জোর হাত-পা ভাঙতে পারে। আমার তো মনে হচ্ছে খুন!”

কে, কে বলল কথাটা? তাদের মধ্যে কেউ বলেনি বলেই সকলে চমকে তাকিয়ে দেখে এক তলার কোণের ঘরে থাকা অজয় বাবু চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। হ্যাঁ, কথাটা তিনিই বলেছেন।

“এ কী! অজয় বাবু! আপনি?” কাপাডিয়া বিস্ময়মাখা বোকা বোকা প্রশ্নটি করে ফেললেন।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৭: ‘কর্ণ’nicles

পালকিতে যেতে যেতে লেখা হয়েছিল ‘বর্ণপরিচয়’

অজয় বাবু বললেন, “হ্যাঁ আমিই। আজ সকালে চেঁচামেচি শুনে বাইরে এসে দেখি এই কাণ্ড! দু’ দুটো ডেডবডি পড়ে রয়েছে কম্পাউন্ডের মধ্যে। একটি আপনাদের কোন সো কলড কর্মচারির, নাম জানি না। বীভৎস মৃত্যু। মাথাটা একেবারে কচাৎ করে কেটে নিয়েছে কেউ… ”

অনন্ত মাঝপথে তাঁকে থামিয়ে বলল, “আজ্ঞে, আর কে? কালাদেও!”

“সে যেই হোক। কিন্তু অনিলবাবু দেখলাম উপুড় হয়ে পড়েছেন। সে ক্ষেত্রে সাধারণ বুদ্ধি বলে, যদি চোট বেশি লেগেও থাকে এবং বেকায়দায় পড়ার ফলে মৃত্যু হয়েই থাকে, তাহলে মাথার সামনের দিকটা থেঁতলে যাবে কিংবা চুরমার হবে, কিন্তু এক্ষেত্রে দেখলাম পুরো মাথাটাই একেবারে গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। এমনটা কিন্তু সাধারণ ভাবে হওয়ার কথা নয়। যদি না…”

সকলে প্রায় সম্মিলিত ভাবে একক প্রশ্ন করল, “যদি না…?”

অজয় বাবু গম্ভীর মুখে বললেন, “যদি না, কেউ আগেই ওনার স্কাল ভারি কিছুর আঘাতে চুরমার করে দিয়ে ওপর থেকে নীচে ছুঁড়ে ফেলে। তবেই এভাবে স্কাল গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাওয়া পসিবল!”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content