মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

একেজি-র ঘরে বসেছিল শাক্য ও পাভেল। একেজি কোনও কথা বলছিলেন না। চুপ করে শুনছিলেন কেবল। উনি আজ বক্তা না, শ্রোতা। শাক্য আর পাভেল কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। সারারাত ফাইল পড়েছে তন্ন তন্ন করে। এখন সকাল আটটা। একেজি-কে ওরা টেক্সট মেসেজ করেছিল। এমনিতে উনি সাড়ে আটটা-ন’টার মধ্যেই অফিসে চলে আসেন। আজ একটু আগে এসেছেন। এসেই ডাক পাঠিয়েছেন শাক্য এবং পাভেলকে। ওরা দু’জনেই এই ডাকটারই অপেক্ষা করছিল। বেশ কয়েক রাউন্ড চা, শাক্যর দিদির হুমকি ফোন ইত্যাদি শেষ হয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। শাক্য এবং পাভেল ডাক পেয়েই আর দেরি না করে তক্ষুনি ছুটল। ইতিমিধ্যেই দু’জনের মধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। সেই কথাই শাক্য বলছিল একেজি-কে। তিনি শুনছিলেন মন দিয়ে। মাঝেমধ্যে একটি দু’টি প্রশ্ন করছিলেন। শাক্য কিংবা পাভেলের কথা শুনে তাঁর মুখে কোন অভিব্যক্তি ফুটে উঠছিল না। বোঝাই যাচ্ছিল না, তিনি সিরিয়াসলি শুনছেন না কী শুনছেন না! যদিও শাক্যরা ইতিমধ্যেই জেনে গিয়েছে যে, এটাই স্যারের সিগনেচার স্টাইল। এই ভাবলেশহীন মুখের আড়ালে এখন হয়তো তোলপাড় চলছে। এক নিমেষে হয়তো সমাধান করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেবেন।

শাক্য বলছিল, “স্যার, আমরা দুজন সারারাত ধরে ফাইল তিনটে পড়ে যা বুঝেছি, তাতে মনে করা যেতেই পারে যে, কেসটা আপাতভাবে সরল মনে হলেও আদতে জটিল। এ-কেস কেবল ফাইল স্টাডি করে সমাধান করা সম্ভব নয়।”

“কেবল ফাইল পড়ে যে কেসটা সলভ করা সম্ভব নয়, তা আমি বুঝেছিলাম বলেই তোমাদের দু’জনকে ফাইলগুলি পড়তে দিয়েছিলাম। কিন্তু কেসটা জটিল বলে মনে হওয়ার কারণ?”

“স্যার, মনে হচ্ছে কেসটায় কিছু না কিছু ফাউল প্লে আছে!”

“যেমন ?”

“প্রথমেই ধরে নেওয়া যাক, কালাদেও সংক্রান্ত মিথ! মিথটি বহু পুরাতন বলে দাবি করেছেন জনৈক ভবানীপ্রসাদ রায় নামের একজন শিক্ষক-প্রতিবেদক। তা যদি হয়, তাহলে শ’-পাঁচেক কী তার বেশি একটি মিথ চালু আছে, কখনও কেউ দেখেনি শনেনি যে, কালাদেও এ ভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাও আবার তার নিশ্চিত শেলটার ছেড়ে, এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে কেমন যেন লাগছে!”
পাভেল লক্ষ্য করল, শাক্য “আমি” না বলে “আমাদের” ব্যবহার করল। পাভেল একটু নড়েচড়ে বসল। শাক্যর এই নেচারটা তার খুব ভালো লাগে। সে কখনও নিজে একা কৃতিত্বের ভাগ নিতে চায় না, সবসময় টিমের সকলের সঙ্গেই কৃতিত্বের স্বাদ ভাগ করে নেয়।

