মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

শাক্য গোগ্রাসে গিলছিল ভবানীপ্রসাদ রায়ের লেখা ‘কালাদেওর ইতিহাস’ নামক লেখাটি। এই জাতীয় স্থানীয় কাগজে স্পেস খুব কম। ফলে লেখা তেমন বিস্তৃত নয়। মোটামুটিভাবে কালাদেও সম্পর্কে মিথ ও ইতিহাস যা জানা গিয়েছে, তাকেই এক জায়গায় করতে চেয়েছেন তিনি। তিন সপ্তাহ জুড়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। একেজি-র ইনফর্মার সব ক’টি লেখাই জোগাড় করে পর পর সাজিয়ে দিয়েছে। ফলে মোটামুটিভাবে কালাদেও সম্পর্কিত প্রাথমিক তথ্য এবং বিশেষত্ব জানতে অসুবিধা হচ্ছে না। এর মধ্যেই কি পাওয়া যাবে কোন ক্লু? শাক্য অন্য দিক থেকে মন সরিয়ে একাগ্র চিত্তে লেখাটি পড়তে লাগল—
 

কালাদেওর ইতিহাস: ফিরে দেখা

“সম্প্রতি জেলায় আবার একটা পুরাতন কাহিনি সকলের মুখে মুখে ঘুরছে, আর সকলের মনে আতঙ্ক ও কৌতূহল একই সঙ্গে জেগে উঠেছে। যাঁরা এই জেলার আদি বাসিন্দা তাঁদের অনেকে এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল হলেও, যাঁরা এই স্থানে আগন্তুক কিংবা একেবারে নবীন প্রজন্ম, তাঁদের অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই কিংবা অনেকে জানেনও না যে, কালাদেও কে এবং তাঁর সম্পর্কে মিথ বা কিংবদন্তী কী বলে। এই কারণেই সম্পাদকের অনুরোধে বর্তমান লেখকের এই অকিঞ্চিৎকর লেখার অবতারণা।

আপনারা এই জেলার পশ্চিম অংশে অবস্থিত পাহাড়ের যে রেঞ্জ, তার একেবারে প্রান্ত সীমায় রয়েছে একটি সুউচ্চ টিলা, যার নাম পিশাচ পাহাড়। আমরা সকলেই জানি যে, এই টিলা-পাহাড়ের রেঞ্জ বয়সের বিচারে হিমালয়ের চেয়েও অনেক প্রাচীন। এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস বিশেষ কিছুই জানা যায় না। তবে পূর্বে এই অঞ্চলের সিংহভাগ বিহার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এটি পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাচীন যুগে এখানে একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। জৈন এবং অন্যান্য ধর্মমতেরও প্রচলন ছিল এই অঞ্চলে।

তবে মধ্যযুগেও এই অঞ্চলের অধিকাংশ অংশ ছিল জঙ্গলাকীর্ণ। এই অঞ্চলে আদিকাল থেকে কুরমি, সাঁওতাল, ওঁরাও, ভূমিজ, বাউরি ইত্যাদি নানা সম্প্রদায়ের বাস। তাঁদের মধ্যে একটি ছোট সম্প্রদায় কালাদেও নামক দেবতা কিংবা শক্তির উপাসক। পিশাচপাহাড়কে কেন্দ্র করে আশেপাশের প্রায় পাঁচটি গ্রাম এই দেবতাকেই তাঁদের আরাধ্য দেবতা বলে মনে করেন এবং পুজো করেন। কালাদেও তাঁদের আরাধ্য দেবতা হলেও এঁর কোন পৃথক মূর্তি নেই।

পিশাচপাহাড়কেই কালাদেওর অধিষ্ঠান ভূমি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং পাহাড়কেই পুজো করা হয়। পিশাচপাহাড় যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানেন যে, এই পাহাড়ের পাদদেশে একখানা প্রাকৃতিক গুহা আছে। যদিও স্থানীয়দের বিশ্বাস, ওই গুহা স্বয়ং কালাদেও খোদাই করিয়েছিলেন, তাঁর বাসস্থান হিসেবে। যাদের দ্বারা খনন করিয়েছিলেন, তাদের সকলকেই তিনি চিরকালের জন্য কয়েদ করেন এবং সেই কারণেই তারা গুহামুখ কাটতে কাটতে ভিতরে যায় এবং আর কোনওদিন বেরিয়ে আসেনি। গুহাটি টিলা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ক্রমশ নিচের দিকে নেমে গিয়েছে। এর প্রবেশ পথ হাত তিনেক চওড়া; মাঝখানের অংশ সংকীর্ণ। একসঙ্গে একজন মানুষ কেবল সেই স্থান পার হতে পারে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৪: রাত্রির রং রহস্যময়

