শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: সৌমি দাসমণ্ডল।

ঘরটা অন্ধকার। তবে সে অন্ধকার অত ঘন নয়। বরং জানালা চুঁইয়ে কোথা থেকে যেন তরল আলো আসছে। ছোটবেলায় অরণ্যের ঠাকুমা বলতেন, রাত্রি খুব অন্ধকারকে ভয় পায়। সেই জন্যই অসংখ্য নাইটল্যাম্প সে জ্বলে রাখে আকাশে। আর একটা বড় আলোও থাকে। তবে সে মাসের মধ্যে পনেরো দিন ঠিক থাকে, আবার খারাপ হয়ে যায়। এই কারণে রাত্রি অনেক বেশি নির্ভর করে তারা নামক ওই সমস্ত নাইটল্যাম্পের ওপরে। ওরাই রাত্রির অন্ধকারকে ঘন হতে দেয় না।

খুব সুন্দর কথাটা। বড় হয়েও সে ভোলেনি। তারা ভাবতে ভালো লাগত, রাত্রি নিজেই অন্ধকারকে ভয় পায়। তারাদের সঙ্গে যেন কোনও অদৃশ্য সুইচবোর্ড আছে। রাত্রি একে একে সন্ধের সময় সেই সুইচগুলো অন করে দেয়, আবার ভোরবেলা অফ করে দেয় একে একে। এই মুহূর্তে কথাটা তার মনে পড়লো। কারণ, সে জানালার পর্দা সরিয়ে কাঁচে মুখ ঠেকিয়ে বাইরের আকাশ দেখছিল।

তার শরীরে সুতো নেই একটুও। সম্পূর্ণ নগ্ন সে। এবং ঘর্মাক্ত। একটু আগেই ঘরটা ভরে উঠেছিল শীৎকারে আর গোপন সংরাগের আকুতিতে। দু’ রাউন্ড ভালোবাসাবাসির শেষে আপাতত তৃপ্ত তৃধা শুয়ে আছে বিছানায়, তারও শরীরে কোনও পোশাক নেই। হালকা একটা চাদর কেবল জড়িয়ে নিয়েছে সে, যদিও ঘুমের ঘোরে তা সরে গিয়ে তার লোভনীয় কিন্তু শিথিল শরীর আবারও উন্মুক্ত অবস্থায় গোপন খেলার আহ্বান জানাচ্ছে। রাত্রির তরল আলোয় তার পিশাচ পাহাড়ের মতো স্তন ও তার লোভনীয় বৃন্ত চক্‌চক্‌ করছে যেন। কিছুক্ষণ আগেও, এই জানালার কাছে এসে দাঁড়ানোর আগের মুহূর্তেও সেদিকেই তাকিয়ে দেখছিল অরণ্য। আর ভাবছিল।

ভাবছিল আজকের সারাদিনের কথা। ভাবছিল তৃধার সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা। আর ভাবছিল ‘অনলি ফর ইউ ফ্যানস্‌” নামক অন ডিমান্ড সাইটের কথা। আজকের সারাদিন বিস্ময়ের পর বিস্ময়, চমকের পর চমক আর অপ্রত্যাশিতের পর অপ্রত্যাশিতে ভরা। পিকনিকে যাওয়ার আগে পর্যন্ত তারা সবাই ঠিক ছিল। কিন্তু পিকনিকে যাওয়া ইস্তক যেন সকলের সুর-তাল-লয় কেটে গেল। এত অসূয়া, এত বিদ্বেষ যে তাদের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, সব যেন প্রকাশ্যে আসতে শুরু করল। সব জোড়ায় জোড়ায় আলাদা হয়ে গিয়েছিল তারা, ইনেকে আবার তা-ও নয়। অরণ্য নিজেই টিলার অপর দিকে চলে গিয়েছিল বেশ কিছুক্ষণ, সেখানে সে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু ফটোশুট করছিল। এই জাতীয় নগ্ন, অর্ধ-নগ্ন ছবির বেশ ডিমান্ড আছে ইনস্টাতে এবং আরও কোনও কোনও সাইটে। ডার্ক ওয়েবে তো এই ধরণের ভিডিও কিংবা লাইভের বিশাল মার্কেট।
অরণ্যের আফসোস হচ্ছিল যে, তাদের টিমে একজন দক্ষ ক্যামেরাম্যান থাকা উচিত ছিল। তাহলে নিজেকে এক্সপোজ করতে পারত আরও ভালোভাবে। এ ভাবে ফ্রন্ট মোডে যতই ভিডিও শুট করা হোক না কেন, তা যে তেমন মানের হবে না, তা বলাই বাহুল্য। সে যখন এই ট্রিপে এসেছিল, তখন ভেবেছিল, তার জিমে জিম করতে আসা অ্যান্ডিকে আনবে। অ্যান্ডি ফ্যাশন ফোটগ্রাফার হিসেবে ইতিমধ্যেই বেশ নাম করেছে। সে আবার অরণ্যের ফ্যান। অ্যান্ডি সমকামী। সে যে মনে মনে অরণ্যকে কল্পনা করে তার কামনার সঙ্গী হিসেবে, তা অরণ্য বোঝে। আর বোঝে বলেই সে অ্যান্ডিকে সামান্য প্রোভোক করে তার বেশ কিছু ফটোশুট করিয়ে নিয়েছে। অ্যান্ডি যে এর জন্য কোনও পারিশ্রমিক দাবি করবে না, তা সে আগে থেকেই জানতো। কার্যক্ষেত্রে হয়েছেও তাই। কিন্তু তাকে আনার কথা ভাবলেও আনতে পারেনি মূলত দুটি কারণে।

