মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

রিসর্ট থেকে ফিরে অভিষেক নিজের কোয়ার্টারে চলে গিয়েছিলেন। সুদীপ্ত সব কাজ মিটিয়ে নিজের কোয়ার্টার থেকে কেবল স্নান আর একটা কেক খেয়ে আবার ডিউটিতে চলে এসেছে। সে অকৃতদার এখনও। বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে মেয়ে দেখা চলছে। এই টুকুই। আপাতত তার কাজকর্মের জন্য স্থানীয় একজন মহিলা নিযুক্ত আছেন। তিনি সকালে এসে রান্নাবান্না, ঘর পরিষ্কার, কাপড় কাচা ইত্যাদি করে দুপুরে চলে যান। রাতের খাবার সে আনিয়ে নেয়। কখনও সকালের খাবার ভালো থাকলে, তা দিয়েই চলে যায়।

সে এখন থানাতেই ছিল। বসে বসে তার নিজস্ব নোটবুকে কালকের ঘটনাগুলি সাজাচ্ছিল। এই সব কেস আসলে তাকেই তদন্ত করতে হয়, মাথা ঘামাতে হয়। অফিসার ইন চার্জ হিসেবে অভিষেক রাজনৈতিক নেতাদের কেস দেখেন। শাসক দলের কথা মতো কাজ করাতেই তাঁর আনন্দ বেশি। তদ্বির তদারক করছেন, যাতে কলকাতায় খোদ লালবাজারে ঢুকে পড়তে পারেন। কোন কেসেই মাথা ঘামান না, তবে কেস সলভ হলে সাংবাদিক সম্মেলন করে নিজের মুখে নিজের মগজাস্ত্রের শতগুণ প্রশংসা করতে ছাড়েন না। সুদীপ্তদের মতো প্রকৃত মগজাস্ত্রের অধিকারীদের নাম সেখানে সঙ্গত কারণেই অনুচ্চারিত থাকে।

এই নিয়ে যে সুদীপ্ত খুব মনঃকষ্টে আছে, তা নয়। ব্রেন খাটাতেই তার আনন্দ। ছোটবেলায় কোনান ডয়েল, আগাথা ক্রিস্টি, ব্যোমকেশ, ফেলুদা, কিরীটী পড়ে, তার মনে এই লাইনে আসার ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছিল। এক-একটা কেস সে সলভ করবে, আর চারদিকে সকলের মুখে বিস্ময় ও শ্রদ্ধা জাগিয়ে তুলবে, এই ছিল তার গোপন চাওয়া। এখনও সেই জায়গায় সে পৌঁছয়নি সত্যি কথা, কিন্তু তার নিজের প্রতি বিশ্বাস আছে যে, একদিন ঠিক পারবে। আজকের এই কেসটা বেশ কিছুকাল ধরে ঘটে যাওয়া কেসগুলির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সে নিজে মালদার ছেলে, উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় এসেছিল।
তবে সে জানে, কুসংস্কার কেবল মফস্বলেই থাকে না, কলকাতার মানুষদের মধ্যেও থাকে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার প্রাবল্য মফস্বলের চেয়েও বেশি। কিন্তু সে নিজে এই সব ভূত-প্রেত ইত্যাদিতে বিশ্বাস করে না। কালাদেও-রহস্য নিয়ে সে ভালোভাবে “ছান্‌বিন” করতে চেয়েছিল, কিন্তু বড়বাবু রাজি হননি। তাঁকে না কি এলাকার বিধায়ক বলেছেন, “স্থানীয়দের বিশ্বাসে আঘাত লাগলে তারা ক্ষেপে উঠিবে। মুখ্যমন্ত্রী রেগে গেলে কিন্তু আপনার নিজেরই কেরিয়ারে ফুলস্টপ পড়ে যাবে।

সুতরাং এই নিয়ে বাড়াবাড়ি কিছুতেই নয়!” কেসগুলি সেজন্য ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আর ভালো করে তদন্ত করতে পারে না সে। কিন্তু তার মন বলছে, কিছু একটা ফাউল প্লে তো আছেই। নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে জানে, তার হাত-পা বাঁধা। গতানুগতিকভাবে কিছু তদন্ত হবে, তারপরে দিনের পর দিন নানা ফাইলের স্তুপে এই কেসেরও হয়তো স্থান হবে। নতুন কেস আসবে, মিডিয়া বাজার গরম করবে কিছুদিন, তারপরে আবার শান্ত পুষ্করিণী, স্তব্ধ দুপুর!

