শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

ছোট শহরটার চারদিকেই অজস্র টিলা আর শাল-সেগুনের জঙ্গল। শহরের প্রায় মাঝখানে থানার অবস্থান। কাছেই হেলথ্ সেন্টার। আরও পশ্চিমে গেলে চার্চ এবং তাঁদের হাসপাতাল, স্কুল, হোস্টেল ইত্যাদি। তারপরে অনেকখানি অংশ ফাঁকা, পাথুরে শক্ত জমি, ইতিউতি বাবলা আর খেজুরের গাছ আর নিতান্ত বুনো কিছু ঝোপঝাড়। রাস্তাটা পশ্চিম দিকে চলতে চলতে একটা টিলায় বাধা পেয়ে দক্ষিণে বেঁকে গিয়েছে। আবার দক্ষিণে কিছুদূর গিয়েই আবার পশ্চিমে মোড় ঘুরেছে। সেখান থেকেই আস্তে আস্তে আবার গাছপালার ভিড় চোখে পড়ে। কারণ, এই অঞ্চলে কতকালের পুরানো একখানা জলাশয় আছে, বন্য জন্তুরা সেখানে জল খেতে আসে।

গোটা জায়গাটাই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অধীনে। জলাশয়কে কেন্দ্র করে আবার গাছেদের ভিড় চোখে পড়ে। অর্জুন, পলাশ, শাল, সেগুন, মহুয়া, কেঁদ বা কেন্দু গাছ—কী নেই সে-জঙ্গলে? এই জঙ্গলের বুক চিরে চওড়া পিচ রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে যদি আরো খানিকটা এগিয়ে যাওয়া যায়, তাহলে মাঝপথে একখানা বড় টিলার উপরে একখানা পুরানো ঘর চোখে পড়বে। দু-তিন কামরার পাথরের তৈরি ঘর। কোনওকালে কেউ একজন বানিয়েছিল, আজ কেউ জানে না তার পরিচয়। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গিয়েছে বাড়িটির মালিকের নাম-ধাম-পরিচয়।
এই ঘরে কেউ কোনওদিন থেকেছে বলে কারও জানা নেই। এই একেবারে পাণ্ডববর্জিত জায়গায়, তখন জঙ্গল আরও ঘন ছিল, শহরের চিহ্নমাত্র ছিল না, সে-সময় এই জঙ্গলের মধ্যে একখানা ঘর বানানোর চিন্তা যার মাথায় আসে, সে আর যাই হোক সুস্থ কেউ নয় বলেই অনেকের বিশ্বাস। তার উপর যদি ঘর বানালোই তাহলে থাকলো না কেন, তার উত্তরও কেউ জানে না। কেউ ওই ঘরে থাকলে কোন না কোন সূত্রে লোকমুখে কোন না কোন গল্প ঠিক চালু থাকতো। কিন্তু ওই ঘরের মালিক সম্পর্কে কিছু শোনা বা জানা যায় না। সেই ঘর এখন অবশ্য ভেঙে পড়েছে। মাথার উপরের ছাদ আস্ত নেই। দরজা-জানালার পাল্লা সব উধাও। বাড়ির চারপাশ দিয়ে বুনো লতা, কাঁটাঝোপ গজিয়ে জায়গাটাকে প্রায় দুর্গম করে তুলেছে। বাড়ির সামনের অংশে একখানা মজা কুয়ো। এককালে খোলা মুখ থাকলেও এবং নীচে জল থাকলেও এখন তার মুখ শিলবন্ধ।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩১: দু’ দুটো লাশ?

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৪১: ‘নীল আকাশের নিচে’ ছবিতে হেমন্তের পছন্দ ছিল উত্তম, যদিও সেই প্রস্তাব সবিনয়ে নাকচ করেন মৃণাল

বছর দশেক আগে থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তার কারণও আছে। এই অঞ্চল এবং অন্যান্য অঞ্চলের বেশ কয়েকজন ওই কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। সবার পরিচয়ও জানা যায়নি। তবে প্রশাসন আর ঝুঁকি নেয়নি। তারা পাকাপাকি ভাবে লোহার ঢাকনা বসিয়ে ওটার মুখ সিল করে দিয়েছে। বাড়ি বা মোকাম থেকেই জঙ্গলটার নাম হয়ে গেছে পুরানা মোকামের জঙ্গল। এ-জঙ্গলকে সকলে এড়িয়ে চলে।
স্থানীয়দের বিশ্বাস এই জঙ্গলে রাত নামলেই এমন অনেক কিছু ঘটে, যা ঠিক স্বাভাবিক লোকের নয়। যেমন, হঠাৎ হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠা, পুরানা মোকামে সাদা ছায়ামূর্তি দেখতে পাওয়া, অজানা কোন কিছুর বীভৎস চিৎকার। এ-সমস্তই বন-সুরক্ষা পার্টির লোকজনের মুখে মুখে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে দীর্ঘকাল ধরে। ওরা মানুষদের ভয় দেখায়, কিন্তু জঙ্গলের বাকি জানোয়ারদের ওরা শত্রু মনে করে না। তারা ভয়ও পায় না। মাঝে মাঝে হাতির পাল ওই জঙ্গলে চলে আসে। পুরানো মোকামের আশেপাশে থানা গাড়ে, আবার চলেও যায়। কিন্তু তারা বেশ নিশ্চিন্তেই বাস করে।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৬: ‘কোনওদিন কিছুই ছিল না, কিছুই কিছুই নেই আমাদের আজ’

