শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

কফি আসার পর শাক্য সশব্দে একটা লম্বা চুমুক দিল। তারপর মুখ দিয়ে “আঃ’ করে একটা আওয়াজ করল।

পাভেল নিঃশব্দে চুমুক দিচ্ছিল তার কফির কাপে। সে বিরক্তির সঙ্গে বলল, “তোমার এই শব্দ করে কফি খাওয়ার অভ্যাসটা কবে যাবে শাক্য?”

শাক্য হাসল। সে জানে, শব্দ করে চা-কফি খাওয়া পাভেল মোটেও পছন্দ করে না। ইচ্ছে করেই সে পাভেলের সামনে ওভাবে খায়, যাতে পাভেল চটে ওঠে আর চটে উঠলেই সে আন-পার্লামেন্টারি শব্দবন্ধে শাক্যকে সম্ভাষণ করে। দু’জনের বয়স কাছাকাছি, আর দু’জনেই দু’জনের প্রবল সমালোচক, কিন্তু দু’জনেরই দু’জনকে না হলে চলে না। এ এক লাভ অ্যান্ড হেট রিলেশনশিপ। সামনেই পাভেলের বিয়ে। তার গার্লফ্রেণ্ড মডেলিং করে। পাভেলের বাবা-মা-ও উচ্চপ্রতিষ্ঠিত। ছেলেটি একটু গোঁয়ার, কিন্তু মনের দিক থেকে বেশ ভালো। আর শাক্যের বিপদে যদি সবার আগে কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে, তা সে পাভেল।

শাক্য আর একবার সশব্দে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “যদি শব্দ করে চা-কফিই না খেলাম, তাহলে বাঙালি হয়ে জন্মালাম কেন?”

পাভেল ব-দিয়ে একখানা চার অক্ষরের খিস্তি মেরে বলল, “তুমি শালা বাঙালি নও, আনকালচার্ড অসভ্য আদিম কোনও পাবলিক। খামোকা বাঙালির বদনাম করো না!”

শাক্য গা-জ্বালানে হাসি হেসে বলল, “পাভেলবাবু চটিতং। তা হ্যাঁ হে, আজ কি তোমার ডেটে যাওয়ার কথা ছিল? মুড অফ মনে হচ্ছে!”

“না শালা, ফাক্‌ করার কথা ছিল। বা… কাঁহিকা!”

“আচ্ছা, আচ্ছা। আর রাগ করতে হবে না। বাকি কফিটা আমি নিঃশব্দেই ভদ্র বংশজাত কোনও সন্তানের মতোই খাবো। এ বার কাজের কথায় এসো। কী বুঝছ?”

মুহূর্তে পাভেলের গলার স্বর এবং বডি-ল্যাংগুয়েজ পাল্টে গেল। সে এখন সিরিয়াস। সেই ভঙ্গিতেই বলল, “কিছু বুঝতে পেরেছি তা দাবি করছি না। কিন্তু ব্যাপারটা খুব জটিল বলে মনে হচ্ছে!”
শাক্য গম্ভীর ভাবে বলল, “জটিল তো বটেই! কেস কালাদেও এতটা সহজ কোনও মিস্ট্রি নয় যে, রাতারাতি তার সমাধান করে ফেলা যাবে। একেজি এটা জানেন, ফিল করেছেন, কারণ, এই ফাইলগুলি আমাদের দেওয়ার আগে তিনই নিশ্চয়ই নিজে তন্ন তন্ন করে পড়েছেন এবং সহজ কেস হলে ডিপার্টমেন্টের যে-কাউকেই এটার দায়িত্ব দিতেন, আমাদের দুজনকে ডাকতেন না।”

“আই এগ্রি!”

“এখন তুমি ফাইল নম্বর-টু পড়ে কী বুঝেছ বল। অনেক কিছু নোটডাউন করছিলে দেখতে পাচ্ছিলাম!”

“তুমি কী নিজের হাতের ফাইল না পড়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে? ওয়াচ করছিলে আমি কাজ করছি না ফাঁকি দিচ্ছি!”