আক্ষেপে নিজের মাথার চুল মুঠি করে ধরল দু’ হাতে। কালকের কেসটা ভাবাচ্ছে তাকে খুব। নিহত ব্যক্তির মাথাটা কোথায় গেল। কালাদেও কেন শুধু মাথাই চিবিয়ে খাচ্ছে। সে কি মুড়িঘন্ট খেতে পছন্দ করে না কি? এই নিহত লোকটির পরিচয় জানাটা আবশ্যক। কে বলতে পারে, হয়তো সেই পরিচয়ের মাঝখানেই কোন ক্লু জানতে পারা যাবে। তারপর কাল রিসর্টে গিয়ে অর্ক নামের একজন ফ্রিল্যান্স করে এমন সাংবাদিকের কথা শুনে এসেওছে সে। লোকটি কিংবা ছেলেটি দুপুরে বেরিয়েছিল, বন্ধুর বড়লোক বয়ফ্রেন্ডলের লেটেস্ট মডেলের দামি বাইক নিয়ে। তারপর সে আর ফিরে আসেনি। কোন ফোনও করেনি। অর্ক নামের ছেলেটির বন্ধুর কাছ থকে ফোন নম্বর নিয়ে সুদীপ্ত নিজেই ফোন করেছিল কয়েকবার, ফোন স্যুইচড অফ বলছে। তাতেই আরও ভয় বাড়ছে সুদীপ্তের। যদি শেষ অবধি দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিই অর্ক, তাহলে? কিন্তু একটা প্রশ্ন তার মনের মধ্যে খচখচ করছে। তাহলে সেই বাইকটা কোথায় গেল? না কি, এই মৃত্যুটা ওই বাইকের জন্য? লেটেস্ট মডেলের দামি বাইক দেখে কারুর মনে লোভ জাগতে পারে, সেই হয়তো…! কিন্তু নিজের কাছেই বিষয়টা বিশ্বাসযগ্য হল না।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৯: পাভেলের পর্যবেক্ষণ

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

রাস্তায় কাউকে দামি বাইক চাপতে দেখে কারও কারও লোভ হওয়া স্বাভাবিক, কিন্তু সেটা হাতাতে গেলে তাকে অনেক পরিকল্পনা করতে হবে। তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু হবে না। সে ক্ষেত্রে যদি এমনটাই হয়, তাহলে ধরে নিতে হয়, বাইকটা হাতানোর পরিকল্পনা গত পরশু থেকেই নেওয়া হয়েছে। কারণ, গ্রুপটি গত পরশু পিশাচ পাহাড় রিসর্টে এসেছে। কিন্তু কাল দুপুর অবধি তো বাইকটা তার মালিক অঞ্জনের কাছেই ছিল। অর্কের হঠাৎ করে ওই বাইকে যাওয়াটা ঠিক হয়। তাহলে ধরে নিতে হয়, অর্ক নয়, অঞ্জনই ছিল টার্গেট। সামান্য অদলবদলের কারণে অর্ক বিপদে পড়েছে। কিন্তু এই যুক্তিটা তখনই গ্রাহ্য হবে, যখন জানা যাবে, নিহত অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিই অর্ক। তার আগে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া আর কোন পথ নেই।

সুদীপ্ত বেল বাজাল। কনেষ্টেবল রামদাস এসে বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনার মতো মুখ করে দাঁড়ালো।

“ছ্যার ?”

“এক কাপ চা আগে নিয়ে এস। পরে দুটো টোস্ট আর একটা এগ পোচ আর আরেক রাউন্ড চা দিয়ে যায় যেন। একটু ব্যবস্থা করো।”

“আজ্ঞা ছ্যার। চা কি শুধু আপনার জন্যই বলবো ? না কি মুই-ও লিয়ে লিব?”
সুদীপ্ত মৃদু হাসল মনে মনে। বিভিন্ন জনের কাছে থেকে সাধারণ কাজ করেও টাকা নিতে নিতে এদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে যে ঘুষ বা উপরি না পেলে এরা কেউ কোনও কাজ করতে পারে না। সেকেণ্ড অফিসার হোক বা আর কেউ, এদের চাহিদার হাত থেকে রেহাই নেই কারওই। অবশ্য রোগটা কেবল রামদাসের একার নয়, গোটা সিস্টেমটার মধ্যেই চারিয়ে গেছে এবং আগে যতটা চক্ষুলজ্জা ছিল, এখন আর তা-ও নেই। রসেবশে থাকতে কে না চায়?

সুদীপ্ত বলল, “তোমার জন্যও চা-বিস্কুট নিয়ে আসতে বলো!”