দুই বাংলার উপন্যাস: বসুন্ধরা এবং, ২য় খণ্ড, পর্ব-২৭: উচ্চাকাঙ্ক্ষা, নাম, টাকা, গ্ল্যামারের নেশায় নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করল শিবানী

তবে তার পরে আবার পথটি চওড়া হতে হতে নিচের দিকে সোজা নেমে গিয়েছে। টিলার গভীরে সাহেবরা চেষ্টা করেও অভিযান চালাতে সম্ভব হয়নি। একবার চেষ্টা হয়েছিল বলে শোনা যায়, তখন ১৮৫৬ সাল; স্থানীয় মানুষদের বাধায় তা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। কিছুদিন পরেই সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, ফলে দেশীয় মানুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস-সংস্কারের উপর সাহেব-প্রভুদের আগ্রাসনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। সাহেবদের গুহাভ্যন্তরে অভিযান ওইখানেই পরিত্যক্ত হয়। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে বার-দুয়েক কেউ কেউ চেষ্টা করলেও সফল হয়নি কেউই।

কালাদেওকে কেউ কেউ দেখলেও একমাত্র উক্ত সম্প্রদায়ের পুরোহিত এবং ওঝা ছাড়া আর কারুর সমক্ষেই তিনি সচরাচর আসেন না। কালাদেও অন্ধকারের দেবতা। তিনি তুষ্ট হলে মৃত্যু কিংবা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করবেন, এমনটাই সকলের বিশ্বাস। কার্তিক মাসের কৃষ্ণা চতুর্দ্দশীতে তাঁর বিশেষ পুজো (বাৎসরিক পুজোও বলা চলে। তবে কালাদেও বছরে মাত্র একবারই পূজিত হন) অনুষ্ঠিত হয়। পূর্বে পালাক্রমে পাঁচটি গ্রাম থেকে একজনকে নির্বাচন করে উক্ত দিনটিতে উৎসর্গ করা হত। সাধারণত, গ্রামের কোনও অনাথ, কিংবা সুলক্ষণযুক্ত কাউকে (সে নারী কিংবা পুরুষ কিংবা কিশোর-কিশোরী যে-কেউ হতে পারে, তবে একেবারে বাচ্চাকে উৎসর্গ করা হত না, তাকে গ্রহণ করে কালাদেওর পেট ভরবে না বলে।) উৎসর্গ করা হতো।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৯: যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

যদিও এখন আর প্রকাশ্যে এমন ঘটনা ঘটার কথা শোনা যায় না। মানুষের পরিবর্তে এখন ছাগল, মোষ, ভেড়া ইত্যাদি বলি দেওয়া হয়। সন্ধ্যার পরে পুরোহিত, ওঝা এবং নির্বাচিত গ্রাম-সদস্য ছাড়া আর কারুরই পূজার সময় উপস্থিত থাকার অনুমতি নেই। এমনকি বাইরের কাউকেই এই সময় সেখানে উপস্থিত থাকতে দেওয়া হয় না। যদি কেউ এই নিয়ম লঙ্ঘন করে, এবং ধরা পড়ে তবে তাকেও কালাদেওর নামে উৎসর্গ করা কিংবা হত্যা করার বিধান আছে। আমাদের মনে হয়, গোটা ব্যাপারটাই তন্ত্র-মন্ত্র জাতীয় আভিচারিক ক্রিয়া। প্রভূত পরিমাণ মদ, ফল-মূল, কাঁচা মাংস দেবতার নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয়। এই পুজো সারারাত ধরে চলে। গ্রামস্থ যাদের যাদের মানত করা থাকে, তারা ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি যার পক্ষে যা সম্ভব তা উৎসর্গ করেন, সেগুলিকেও বলি দেওয়া হয়। পিশাচপাহাড়ের গুহামুখের কাছে একটি গোল পাথর আছে, সেখানে প্রতি বছর নতুন বলিকাঠ তৈরি করে স্থাপন করা হয়। তারপর পূজান্তে সেখানে বলি দিয়ে প্রতিটি বলির এক ভাগ মাত্র গ্রহণ করেন পুরোহিত এবং ওঝা। বাকি ভাগ অন্ধকার গুহার গর্ভে কিছুদূর গিয়ে সেখানে রেখে আসা হয়। দেবতার ভাগ রেখে দেওয়ার পরে আর পিছনে ফিরে দেখার নিয়ম নেই।

