বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

আগের পর্বের অনুক্রমে দ্বিতীয় কিস্তির প্রতিবেদনটা পড়ছিল শাক্য। পাভেল এখনও তার হাতে ধরা ফাইলে মুখ ডুবিয়ে পড়ে আছে আর মাঝেমধ্যে তার লাল-নীল পেনটা দিয়ে কিছু নোট করছে তার নোটবুকে। শাক্য জানে, ওই নোটবুকে জড়ো হচ্ছে পাভেলের প্রশ্ন এবং অস্বস্তির জায়গাগুলো। একের পর এক প্রশ্নগুলি করবে সে শাক্যকে, কখনও শাক্যের উত্তর আশা করবে, কখনও নিজেই উত্তর দেবে। অন্যদিকে শাক্য তার নোটপ্যাডে কিছু সাংকেতিক ভাষায় যে পর্যবেক্ষণগুলি লিখে রাখবে, সেগুলির উত্তরও তারা দু’জন ভাববে, ভাবাবে। মনের মতো উত্তর না পেলে নাওয়া-খাওয়া ভুলেও জিগজ্যাগ পাজলের ধাঁধার পিছনে ছুটে বেড়াবে, যতক্ষণ না একটা যুক্তিগ্রাহ্য উত্তরে গিয়ে পৌঁছয়।

ঘড়ির কাঁটা দেখল শাক্য। বেশিক্ষণ হয়নি। আশা করি ফাইলগুলি পড়ে ফেলতে পারবে আজকের মধ্যেই। সে আর সময় নষ্ট না করে আবার ফাইলে ডুবে যায়। প্রতিবেদন নম্বর দুই-তে কী আছে দেখা যাক—এই ভেবে।
 

কালাদেওর ইতিহাস-দ্বিতীয় পর্ব

“আগের সংখ্যায় আমরা কালাদেওর ইতিহাসের গোড়ার কথা জেনেছি। এই সংখ্যায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানবো। কালাদেও সম্পর্কে শেষ ঘটনার কথা জানা যায়, ২০০৯ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে। সে-সময় এই এলাকায় একটি গুপ্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শাসক দলের সংঘর্ষ চলছিল। এই খবর সংগ্রহ করার জন্য দিল্লির একটি নামি সংবাদপত্রের জনৈক সাংবাদিক মোহন গুপ্তা এখানে আসেন। মোহন গুপ্তা খুব ডাকাবুকো সাংবাদিক। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় সেখানে গিয়ে রীতিমতো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। সাহসিকতার জন্য বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও তিনি পেয়েছিলেন। তখন এই অঞ্চল ছিল উপদ্রুত এলাকা হিসেবে ঘোষিত। সুরক্ষার জন্য গড়ে ওঠা একটি পুলিশ ক্যাম্পে বিশেষ রাজনৈতিক দলটি হামলা চালিয়ে বেশ কিছু পুলিশকে গেরিলা কায়দায় অতর্কিতে ঘিরে ফেলে হত্যা করলে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে এবং কেন্দ্রীয় সরকার মিলিটারি ক্যাম্প বসান। খানাতল্লাশি শুরু হয়। এই সমস্তই আপনারা ভুলে যাননি আশা করি।

এই সময়েই মোহন গুপ্তা এখানে আসেন এবং সরেজমিনে তদন্ত করে এলাকায় উক্ত রাজনৈতিক দলটির বাড়বাড়ন্তের পিছনে কোনও আর্থ-সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক কারণ আছে কি না সে ব্যাপারে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শুরু করেন। তাঁর এ-জন্য বিশেষ পারমিট ছিল এবং মিলিটারি ক্যাম্প এবং জঙ্গলের গভীরে কোনও সুরক্ষা ছাড়া যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ব্যতীত আর সব ব্যাপারে প্রশাসনের তরফ থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। এই সূত্রেই তিনি সম্ভবত পিশাচ পাহাড়ের কাছে পৌঁছন। একটা কথা না বললেই নয়, বিশেষ রাজনৈতিক দলটির কার্যকলাপ ওই সময় এলাকার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পিশাচ পাহাড়ে তাঁদের কোন সক্রিয়তা ছিল না। হয়তো, আদিবাসী মানুষদের ভাবাবেগে ঘা দিলে তাঁদের শক্তি ও সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়বে ভেবেই তাঁরা এই স্থানটি এড়িয়ে চলতেন। সেই সময়েই একদিন স্থানীয় দু’জন মানূষের সঙ্গে মোহন গুপ্তা এখানে এসে পৌঁছন এবং রাজনৈতিক হানাহানির খবরের বাইরে একটি স্কুপ নিউজ তৈরির জন্য কালাদেওর মিথকে বেছে নেন। পাশের একটি গ্রামে তিনি তিন-চারদিন থাকবার ব্যবস্থা করেন।

আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৬: হারায়ে খুঁজি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