প্রথমত, অনিল সাফ জানিয়ে দিয়েছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুর বাইরে একান্ত ব্যক্তিগত পার্টনার ছাড়া আর কাউকে এই ট্রিপে অ্যালাও করা হবে না। যে কারণে, অঞ্জন সাকসেনা আসতে পেরেছে, কিন্তু অ্যান্ডি পারবে না। দ্বিতীয়ত, অরণ্য আশঙ্কা করছিল, এই পরিবেশে অ্যান্ডি হয়তো নিজেকে সংযত রাখতে পারবে না। সেটা প্রকাশ্যে বেরিয়ে এলে তার আর তৃধার সম্পর্কে একটা বড় ফাটল ধরবে। তৃধা খুব জেদি আর প্রতিহিংসাপরায়ণ মেয়ে। অরণ্য মনে মনে আজ দুপুরেই ভাবছিল, একবার সে আর অ্যান্ডি আসবে এখানে, আবার। সেখানে মনের সাধ মিটিয়ে ফটোশুট করা যাবে, অ্যান্ডিকেও খুশি করে দেওয়া যাবে। দিবে আর নিবে মিলাবে মিলিবে আর কী!
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৩: গোবিন্দর হেঁয়ালি

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬: নাম দিয়ে যায় চেনা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-৩৭: মহানায়কের সেই ভুবন ভুলানো হাসি আর সস্নেহ চাহনির কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে

যতক্ষণ সে ভিডিওগ্রাফি করছিল, সেই সময় কে কী করছিল তার জানা নেই। কেউ হয়তো ড্রিংক নিচ্ছিল, কেউ খাবার খাচ্ছিল, অলসবভাবে শুয়ে থাকাও বিচিত্র নয়। কেবল আর্য বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর আর সে কোনও খবর দেয়নি। আচ্ছা, ইন্সপেক্টর যে বলছিলেন, একজন যুবককে কালাদেও নামক কোন আননেচারাল অ্যানিম্যাল হত্যা করেছে, সেই যুবক যদি আর্য হয়? তাহলে তো তারা বিরাট ফেঁসে যাবে। এই সপ্তাহে ফিরে গিয়েই তার একটা ইভেন্টে পার্টিসিপেট করার কথা। অস্থির লাগছিল অরণ্যের। ফেরার সময় তৃধা একটা অদ্ভুত কথা বলছিল, উন্মেষা না কি পিকনিকে গিয়ে কারও সঙ্গে থেকে থেকে মেসেজ করছিল। তারপর ক্ষণিকের জন্য সে দেখেছে, উন্মেষা হঠাৎ যেন একাকী হাঁটার ইচ্ছে হয়েছে। এমনিভাবে উঠে গিয়ে জঙ্গলের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ, তারপর জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গিয়েছিল। তার কিছুক্ষণ পরেই সে উদ্‌ভ্রান্তের মতো দৌড়ে আসে, সে না কি জঙ্গলের ভিতরে কোনও বড়সড় মিশকালো দৈত্যকে দেখেছে। দৈত্য তাকে খেতে এসেছিল, সে কোনওরকমে পালিয়ে এসেছে।

অরণ্য এ সবের কিছুই জানতো না। অনিল না কি তৃধাকে বকেছে, একা একা এভাবে জঙ্গলে ঢোকার জন্য। তারপর সে আর অঞ্জন মিলে জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা ঢুকেও কাউকে দেখতে পায়নি। তবে জঙ্গলে যে মানুষজনের আনাগোনা আছে, এবং তারা সম্ভবত ট্যুরিস্ট পার্টি, তা বোঝা যায়, বিলিতি মদের বোতল, খালি চিপসের প্যাকেট, নাটেলার খালি কৌটো ইত্যাদি স্তুপিকৃত পড়ে থাকতে দেখে। যাই হোক, তারা আর কিছু অস্বাভাবিক দেখেনি। ধরেই নিয়েছে সকলে, জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে হঠাৎ ভয় পেয়ে গিয়েছিল উন্মেষা। সে কারণেই কী দেখতে কী দেখেছে!
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৮: ঘরবাড়ি ভালা নাই আমার

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১১: ফুটবলের ব্ল্যাক প্যান্থার: লেভ ইয়াসিন