একেজি বললেন, “হতেই পারে। একটানা গোপন শেলটারে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছেন হয়তো ওই কালাদেও!” তাঁর ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি।
শাক্য বলল, “সেক্ষেত্রেও কালাদেও এমন হঠকারী কাজ করবে বলে মনে হয় না। যে এতকাল ধরে পাতাল-গুহায় আত্মগোপন করে রইল, যার পূজার শেষে কেউ পিছু না ফিরে চলে যায়, তিনি বলি ও অন্যান্য উৎসর্গ গ্রহণ করলে তবেই পরের দিন সেই থানে যাওয়ার অনুমতি মেলে, এটা থেকে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা চলে, কালাদেও হয় নিজের মুখ আর কেউ দেখুক, এটা চায় না; নতুবা, কালাদেও নামক মিথটাই মিথ্যে। রাত্রির শেষ প্রহরে পুরোহিত ও ওঝাদের কেউ কিংবা কেউ কেউ ফিরে এসে উৎসর্গীকৃত সব সামগ্রী নিজে আত্মস্যাৎ করে। পাছে আর কেউ সেই চুরি দেখে ফেলে, অতএব এই রকম রিচ্যুয়াল চালানো হয়েছে। আর তা যদি হয়, তাহলে বলতে হয়, কালাদেও বলে কোনকালে কিছু ছিল না, এখনও নেই!”
একেজি মুখে কেবল বললেন, “তোমার যুক্তি অকাট্য, তবুও…!”

“তবুও বলে কিছু নেই স্যার! কালাদেও বলে কোন কিছু যদি থেকেও থাকে, সে এতটা রিস্ক নেবে কেন? সে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে, একের পর এক মানুষকে তার শিকার বানানোর জন্য। এটা কি সম্ভব? এতকাল সে যেন শীতঘুমে ছিল জেগে উঠে উৎপাত শুরু করেছে। তারপরে তার আক্রমণের টাইমিং দেখুন। কখনও রাতে, কখনও মাঝদুপুরে, আবার কখনও ভোরে। সে তো দিব্যি রাতের অন্ধকারে এসে তার শিকারকে হত্যা করে আবার গুহায় ফিরে যেতে পারত! তাহলে? কে সে ধরা পড়বার ভয় থাকা সত্ত্বেও এমনসময় সে প্রকাশ্যে আসছে যে, যে-কেউ তাকে আইডেন্টিফাই করতে পারবে। এটা কি আশ্চর্যের বিষয় নয়?”
একেজি বলল, “বেশ! ক্যারি অন!”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩২: পুরনো মোকামের জঙ্গল

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৭: আমি শুধুই উদাস, জলজ্যান্ত লাশ

শাক্য বলল, “কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দ্দশীতে কালাদেওর পূজা স্থানীয় মানুষদের মধ্যে প্রচলিত। সেই পুজোয় যদি কোনও বিঘ্ন ঘটত কিংবা ভুলচুক, তাহলে কালাদেওর রাগ করাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে পুজোর পর পরই কালাদেও ক্রুদ্ধ হয়ে আক্রমণ শাণাতে পারতো। তা না করে সে অপেক্ষা করে রইল চৈত্র মাস পর্যন্ত! এতদিনে তো হিংস্র প্রাণিরও রাগ পড়ে যায়, কালাদেওর পড়ল না? না কী, কালাদেও শীতঘুমে গিয়েছিল? জেগে উঠে প্রতিশোধ নিতে শুরু করল!”

“এই চৈত্র মাসটা তুমি বলছ কিসের ভিত্তিতে শাক্য?” প্রশ্নটা করল পাভেল।
শাক্য বলল, “তুমি যে দ্বিতীয় ফাইলটা দেখছিলে, সেখানে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির পেপার-কাটিংগুলি আছে। আমি যখন পড়ছিলাম, তখন একটা নোটস রেখেছিলাম। সেটা যদি দেখানো যায়, তাহলেই বুঝবে, কালাদেওর হাতে প্রথম ভিকটিম তিনকা মুর্মু। সে নিহত হয় ২০২২ সালের ৩রা এপ্রিল। সাধারণ শ্রমিক। মাটি কাটা, পাথর ভাঙার কাজ করে। সেদিন কাছাকাছি একটি অঞ্চল থেকে মাটি কেটে ফিরছিল। দলের সঙ্গেই ছিল। মদ্যপান করেছিল ভালো মতো। কমবেশি সবাই খেয়েছিল। সঙ্গীদের সঙ্গেই আসছিল, তবে প্রাকৃতিক কাজ করবার জন্য দাঁড়ায়। সঙ্গীরা কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিল। কেউ আর খেয়াল করেনি। কোন আওয়াজ শোনেনি কেউ। পরে হুঁশ হতে খোঁজাখুঁজি করার সময় তার মুণ্ড বিহীন লাশ পাওয়া যায়। তবে কালাদেও মুণ্ড চুরি করলেও তার পরিচয় গোপন থাকেনি। যাই হোক সময়টা খেয়াল করো। এপ্রিলের গোড়ার দিক, মানে চৈত্রের প্রায় শেষ। এই কারণেই বললাম, কালাদেও কেন এতদিন অপেক্ষা করলেন?”
একেজি বললেন, “পরের ভিকটিম?”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৮: আমি শুনি গো শুনি তোমারে…