“আজ্ঞে না, তোমার চাঁদবদন দেখছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম, বনমালি তুমি আর জনমে হয়ো রাধা!”

“শালা!”

“তুমি তোমার পর্যবেক্ষণ বল। আমি তারপর আমার পর্যবেক্ষণ বলব।”

“দেখ, আমার ফাইলে সাম্প্রতিক ঘটোনার খুঁটিনাটি মোটের উপর যা জোগাড় করা গেছে আছে। তার থেকে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, কালাদেও বলে যদি কেউ বা কিছু থেকেই থাকে, তাহলে তার মেজাজ এতদিন শান্তই ছিল। হঠাৎ করে ক্ষেপে উঠেছেন তিনি, কিন্তু কেন?”

“হুঁ। নম্বর দুই?”
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৮: ভোররাতের ডাক

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

“আজ পর্যন্ত যারা যারা কালাদেওর শিকার কিংবা স্থানীয় সংবাদপত্রের ভাষায়, বলি, তাদের সামাজিক স্ট্যাটাস কিন্তু এক নয়। কেউ কুলি-মজুর, কেউ ব্যবসায়ী, কেউ সমাজকর্মী, কেউ আবার পর্যটক। এদের কালাদেও নির্বাচন করলেন কেন? এরা কি কোনভাবে তাঁর থানকে অপবিত্র করেছিল? না কি তাঁর আদেশ অগ্রাহ্য করেছিল? তাছাড়া কালাদেওর আক্রমণের স্থান ও পদ্ধতিও একটু অদ্ভুত!”

“কেন?”

“কারণ, কালাদেও তার নিজের গুহার আশেপাশে আক্রমণ করলে মানা যেত। কিন্তু তা না করে সে যত্রতত্র হানা দিচ্ছে, এটা কি স্বাভাবিক? অথচ কালাদেওকে কেউ দেখেছে বলে জানা যাচ্ছে না, কালাদেওর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও সে গুহার ভিতর থেকে তাহলে বাইরে বেরোয় না। বছরে এক-আধ দিন পূজার ভাগ নিতে সে হয়তো বেরোয়, তবে যেহেতু তখন কারুর উপস্থিতি সেখানে বরদাস্ত করা হয় না, ফলে তাকে দেখতে পাওয়া সম্ভব নয় কারও পক্ষেই। সে লাজুক প্রকৃতিরও হতে পারে, কিংবা মানুষের থেকে দূরে থাকতেই পছন্দ করে। অথচ সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া ঘটনায় কেন সে এতটা রিস্ক নিচ্ছে, যেখানে তাকে যে কেউ দেখে ফেলতে পারে, প্রতি-আক্রমণ করতে পারে? আমার খটোকা লাগছে সে কারণেই!”

“গুড পয়েন্ট! আর কিছু?”
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৩: ধরবো ধরবো করছি কিন্তু…

“শাক্য, আমাদের প্রতিটি ভিকটিমের ডিটেলস জোগাড় করতেই হবে। আমার মনে হচ্ছে ওটা জরুরি।”

“আমারও তেমনটাই মনে হয়। আমার মনে হয়, ডিটেলস জোগাড় করলেই কোনও না কোনও লিঙ্ক নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে! বাই দ্য ওয়ে, তুমি কালাদেওর অলৌকিক অস্তিত্বে বিশ্বাস করো?”

“রাবিশ! আমি ভূত-ভগবান কিছু মানি না তা জানো তুমি! কেন, তুমি করছ না কি?”

“নাহ্‌! এখনও অলৌকিক বলতে পারি, এমন কিছুই তো দেখছি না ফাইলে। যদিও আরও কিছু ম্যাটার এখনও পড়া বাকি!”