ঘটনার দিনে দুপুর পর্যন্ত আশেপাশের গ্রামে সংবাদ সংগ্রহ করেন, একবার পিশাচ পাহাড়ে যান, বিকেলে ফিরে আসেন সেখান থেকেই। ঠিক ছিল, পরের দিন সকাল সকাল গিয়ে তিনি কিছু ছবি তুলবেন এবং গুহার ভিতরের যতটা সম্ভব ছবি তুলবেন। তাঁর কাছে একটা বিদেশি ক্যামেরা সবসময় থাকত। তাছাড়া দামি মোবাইলও ছিল। কিন্তু পরের দিন ভোরের দিকে কাছাকাছি গ্রামের একটি পরিবারে নতুন সন্তানের জন্ম হয় এবং তাদের রীতি অনুযায়ী, ফুল, ফল ও একখানা ডিঙ্গলা নিয়ে তারা পুজো দিতে যায় কালাদেওর থানে। সেখানে গিয়েই দেখতে পায়, একটা লাশ পড়ে রয়েছে। মাথা নেই। পরে জানা যায়, সেটা মোহন গুপ্তার মৃতদেহ। যেহেতু বিশেষ রাজনৈতিক দলটি কালাদেওর থানকে এড়িয়ে চলত, ফলে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া হয়, এটা কালাদেওর কীর্তি। মোহন গুপ্তা পরের দিন কালাদেওর থান অশুচি করবেন তা জেনে কালাদেও ক্রুদ্ধ হয়ে এই কাজটি করেছেন। ক্রমশ দাবানলের মতো খবরটি ছড়িয়ে পড়ে, বিক্ষোভ দেখায় আদিবাসীদের সংগঠন। প্রশাসনকে সেই ঘটনায় বেগ পেতে হয়েছিল, সে-কথা আপনারা সকলেই অবগত আছেন।

এর ঠিক বছর দুই পরে পর পর আরও দু’টি লাশ কালাদেওর থানে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় লাশ দুটি একইভাবে মুণ্ডহীন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তবে অবাক হওয়ার মতো কাণ্ড অন্য জায়গায়। খবইরে প্রকাশ যে, মৃত ব্যক্তি দুজনেই দুই বছর আগে মোহন গুপ্তার দলে কাজ করত এবং তারা আদিবাসী হয়েও কালাদেওর থান অভিযানে সামিল হিয়েছিল। এর ফলে কালাদেও সম্পর্কিত মিথ আরও জোরদার হয়ে ওঠে। তবে তার পরে অনেকগুলি বছর কেটে গেলেও এই এতদিন পরে বিগত কয়েকমাসে একাধিক ব্যক্তি হত হয়েছেন এবং অনেকে কালাদেওকে দেখেছেন বলেও দাবি করছেন, যা এর আগে কেউ দাবি করেনি, কারণ দাবি করার জন্য তাঁরা আর জীবিত ছিলেন না।

সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি যেহেতু আমরা সকলেই জানি, সেই কারণে এই ক্ষুদ্র প্রতিবেদনে তার উল্লেখ আমরা করলাম না। আমরা দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সাম্প্রতিক কালে যতগুলি ঘটনা কালাদেওর বলি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং সে কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন। বিগত তিন চার মাসে প্রায় সাত জন কালাদেওর বলি হয়েছেন। তাদের মধ্যে সকলেই যে এই অঞ্চলের বাসিন্দা তা নয়। আবার নিহতদের মধ্যে দু’ একজন কুলি-কামিন আছেন, যাঁরা কোনওভাবেই কালাদেওর থানের সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা অন্য অঞ্চলের লোক এবং কাজ থেকে ফিরছিলেন সম্পূর্ণ অন্য পথ ধরে। কালাদেও কেবল তাঁর গুহার বাইরে বেরোননি, তিনই তাঁর বিচরণের সীমানাও বাড়িয়ে নিয়েছেন, এটাই চিন্তার কথা!
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!

একইসঙ্গে কিছু প্রশ্ন থেকে যায় যে, এতদিন গুপ্তভাবে থাকার পর হঠাৎ কালাদেও ক্রুদ্ধ হলেন কেন? তাছাড়া কালাদেও তাঁর নির্দিষ্ট অঞ্চল ছেড়ে যত্রতত্র দেখা দিচ্ছেন কিংবা নিরীহ মানুষদের আক্রমণ করছেন কেন? তাহলে কী তাঁর নিজস্ব স্থানে কিছু ঘটেছে? কোনও অনাচার বা অন্য কিছু? স্থানীয় গ্রামদেবতার মন্দিরের পুরোহিত-পুত্র ঈশ্বরীপ্রসাদ দাবি করেছেন, সম্প্রতি কিছুকাল হল পিশাচ পাহাড়কে ট্যুরিস্ট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা এবং পর্যটকদের ভিড় করে পিশাচ পাহাড়ে আসা, কালাদেওর থানে সেলফি তোলার হিড়িক থেকেই কালাদেওর থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে এবং সেই কারণেই কালাদেও এত ক্রুদ্ধ হয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছেন। অবিলম্বে এই অনাচার যদি প্রশাসনের তরফ থেকে বন্ধ না করা হয়, তাহলে কিন্তু আরও বড় কোনও বিপর্যয় কিংবা ঘটনা অপেক্ষা করে আছে।