এই কথাটা অবশ্য অরণ্যকে কেউ জানায়নি। তৃধা না বললে সে জানতেও পারতো না। তবে হতেই পারে, তৃধার জীবনে নতুন কেউ এসেছে, তার সঙ্গেই মেসেজে কথা বলছিল সে। অঞ্জনকে তার হয়তো আর ভালো লাগছে না। এই রিলেশনশিপ থেকে বেরিয়ে আসতে চায় সে। এতে অরণ্য কোনও দোষ দেখে না। এভরিওয়ান ইজ অ্যাডাল্ট, সো তাদের এভরি রাইটস্‌ আছে টু এনজয় ইচ অ্যান্ড এভরি মোমেন্টস অফ লাইফ এবং তা কমপ্লিট ফ্রিডমের সঙ্গে। উন্মেষার মতো মেয়েরা অঞ্জনের চেয়ে আরও বেটার ডিজার্ভ করে। আর অঞ্জনের টাকাকড়িই উন্মেষাকে আকৃষ্ট করেছিল সন্দেহ নেই। হয়তো তার চেয়েও শাঁসালো কাউকে পেয়েছে এবার।

হোটেলে ফিরে কথাটা ভুলেও গিয়েছিল সে। তারপরেই তো সেই অদ্ভুত বাচ্চা মেয়েটির আবির্ভাব। সেই সতর্কবাণী—“বাইরে বেরুলেই বিপদ !” হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল শুনে। বিপদ? কিসের জন্য বিপদ? কার জন্য বিপদ? প্রথমে ভেবেছিল সেই বাজে কথাতে কান দেবে না, কিন্তু তারপরে তৃধা কেমন প্যানিক করতে লাগলো। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও যখন তৃধা রাজি হল না, সে একা গিয়েছিল পার্টিতে। রুম সার্ভিসকে বলে দিয়েছিল, ফলে তারা তৃধার খাবার রুমেই পাঠিয়ে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’—মনোজ বাজপেয়ী একাই একশো

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: অর্শে কষ্ট পাচ্ছেন? আয়ুর্বেদে রেহাই পেতে কী কী করবেন জেনে নিন

তারপর পুলিশের আগমন, সেই রহস্যময় দম্পতির আবির্ভাব, যুবক হত্যার কথা শোনা, আরও কত কী। কারও আর পার্টির দিকে মন ছিল না। সকলকে সামান্য জিজ্ঞাসা করে আগামীকাল থানায় যেতে বলা হয়েছে। মনে হতেই মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল তার। ফিরে এসে যদি না দেখতো তৃধা ইভ হয়ে শুয়ে আছে বিছানার উপর, কিন্তু ঘুমায়নি, বরং তার পা ফাঁক করা দেখে বুঝছিল কামনার স্পষ্ট আহ্বান। অতএব খেলায় সামিল হতে দ্বিধা করেনি সে। কেবল ভাবছিল, যদি এই কামনার দৃশ্যকে ভিডিওতে ধরে রাখা যেত, তাহলে ‘অনলি ফর ইউ ফ্যানস্‌’-এ আপলোড করলে, তা থেকে ভালো টাকাই তার অ্যাকাউন্টে জমা হতো। এই ধরণের ব্যক্তিগত লাভ-মেকিং-এর ভালো দর্শক আছে ওই পেজে। কিন্তু ঘটনাটা এতই আকস্মিক যে, সে সুযোগ পাওয়া গেল না। সেজন্য আফসোস হচ্ছিল অরণ্যের।

আফসোসটা বুকে চেপেই সে বারান্দার দিকের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল। উদোম অবস্থাতেই। ভালোই ঠান্ডা বাইরে। তার শরীরের ঘাম জুড়িয়ে যাচ্ছিল। পাথর কোঁদা শরীর, বাইসেপ ট্রাইসেপ সিক্স প্যাক সম্বলিত রমণীমোহন শরীর। এই মুহূর্তে তাকে লাগছিল গ্রিক গডের মতো। সে ঝুঁকে দেখল নীচের কম্পাউন্ডকে। ঝিঁঝিঁর আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। টিমটিম করে নিষ্প্রভ কয়েকটা আলো জ্বলছিল কম্পাউন্ডের সীমানা প্রাচীরে। এমন সময় সেখানে ভারি কিছু পড়ার আওয়াজ হল। অরণ্য চমকে উঠল। কিন্তু কিছু দেখতে পেল না সে। এদিক ওদিক তাকাতে গিয়ে হঠাৎ তার চোখে পড়ল, নিচের ফ্লোরের রহস্যময় বোর্ডার সেই ডক্যুফিচার বানানো ভদ্রলোক যেন অতি দ্রুত চলে গেলেন। এত রাতে তিনি কী করছিলেন? না কি কোথাও গিয়েছিলেন, এই মাত্র ফিরলেন? কিন্তু এত রাতে তাঁকে গেট খুলে দিলই বা কে? এখানে তো এত রাতে যখন খুশি ঢোকা যায় না। তাহলে কী আগে থাকতে বলা ছিল তাঁর?—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel) – পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content