“আমারও। ফলে শেষ পর্যবেক্ষণ বলে আমার কথাগুলিকে ধরো না। আগামীতে পর্যবেক্ষণ বদলাতে পারে।”

শাক্য একটু মৃদু স্বরে বলল, “ভবানীপ্রসাদ রায় নামে একজন স্থানীয় কাগজে দু’ সংখ্যা জুড়ে একটা প্রতিবেদন লিখেছেন। সেটাই পড়ছিলাম। তাতে একটা ইন্টারেস্টিং কেসের কথা আছে। তুমি আমি দুজনেই তখন এই সার্ভিসে জয়েন করিনি। তবে মনে আছে আমার। তোমার আছে কি না জানি না। দ্য ফেমাস জার্ণালিস্ট মোহন গুপ্তা’স আনন্যাচারাল ডেথ কেস। এখনও সম্ভবত কেসটা আনসলভড্‌ হয়ে পড়ে আছে।”

“তামাদি হয়ে গেছে দেখো !”

“কেসটা রি-ওপেন করলেই আর তামাদি থাকবে না!”

পাভেল শাক্যর দিকে তাকালো। তার চোখ চকচক করছে। তার মানে শাক্য কিছু একটা পেয়েছে। অন্ধকারে আলোর দিশা? পাভেল জিজ্ঞাসা করল, “সে তুমি করলে। কিন্তু মোহন গুপ্তার মৃত্যর সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক? সে তো মনে হয় অনেকদিন আগেই ঘোটে গিয়েছে!”

“দু হাজার আট সালে। কিন্তু স্যুইটহার্ট, তাঁর মৃত্যুও কালাদেওর হাতে ঘটেছিল যে!”

“হোয়াট?” উত্তেজনায় পাভেল উঠে বসে চেয়ারে।
আরও পড়ুন:

প্রথম আলো, পর্ব-২: পৃথিবীর কোথায় প্রথম হাসপাতাল গড়ে উঠেছিল?

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

“ইয়েস স্যুইটহার্ট! আর সেটাই সাম্প্রতিক কালে কালাদেওর প্রথম আবির্ভাব। অন্তত এই শতাব্দীতে। তুমি জানো, সেই সময় কী রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল ওখানে? কালাদেওর নাম নিয়ে তারা কেউ মোহন গুপ্তাকে মার্ডার করতেই পারে, অস্বাভাবিক কিছু না। যেহেতু মোহন গুপ্তা ওই অঞ্চলে বিশেষ স্কুপ নিউজ করতেই গিয়েছিলেন। তবে সেই কেসেও অনেক প্রশ্ন, অনেক খটকা! এতদিন পরে তার ফাইল, সাক্ষ্যপ্রমাণ সঠিক ভাবে পাওয়া সম্ভব কি না জানি না !”

“তাহলে ?”

“আমাদের যত দ্রুত সম্ভব যেতে হবে পাভেল। যত তাড়াতাড়ি। তবে যদি দেখা যায়, এর মধ্যে আর কোন ইনসিডেন্ট ঘটেনি, তাহলে আলাদা কথা!”

“বেশ! আমারো মন তেমনটাই ভাবছিল!”

শাক্য আপন মনে বলল, “কিন্তু আমার মন বলছে, ভয়াবহ কিছু ঘটবে। আরো অনেক কিছু। হয়তো দেখা যাবে, অনেকগুলি কেস এক ফ্রেমে বন্দি হয়ে জটিল থেকে জটিলতর আকারে আমাদের সামনে উপস্থিত হচ্ছে বলেই আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি!” তারপর সে পাভেলের দিকে তাকিয়ে বলল, “যখন অনেকগুলি লাল-নীল সুতো একসঙ্গে জট পাকিয়ে যায়, তখন তুমি কী করবে পাভেল?”

পাভেল বলল, “আস্তে আস্তে এক-একটা করে ছাড়ানোর চেষ্টা করব। তা না হলে, একবার এটা একবার ওটা ধরে টানাটানি করলে আরোও জট পাকিয়ে যাবে।”

শাক্য বলল, “এক্সজাক্টলি সো। এই কেসেও আমার মনে হচ্ছে, অনেকগুলি কেসের সুতো একসঙ্গে জট পাকানো অবস্থায় রয়েছে। আমাদের আস্তে আস্তে একটা একটা করে কেসের সুতো ছাড়াতে হবে। নাহলে আরো জট পাকিয়ে যাবে। সত্যের দিশা খুঁজে পাবো না আমরা। সেই জন্যই আমাদের অকুস্থলে যেতেই হবে পাভেল। অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল!” —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content