আমরা স্বীকার করি, তাঁর কথার মধ্যে সত্যতা আছে। বাইরের মানুষদের ঘন ঘন আনাগোনায় পিশাচ পাহাড়ের যে নিজস্বতা, গাম্ভীর্য এবং পবিত্রতা, তা অনেকখানি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং প্রতিদিন হচ্ছে, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা এই ব্যাপারে প্রশাসন এবং স্থানীয় মানুষদের সচেতনতা দাবি করে এই প্রতিবেদন শেষ করছি।”

শাক্য প্রতিবেদনটা দু’বার পড়লো। আগের প্রতিবেদনে পূর্ব ইতিহাস প্রাধান্য পেয়েছিল। দ্বিতীয় কিস্তিতে সাম্প্রতিক কালের ঘটনার কথা বলা হয়েছে। তবে সব ঘটনা ফলাও করে বলা হয়নি, মোহন গুপ্তার কেসটা বেশি জায়গা জুড়ে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। মোহন গুপ্তা যে-সে মানুষ ছিলেন না। তখনও সে ডিপার্টমেন্টে যোগ দেয়নি। তবে প্রস্তুতি চলছিল। সেই সময় সমস্ত সংবাদপত্রে মোহন গুপ্তার কেস নিয়ে অন্তর্তদন্ত ইত্যাদি প্রকাশিত হত। তা নিয়মিত খুঁটিয়ে পড়ত সে। এখন মনে পড়ল, কালাদেও নামটা শুনে তার অবচেতনে কেন একটা অস্বস্তি জন্ম নিয়েছিল। এই নামটা তার আগেই শোনা। সংবাদপত্রে নামটা বেশ কয়েকবার উঠে এসেছিল। অনেকেই অবশ্য সেই বিশেষ গুপ্ত রাজনৈতিক দলকেই দায়ি করেছিল। অন্য জায়গায় খুন করে এখানে এনে দেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এমনটাও বলেছিল কোন কোন সংবাদপত্র।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ

তবে মাথা কাটা হয়েছিল কেন, সেই কাটা মাথার খোঁজ কেন পাওয়া গেল না, সে-বিষয়ে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শাক্যর তখন মনে হয়েছিল, উক্ত রাজনৈতিক দলটির আর যাই বদনাম থাক, কারও মাথা কেটে গেণ্ডুয়া খেলবে, এমন বদনাম কিংবা অদ্ভুত শখ এর আগে কখনও দেখা যায়নি। তাছাড়া মোহন গুপ্তা মূর্খ বা বালখিল্য ছিলেন না। রাতবিরেতে কালাদেওর থানে কেউ তাঁকে যদি ডেকেও থাকে কিংবা দেখা করতে বলে, তাহলে তিনি সাত-পাঁচ না ভেবেই চলে গেলেন এটা মেনে নিতেই কষ্ট হচ্ছে।

দ্বিতীয় যুক্তি হল, মোহন গুপ্তা আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন, তিনি যাবেন, রাতের বেলাতেই যাবেন। তবে সেই কথা তিনই নিজের টিমের কাছেও গোপন রেখেছিলেন। না কি, কেউ জানত তাঁর টিমের? সেই কি আততায়ী? না কি, নিছকই ইনফর্মার? তা যদি হয়, তাহলে কারণটা কী? তৃতীয় যুক্তি, মোহন গুপ্তা নিজেই গিয়েছিলেন রাতের বেলা। কিন্তু কেন? কী দেখতে গিয়েছিলেন তিনই? না কি কারও সঙ্গে রাতের বেলা ওখানে দেখা করাটা জরুরি ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠে আসে, কেন? কী সেই জরুরি প্রয়োজন?

সে পাভেলের দিকে তাকালো। পাভেল ছাদের দিকে মুখ করে দাঁতে পেন কামড়ে ধরে কী সব ভাবছে। শাক্য ডাকল তাকে, “পাভেল!”
পাভেল প্রথম ডাকে সাড়া দিল না। শাক্য আবার ডাকল, “পাভেল!”
এবার তাকাল সে।
শাক্য বলল, “কফি চলবে এক রাউন্ড?”
“তুমি খাওয়াচ্ছো তো বস?”
“শালা কিপটে! আমিই খাওয়াচ্ছি। আগের বারও আমিই খাইয়েছিলাম।”
পাভেল ফিচেল হাসি হেসে বলল, “খাবো। তারপর কিছু আলচনা করব!”—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content