দেবতা অনেক সময় যারা বলির ভাগ পৌঁছাতে যায়, তাদের কারুর নাম ধরে ডাকেন। সেই ডাক শুনে যদি কেউ পিছনে ফিরে দেখে, তবে তাকেও তিনি টেনে নেন। তার আর ফেরার উপায় থাকে না। এই কারণে ইদানীং কানে তুলো গুঁজে ভোগদাতারা ভিতরে প্রবেশ করেন এবং বেরিয়ে এসে বাঁচেন। পুরোহিত কিংবা ওঝা বলির ভাগ পান সত্য, কিন্তু সেই বলির ভাগ তাঁরা বাড়িতে নিয়ে যান না। কারণ, কালাদেওর প্রসাদ কখনো বাড়ির মধ্যে নিয়ে যেতে নেই। বিশ্বাস, এর অন্যথা হলে, কালাদেও বলির গন্ধ শুঁকে শুঁকে বাড়ি পর্যন্ত ধাওয়া করবেন এবং বাড়ির একজনকে নিজের ভাগ হিসেবে নিয়ে যাবেন। এই কারণে পরের দিন সকালে পাঁচটি গ্রামের সকলে পিশাচপাহাড়ের পাদদেশে উপস্থিত হন এবং পুরোহিত ও ওঝা তাঁদের প্রাপ্য বলির ভাগ সকলের নামে উৎসর্গ করে দেন। তখন উক্ত মাংস রান্না করা হয় সেখানেই। সঙ্গে ভাত, কন্দ জাতীয় কিছু কাঁচা ফল এবং মদ—এই দিয়ে সকলে একসঙ্গে প্রসাদ গ্রহণ করে এবং বাড়ি ফিরে যায়।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

কালাদেওর এই পূজার রীতি সম্পর্কে ইতিহাসে প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় স্যামুয়েল দ্য গঞ্জালেস নামক সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকের এক পর্তুগীজ পর্যটকের ডায়ারিতে। তিনি এক ভয়ঙ্কর প্রথার উল্লেখ করেছেন, যেখানে জানা যায়, একজন নয়, একাধিক ব্যক্তিকে বলি দেওয়া হত এবং তাদের হৃৎপিণ্ডকে উপড়ে আলাদা করে পাথরের গোল থালায় সাজিয়ে দেওয়া হতো। স্থানীয় এক আদিবাসীকে উৎকোচ দিয়ে এই পুজো গোপনে দেখতে গিয়ে শেষে স্যামুয়েল ধরা পড়তে পড়তে কোণরকমে বেঁচে ফেরেন এবং সেদিনই বাংলা ত্যাগ করেন। স্যামুয়েল উল্লেখ করেছেন, তিনি শুনেছেন এই পুজো প্রায় পাঁচশো বছর ধরে চলে আসছে উক্ত সম্প্রদায়ের ভিতর। তবে তাঁর সময়ে তিনি যা দেখেছেন, তাতেই বোঝা যায়, কোন আদিম কৌম গোষ্ঠীর আচরিত প্রথাই এতকাল ধরে চলে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামান্য কিছু বদল ঘটেছে যা, তা বাইরের বদল। ভিতরের কাঠামো একই আছে।

তবে কালাদেও সম্পর্কিত মিথ ও পুজো প্রচলিত থাকলেও কালাদেও গুহামুখ থেকে বেরিয়ে স্থানীয় মানুষজনকে আক্রমণ করেছেন, এমন খুব কমই ঘটেছে বলে জানা যায়। স্বাধীনতার আগের কথা তেমন জানা যায় না। যদিও স্বাধীনতার পরে বার দশেক গুহামুখের কাছে মৃতদেহ পাওয়া গেলেও, জনশ্রুতি যে, তাদের মৃত্যুর কারণ কালাদেও না, পাহাড়ি সাপ কালাচ কিংবা শিয়রচাঁদা; অনেকে গুপ্ত আততায়ীর দ্বারা নিহত হয়েছেন, অনেকে গুহার ভিতর জমে থাকা বিষাক্ত গ্যাসেও মারা যেতে পারেন। স্থানীয়দের বক্তব্য, কালাদেও অকারণে হত্যা করেন না। কারও আচরণে ক্ষুব্ধ হলে, নিজের পুজো না পেলে ক্রুদ্ধ হন। মানুষকে বধ করে কিংবা তার অতি প্রিয় জিনিসকে ধ্বংস করে শান্ত হন। তাছাড়া কারও মৃতদেহই সাম্প্রতিক কালের মতো অর্দ্ধভক্ষ কিংবা বিকৃত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।

সাম্প্রতিককালে কালাদেওর কীর্তি বলে যা পরিচিত, সেখানে দেখা যাচ্ছে যে, মৃতদেহর মুখের প্রতিই তাঁর আক্রোশ বেশি। অনেক ক্ষেত্রে বডিতে অন্যান্য চিহ্ন দেখে সে কারণেই মৃতদেহ সনাক্ত করতে হচ্ছে। যেন কালাদেও মৃত ব্যক্তিদের এমনভাবে হত্যা করেছেন যে, তাদের পরিচয় সহজে কেউ চিনতে না পারে। কালাদেওর এহেন মানস-পরিবর্তন ভাবাচ্ছে বিশেষজ্ঞদের।”

এই টুকুই প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। শাক্য পরের সংখ্যার লেখাটির দিকে মনোযোগ দিল। —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content