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১০: সাবিত্রীদেবীর দৃষ্টিতে টুকরো সময়

অদ্ভুত ব্যাপার সেই সময় ওই সব ঘটনা ঘটতে দেখা যায় না। যেন অতিপ্রাকৃত বা অপ্রাকৃতেরা ইচ্ছে করেই নিজেরা আত্মগোপন করে থাকে, যাতে তারা ভয় না পায়। আবার তারা চলে গেলেই পূর্ণোদ্যমে শুরু হয়ে যায় তাদের কীর্তন। এর উপর রয়েছে অন্য ভয়। পুরানা মোকামের কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে যারা আত্মহত্যা করেছিল, তারা না কি জঙ্গলের পথে পথে আজও ঘুরে বেড়ায় এবং কেউ যদি ভুল করে সন্ধ্যার পর ওই জঙ্গলে উপস্থিত হয় কিংবা পথ হারিয়ে এদিক-ওদিক বেরোনোর উপায় বার করতে থাকে, তাহলে ওই অতৃপ্ত আত্মারা তাকে পথ ভুলিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মেরে ফেলে। এই ভয়ে সন্ধ্যের পর কেবল নয়, দিনমানেও কেউ যায় না ওদিকে।

রামদাস সারা রাস্তা “রাম, রাম”, কখনও “জয় বাবা কালাদেও” বলতে বলতে এসেছে। তার মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গিয়েছে। বড়বাবু অর্থাৎ অভিষেক মালাকারের মুখও বেজায় গম্ভীর। এই জঙ্গলে আসতে হবে শুনে তাঁর স্ত্রী না কী পূজার প্রসাদী ধান-দুর্বা-বেলপাতা একফালি কাপড়ে মুড়ে তাঁর কোমরে বেঁধে দিয়েছেন। ওটি থাকলে আর কোন পেত্নী তাঁর মাথায় ভর করবে না কিংবা পথ ভুলিয়ে মারবে না। সুদীপ্তকে বার বার করে বলে দিয়েছেন ফোন করে, সে যেন বড় সায়েবের সঙ্গ না ছাড়ে।

এখনও মাঝেমাঝে স্বামীকে ফোন করে খোঁজ নিচ্ছেন, আদৌ বেঁচে আছেন, না কী গচ্ছন্তি! সুদীপ্ত বেশ উপভোগ করছিল ব্যাপারটা। এঁরা জেনে বুঝেই পুলিশ ফোর্সে জয়েন করেন, এদিকে অপরাধী, পলিটিক্যাল নেতা থেকে শুরু করে ভূত-প্রেত-পিশাচ ইত্যাদির ভয়ে কাঁপেন। এঁদের আসলে এই চাকরি না করে শহরের চারমাথার এক কোণে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান দেওয়া উচিত ছিল। কিংবা চায়ের দোকান। চারপাশে সবসময় লোকজন গিজগিজ করতো। ফলে ভূত-প্রেত-পিশাচ কিংবা পেত্নী আর কূল পেত না কাছে ঘেঁষার।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৭: তোমায় পড়েছে মনে আবারও…

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

অভিষেক গজরাচ্ছিলেন, এই থানায় আর তিনি থাকবেন না, আজ ফিরে গিয়েই ওপরমহলে চিঠি লিখবেন, উত্তর না-আসা পর্যন্ত মেডিক্যাল লিভ নেবেন, আরো কত কী ! সুদীপ্ত জানে, এই অবস্থায় তার চুপ করে থাকা উচিত, সেই কারণেই সে চুপ করে আছে।

কিছুক্ষণ পরে অভিষেক খেঁকিয়ে উঠে রামদাসকে শুনিয়ে আসলে তাকেই বললেন, “কী হে? আর কত দূর? এবার তো মনে হচ্ছে এই জঙ্গল পার হয়ে একেবারে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে পৌঁছে যাবো!”

রামদাস মাথা চুলকালো, “আজ্ঞে ছ্যার, ঠিক কোনখানে বাইক দেখেচে, সেটা তো পুছ করিনি!”
“তা করবে কেন? শালা গাড়ল একটা, মাথামোটা কোথাকার! কাদের নিয়ে আমায় কাজ করতে হয় এসে দেখুক ওপরওয়ালারা! তাঁরা তো ঠান্ডা ঘরে বসে অর্ডার করেই খালাস!”