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৯: তুনে ও রঙ্গিলে ক্যায়সা জাদু কিয়া… লতার সেই সুরেলা কণ্ঠ ও পঞ্চমের জাদু

শাক্য বলল, “গণেশ দাঁ। স্থানীয় ব্যবসায়ী। মশলার আড়ত আছে। কলকাতা থেকে মাল কিনে ফিরছিলেন। সঙ্গে অনেক টাকা ছিল। প্রায় হাজার চল্লিশের মতো। যে আড়তে মাল কিনেছিলেন, তারাই সাক্ষ্য দিয়েছে। প্রায় হাজার ত্রিশেক টাকার মালের অর্ডার দেওয়া এবং পেমেন্ট করা হয়েছিল। মাল সাধারণত পরে পৌঁছে দেওয়া হয়। একাই ছিলেন। স্টেশন থেকে নেমে চা খেয়েছিলেন সামনের একটা দোকান থেকে, তারপর আর কোথায় গিয়েছিলেন জানা যায় না। লাশ মেলে তাঁর বাড়ি যেদিকে, তা একেবারে বিপরীত দিকে। যেদিকে লোকালয় কম। অথচ অদিকে কেন গিয়েছিলেন, তা জানা যায়নি। ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বরের ঘটনা। উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর সঙ্গে যে টাকা ছিল, সেই টাকা পাওয়া যায় নি। তবে দামি মোবাইল, আংটি ইত্যাদি খোওয়া যায়নি। একটা কথা ভাবাচ্ছে এই ঘটনা থেকে, কালাদেও তার শিকারকে হত্যা করে আনন্দ পাচ্ছে ঠিক আছে, কিন্তু তার টাকার কী দরকার? সে ওই টাকা নিয়ে দোকানে জিনিস কিনতে পারবে না, মাংসের দোকানে গিয়ে আস্ত পাঁঠা কিনে হাড় চিবুতে পারবে না, তাহলে? তবে কী, কালাদেওরও টাকার দরকার হয়? কিসের জন্য?”
একেজি বললেন, “এই পয়েন্টটা ইন্টারেস্টিং। এটা নিয়ে ভেবো। হয়তো, এর মধ্যেও সূত্র থাকলে থাকতে পারে!”
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৭: ভিস্তা ডোমে তিস্তার দেশে

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

শাক্য বলল, “থাকতে পারে নয় স্যার, নিশ্চয়ই আছে। সেটা আমাদের খুঁজে বার করতে হবে!”
পাভেল বলল, “আর তৃতীয় ভিকটিম তো তরুণ আইন। ওর কথা আমার মনে আছে। ছবিসহ খবরটা ছাপা হয়েছিল। ইতিহাসের ছাত্র। কালাদেওর থানে গিয়েছিল। সেখানকার ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। ওইখান থেকে ফেরার পথে বিকেল নাগাদ পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী, দু’টো থেকে পাঁচটার মধ্যে কোন এক সময়ে হত্যাকাণ্ডটি ঘটে। ভিকটিমকে বেশ উজ্জ্বল চোখের ঝকঝকে ছাত্র বলেই মনে হয়েছিল। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা!”
শাক্য বলল, “এই তথ্য তুমি কোথায় পেলে?”
“আমি ওই নামের ফেসবুক পেজ সার্চ করেছিলাম। কাগজের ছবির সঙ্গে আর অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলাম, দুজন মানুষই এক। সেখানেই দেখলাম। চোখে ভালো মতো পাওয়ার আছে। এই সব মানুষ চশমা ছাড়া এক হাত দূরের জিনিসও দেখতে পায় না!”
“গুড অবজারভেশন। তুমি ছাড়া সম্ভব হত না। এখন বুঝতে পারছি, কেন কালাদেও একে টার্গেট করতে পেরেছিল এত সহজে?”
“কেন?”
শাক্য চোখে দুষ্টুমির হাসি হাসল, “ভাবো। ভাবো। খুব সহজ। ঠিক বুঝতে পারবে!”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content