“আজ্ঞে আমি নিজে নিয়ে আসচি ছ্যার!” বলে রামদাস দ্রুত ছুটল যেন সে চা-বিস্কুট জীবনে আজ প্রথম খাবে।
আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন: বিদেশ ভ্রমণে বিভ্রাট

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

রামদাস চলে যেতে সে আবার ফাইল টেনে নিয়েছিল, এমনসময় রামদাস হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এল। সুদীপ্ত ভ্রূ কুঞ্চন করে তাকালো, “কী ব্যাপার রামদাস? গেলে না?”

“ছ্যার! ঘরের বাইরে একঠো লোক এসেচে, বলছে কী, উ নাকি পুরানা মোকামের জঙ্গলে একখানা বাইক দেকেচে ! স্যার, ই বাইকটো সেই কালকের কেসের বাইক লয় তো?”

বাইকের কথা শুনেই সুদীপ্ত শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে বসেছিল, রামদাসের কথা শেষ হতে না হতেই বলল, “কে, কোথায় সে?”

“আজ্ঞে ছ্যার, আমি আপনার লগ্যে চা-বিস্কুট আনতে যাচ্চিলাম, দেকলাম কী থানার মধ্যে ঢুকবে কী ঢুকবে না করচে। ইকবার ইদিকে আসে, ইকবার উদিকে যায়, তো আমি তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে পুছ করলাম, তারপর বললাম, ঠাহ্‌রো খানিক, আমি ছ্যারকে পুছ করিয়ে আসি। তো…”

সুদীপ্ত অধৈর্য হয়ে বলল, “তোমার গল্প পরে শুনবো রামদাস। তুমি এক্ষুনি লোকটিকে ভিতরে নিয়ে এসো। লোকটি নিশ্চয়ই কিছু দেখেছে। তা না হলে, সে একটা বাইক দেখেই থানায় আসার সাহস পেতো না। সাধারণ লোক থানাকে এড়িয়ে চলে। যাও, ক্যুইক !”

রামদাস বাইরে চলে গিয়েও ফিরে এল মিনিট কয়েক পরে। তারপর কাঁচুমাচু মুখে বলল, “ছ্যার, লোকটা চলে গেচে ছ্যার!”

“হোয়াট?” বিস্ময়ে ফেটে পড়ে সুদীপ্ত, “চলে গিয়েছে মানেটা কী? তুমি বললে, তুমি তাকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছ বলেছিলে?”

“তাই তো করেছিলাম ছ্যার! কিন্তু কী করে আমি বুঝবো যে সে ভয় পেয়ে চলে যাবে!”

“ভয় পেয়ে মানে ?”

“ছ্যার। লোকটা ভয়ে কাঁপছিল যেন। আমাকে কোনমতে বলল কী, পুরানা মোকামের জঙ্গলে উয়ো পেট সাফা করতে গিঞছিল, সেখানে একটা দামি বাইক পড়ে থাকতে দেখেছে। তাতে বহুত খুন লাগা হুয়া হ্যায় ছ্যার!”

সুদীপ্ত উঠে দাঁড়ায় উত্তেজনায়, “তোমাকে এত কথা সে বলেছে?”

“আজ্ঞে ছ্যার।”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৪: আমার মন বলে চাই চাই

“এখুনি বড়বাবুকে খবর দাও। আমাদের পুরানা মোকামের জঙ্গলে যেতে হবে। এক্ষুনি। আমার মন বলছে, এই লোকটিকে কেউ পাঠিয়েছিল কেবল খবরটা এই ভাবে দিতে। থানার মধ্যে সে ঢুকত না, তোমাদের মতো কারুর অপেক্ষা করছিল, যাতে খবরটা কায়দা করে দিয়ে যেতে পারে। আমাদের মধ্যে কেউ বাইরে না চলে আসে, এই ভয়েই সে আতঙ্কে ছিল। আমার মনে হয়, এই লোকটার মারফৎ খবর পাঠিয়ে তোমাদের কালাদেও আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল। হাউ ডেয়ার হি ইজ! চলো, বড়বাবুকে কোয়ার্টারে গিয়ে খবর দাও। আর দেরি করলে সমস্যা বাড়তে পারে!”

রামদাস বলল, “কালাদেও নিয়ে উল্টাপাল্টা কিচু বলবেন না। তিনি দেবতা আচেন বটে!”

সুদীপ্ত বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার কথা? যা বললাম করো গিয়ে আগে!”

রামদাস চলে যায় দ্রুত। সুদীপ্তের মুখ-চোখের চেহারা, উত্তেজনা দেখে সে বেশ ঘাবড়ে গিয়েছে। যদিও সে জানে, পারলে এই থানার মধ্যে সুদীপ্তই পারবে রহস্যভেদ করতে। বড়বাবুটা যা একখানা জিনিস, কেস শুরুতেই ফিনিশ হয়ে যায়! —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content