সুদীপ্ত বলল, “আমার তো মনে হয়, সবে জঙ্গল শুরু হল। আর যেই খবর দিক না কেন, সে নিশ্চয়ই এই জঙ্গলে বেশি ভিতরে ঢোকেনি!”

“সেটা তুমি কেমন করে বলছ হে?” অভিষেক ভ্রূ কুঁচকান।

সুদীপ্ত মৃদু স্বরে জবাব দিল, “যে কারণে আমি-আপনি-আমরা সকলেই এই জঙ্গল এড়িয়ে চলি, সেই কারণেই লোকটি যেই হোক, সে যদি স্থানীয় মানুষ হয়, তার পক্ষে এই জঙ্গলের আরও গভীরে ঢোকা সম্ভব নয়। আর লোকটি দেখে থাকলেও একাই দেখেছে। সেই কারণে একাই এসেছিল থানায়। অনেকে মিলে যদি দেখত, তাহলে আরো কয়েকজনের আসা স্বাভাবিক ছিল!”

অভিষেক মনে মনে চমৎকৃত হলেন। এই ছেলেটির এলেম আছে। যুক্তিতে বেশ দড়। মুখে স্বীকার করলেন না, পায়াভারি হয়ে যাবে তার ফলে। তাঁকে আবার মানতে চাইবে না। মুখে কেবল বললেন, “হু! এটা আমারও মনে হচ্ছিল! তোমায় জিজ্ঞাসা করে শিওর হলাম আর কী!”

সুদীপ্ত মনে মনে হাসল। মুখে বলল, “আমি জানি স্যার। আপনার মেধা, এতদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এই সাধারণ ব্যাপারটা যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে আমরা তো কোণকালেই কিছু পারব না। আপনার মতো মেধা আমার অন্তত নেই স্যার!”
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৫: ‘আপনজন’ Chronicles

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

অভিশেক খুশি হলেন। ছোকরার বুদ্ধি আছে, তাঁকে শ্রদ্ধা-ভক্তিও করে। যতদিন তাঁর ব্যাপারে মনের মধ্যে এই ভুল নিয়ে থাকে, ততদিনই মঙ্গল। মুখে গদগদ হাসি ফুটিয়ে বললেন, “আরে সে আর এমন কী! তুমিও একটু মাথা খাটাতে চেষ্টা করো, তুমিও একদিন আমার মতো না হোক, কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে।”
“আজ্ঞে স্যার, আপনার আশীর্বাদ থাকলেই পারবো।”

গাড়িটা এগোচ্ছিল। এমন সময় সুদীপ্ত বলল, “একটাই খটকা স্যার!”

“কী? কিসের খটকা?”

“লোকটা থানায় এল কেন? আর এল যদি তো পালিয়েই বা গেল কেন? সে কী কেবল এই খবরটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতেই এসেছিল না কী সত্যি কথাটা জানাতে এসেছিল? বাইকটা যে আমরা খুঁজছি, এটা তো তার জানার কথা নয় ! কে বলল তাকে ? আর কে-ই বা তাকে থানায় পাঠালো?”

“বাবা! এ যে একটা খটকা নয়, খটকার এভারেস্ট!”

সুদীপ্ত বলল, “সাধারণ কেউ হলে সে আগে নিজের গ্রামে কিংবা এলাকায় ফিরে যেত, সেখানে পরিচিতদের বলত, সেখান থেকে থানায় খবর আসত। কিন্তু এ যে একেবারে থানায় উপস্থিত হল। রামদাসকে জিজ্ঞাসা করে যা জেনেছি, লোকটি সাধারণ চাষাভুষো কিংবা খেটে খাওয়া মানুষের পোশাক পরে ছিল। এই রকম শ্রেণির মানুষ থানাপুলিশকে এড়িয়েই চলতে চায়, আর একা তো থানার চৌহদ্দির ভিতর আসতেই চায় না। তাহলে? এ এল কেন? কেউ কী তাকে আসতে বলেছিল? এখন বুঝতে পারছি না, শুভানুধ্যায়ী না কী শয়তান! দেখা যাক। খবরটা সত্যি কি না। আগে বাইকটা পাওয়া জরুরি!”

ঠিক এই সময় রামদাস চেঁচিয়ে উঠল, “হুই দেখুন ছ্যারেরা, জঙ্গল ঘেঁষে রাস্তার ধারে একখানা বাইক উল্টে পড়ে আছে!”

“কই, কই, কোথায়?” বলে থানার বড় এবং ছোট দুই বাবুই ঝুঁকে পড়ে পুলিশি জিপ থেকে। —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content