অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।
ঘড়ির কাঁটা দেখল শাক্য। বেশিক্ষণ হয়নি। আশা করি ফাইলগুলি পড়ে ফেলতে পারবে আজকের মধ্যেই। সে আর সময় নষ্ট না করে আবার ফাইলে ডুবে যায়। প্রতিবেদন নম্বর দুই-তে কী আছে দেখা যাক—এই ভেবে।
কালাদেওর ইতিহাস-দ্বিতীয় পর্ব
“আগের সংখ্যায় আমরা কালাদেওর ইতিহাসের গোড়ার কথা জেনেছি। এই সংখ্যায় সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা সম্পর্কে জানবো। কালাদেও সম্পর্কে শেষ ঘটনার কথা জানা যায়, ২০০৯ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে। সে-সময় এই এলাকায় একটি গুপ্ত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শাসক দলের সংঘর্ষ চলছিল। এই খবর সংগ্রহ করার জন্য দিল্লির একটি নামি সংবাদপত্রের জনৈক সাংবাদিক মোহন গুপ্তা এখানে আসেন। মোহন গুপ্তা খুব ডাকাবুকো সাংবাদিক। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় সেখানে গিয়ে রীতিমতো প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন। সাহসিকতার জন্য বেশ কয়েকটি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও তিনি পেয়েছিলেন। তখন এই অঞ্চল ছিল উপদ্রুত এলাকা হিসেবে ঘোষিত। সুরক্ষার জন্য গড়ে ওঠা একটি পুলিশ ক্যাম্পে বিশেষ রাজনৈতিক দলটি হামলা চালিয়ে বেশ কিছু পুলিশকে গেরিলা কায়দায় অতর্কিতে ঘিরে ফেলে হত্যা করলে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে এবং কেন্দ্রীয় সরকার মিলিটারি ক্যাম্প বসান। খানাতল্লাশি শুরু হয়। এই সমস্তই আপনারা ভুলে যাননি আশা করি।
এই সময়েই মোহন গুপ্তা এখানে আসেন এবং সরেজমিনে তদন্ত করে এলাকায় উক্ত রাজনৈতিক দলটির বাড়বাড়ন্তের পিছনে কোনও আর্থ-সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক কারণ আছে কি না সে ব্যাপারে একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শুরু করেন। তাঁর এ-জন্য বিশেষ পারমিট ছিল এবং মিলিটারি ক্যাম্প এবং জঙ্গলের গভীরে কোনও সুরক্ষা ছাড়া যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ব্যতীত আর সব ব্যাপারে প্রশাসনের তরফ থেকে তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল। এই সূত্রেই তিনি সম্ভবত পিশাচ পাহাড়ের কাছে পৌঁছন। একটা কথা না বললেই নয়, বিশেষ রাজনৈতিক দলটির কার্যকলাপ ওই সময় এলাকার অন্যত্র ছড়িয়ে পড়লেও আশ্চর্যজনকভাবে কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পিশাচ পাহাড়ে তাঁদের কোন সক্রিয়তা ছিল না। হয়তো, আদিবাসী মানুষদের ভাবাবেগে ঘা দিলে তাঁদের শক্তি ও সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়বে ভেবেই তাঁরা এই স্থানটি এড়িয়ে চলতেন। সেই সময়েই একদিন স্থানীয় দু’জন মানূষের সঙ্গে মোহন গুপ্তা এখানে এসে পৌঁছন এবং রাজনৈতিক হানাহানির খবরের বাইরে একটি স্কুপ নিউজ তৈরির জন্য কালাদেওর মিথকে বেছে নেন। পাশের একটি গ্রামে তিনি তিন-চারদিন থাকবার ব্যবস্থা করেন।
রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৬: হারায়ে খুঁজি
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?
এর ঠিক বছর দুই পরে পর পর আরও দু’টি লাশ কালাদেওর থানে পাওয়া যায়। আশ্চর্যের বিষয় লাশ দুটি একইভাবে মুণ্ডহীন অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। তবে অবাক হওয়ার মতো কাণ্ড অন্য জায়গায়। খবইরে প্রকাশ যে, মৃত ব্যক্তি দুজনেই দুই বছর আগে মোহন গুপ্তার দলে কাজ করত এবং তারা আদিবাসী হয়েও কালাদেওর থান অভিযানে সামিল হিয়েছিল। এর ফলে কালাদেও সম্পর্কিত মিথ আরও জোরদার হয়ে ওঠে। তবে তার পরে অনেকগুলি বছর কেটে গেলেও এই এতদিন পরে বিগত কয়েকমাসে একাধিক ব্যক্তি হত হয়েছেন এবং অনেকে কালাদেওকে দেখেছেন বলেও দাবি করছেন, যা এর আগে কেউ দাবি করেনি, কারণ দাবি করার জন্য তাঁরা আর জীবিত ছিলেন না।
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলি যেহেতু আমরা সকলেই জানি, সেই কারণে এই ক্ষুদ্র প্রতিবেদনে তার উল্লেখ আমরা করলাম না। আমরা দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, সাম্প্রতিক কালে যতগুলি ঘটনা কালাদেওর বলি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, তা সংখ্যায় অনেক বেশি এবং সে কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন। বিগত তিন চার মাসে প্রায় সাত জন কালাদেওর বলি হয়েছেন। তাদের মধ্যে সকলেই যে এই অঞ্চলের বাসিন্দা তা নয়। আবার নিহতদের মধ্যে দু’ একজন কুলি-কামিন আছেন, যাঁরা কোনওভাবেই কালাদেওর থানের সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত ছিলেন না। তাঁরা অন্য অঞ্চলের লোক এবং কাজ থেকে ফিরছিলেন সম্পূর্ণ অন্য পথ ধরে। কালাদেও কেবল তাঁর গুহার বাইরে বেরোননি, তিনই তাঁর বিচরণের সীমানাও বাড়িয়ে নিয়েছেন, এটাই চিন্তার কথা!
অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর
হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৯: তা বলে কি প্রেম দেব না!
আমরা স্বীকার করি, তাঁর কথার মধ্যে সত্যতা আছে। বাইরের মানুষদের ঘন ঘন আনাগোনায় পিশাচ পাহাড়ের যে নিজস্বতা, গাম্ভীর্য এবং পবিত্রতা, তা অনেকখানি ক্ষুণ্ণ হয়েছে এবং প্রতিদিন হচ্ছে, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আমরা এই ব্যাপারে প্রশাসন এবং স্থানীয় মানুষদের সচেতনতা দাবি করে এই প্রতিবেদন শেষ করছি।”
শাক্য প্রতিবেদনটা দু’বার পড়লো। আগের প্রতিবেদনে পূর্ব ইতিহাস প্রাধান্য পেয়েছিল। দ্বিতীয় কিস্তিতে সাম্প্রতিক কালের ঘটনার কথা বলা হয়েছে। তবে সব ঘটনা ফলাও করে বলা হয়নি, মোহন গুপ্তার কেসটা বেশি জায়গা জুড়ে আছে। সেটাই স্বাভাবিক। মোহন গুপ্তা যে-সে মানুষ ছিলেন না। তখনও সে ডিপার্টমেন্টে যোগ দেয়নি। তবে প্রস্তুতি চলছিল। সেই সময় সমস্ত সংবাদপত্রে মোহন গুপ্তার কেস নিয়ে অন্তর্তদন্ত ইত্যাদি প্রকাশিত হত। তা নিয়মিত খুঁটিয়ে পড়ত সে। এখন মনে পড়ল, কালাদেও নামটা শুনে তার অবচেতনে কেন একটা অস্বস্তি জন্ম নিয়েছিল। এই নামটা তার আগেই শোনা। সংবাদপত্রে নামটা বেশ কয়েকবার উঠে এসেছিল। অনেকেই অবশ্য সেই বিশেষ গুপ্ত রাজনৈতিক দলকেই দায়ি করেছিল। অন্য জায়গায় খুন করে এখানে এনে দেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল, এমনটাও বলেছিল কোন কোন সংবাদপত্র।
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬: গার্হস্থ্য জীবনের প্রারম্ভে ভৈরবী ব্রাহ্মণীর আগমন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭০: অন্য বাইশে শ্রাবণ
দ্বিতীয় যুক্তি হল, মোহন গুপ্তা আগে থেকেই ঠিক করেছিলেন, তিনি যাবেন, রাতের বেলাতেই যাবেন। তবে সেই কথা তিনই নিজের টিমের কাছেও গোপন রেখেছিলেন। না কি, কেউ জানত তাঁর টিমের? সেই কি আততায়ী? না কি, নিছকই ইনফর্মার? তা যদি হয়, তাহলে কারণটা কী? তৃতীয় যুক্তি, মোহন গুপ্তা নিজেই গিয়েছিলেন রাতের বেলা। কিন্তু কেন? কী দেখতে গিয়েছিলেন তিনই? না কি কারও সঙ্গে রাতের বেলা ওখানে দেখা করাটা জরুরি ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই উঠে আসে, কেন? কী সেই জরুরি প্রয়োজন?
সে পাভেলের দিকে তাকালো। পাভেল ছাদের দিকে মুখ করে দাঁতে পেন কামড়ে ধরে কী সব ভাবছে। শাক্য ডাকল তাকে, “পাভেল!”
পাভেল প্রথম ডাকে সাড়া দিল না। শাক্য আবার ডাকল, “পাভেল!”
এবার তাকাল সে।
শাক্য বলল, “কফি চলবে এক রাউন্ড?”
“তুমি খাওয়াচ্ছো তো বস?”
“শালা কিপটে! আমিই খাওয়াচ্ছি। আগের বারও আমিই খাইয়েছিলাম।”
পাভেল ফিচেল হাসি হেসে বলল, “খাবো। তারপর কিছু আলচনা করব!”—চলবে।