বুধবার ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

পূষণ রিমিতাকে জিজ্ঞাসা করল, “হ্যান্ডু গোয়েন্দা কী জিজ্ঞাসা করল তোমায় গো?”
রিমিতা সবে উপরে উঠে এসেছিল। সে ভেবেছিল, পূষণ অন্তত তার জন্য অপেক্ষা করবে ওয়েটিং রুমে। কিন্তু ইন্টারোগেশন শেষ হতে বেরিয়ে সে দেখে তার কোণ চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। রিমিতার বুঝতে দেরি হয়নি, পূষণ রুমে ফিরে এসে হয় ভিডিয়ো গেম খেলছে, নয়তো চ্যাট করতে বসে গিয়েছে। ভিতরে একরাশ রাগ আর অভিমান নিয়ে রুমে ঢুকে দেখে, বাবু যথারীতি গেম খেলতে বসে গিয়েছে। কোথা থেকে একটা বাচ্চাদের গেম ডাউনলোড করে দিনরাত এখন সেটাই খেলে যাচ্ছে।
রিমিতা দরজায় নক্‌ করেছিল। কারণ, একটাই চাবি পূষণের কাছে ছিল। তা না হলে সে নক্‌ না করেই ঢুকতে পারত। পূষণ দরজা খুলে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বেডে ফিরে গিয়ে গেম খেলতে লাগল দেখে রিমিতা বার্স্ট করল, “তোমার লজ্জা করে না, আমাকে ওখানে ফেলে রেখে দিব্যি একা একা চলে এলে?”
পূষণ গেম খেলতে খেলতেই বলল, “যা ব্বাবা! লজ্জার কী আছে? তোমার মামার গোয়েন্দা, তার মানে ঘরের লোক! আমিই বরং কাবাব মে হাড্ডি। বহিরাগত! সেই জন্যই চলে এলাম। ঘরের লোকের মাঝে পরের লোক থাকাটা অসভ্যতা!”
রিমিতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “অসভ্য শয়তান একটা! ম্যানারস্‌ জানো না! তোমার চেয়ে আর যে-কেউ ভালো!”
পূষণ বলল, “এখন তো বলবেই। হ্যান্ডু গোয়েন্দা যেই দেখেছ, অমনি আমার থেকে মন উঠে গিয়েছে বুঝতে পারছি। অথচ আজ সকালে কিছুক্ষণ আগেই শাওয়ারের তলায় আমার সঙ্গে কী যে সব অসভ্যতা করলে, আমার লজ্জা করছিল খুব!” শেষ কথাটা ন্যাকা ন্যাকা করে বলল সে রিমিতাকে জ্বালানোর জন্যই।
রিমিতা জ্বলেও উঠল। বলল, “পারভার্টেড কথা বলবে না একদম। সত্যি আগে জানলে ওই গোয়েন্দাকেই না হয় পার্টনার করতাম। তোমার চেয়ে অনেক এটিকেট জানেন। আর এই যে মিস্টার, একটা কথা, মামা বড় পুলিশ অফিসার বলে, আমায় কিন্তু উনি কোনও স্পেশাল অ্যাডভান্টেজ দেননি!”
“সেটাও হয়তো তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য। আমরা সব পুরুষেরাই প্রেমে পড়লে পার্টনারের সামনে কত সৎ, কত আদর্শবান, কত লয়্যাল—তা প্রমাণ করার জন্য উঠে পড়ে লাগি। এ-ও তেমনই হয়তো!”
“সবাই তো তোমার মতো ওই একটা ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকে না। প্রত্যেকের আরও অনেক ভাবনাচিন্তা আছে!”
“তাহলে দেখ, তুমিই স্বীকার করছ যে, আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে নিয়ে পড়ে থাকি না। নাইস কমপ্লিমেন্ট। থ্যাংক ইউ!” তারপরই গলার স্বরটা আদুরে আদুরে করে বলল, “আর এক রাউন্ড হয়ে যাবে না কি?”
“অসভ্য!” রিমিতা দাঁতে দাঁত ঘষে বলে, “দু’-দুটো মানুষ রিসর্টের মধ্যে মারা পড়লেন বেঘোরে, আর উনি কি না সেক্স নিয়ে ভাবছেন! তোমার মনে কি সিমপ্যাথি বলে কিছু নেই? তুমি কি পাথর?”
“যা ব্বাবা! যাদের চিনি না, জানি না, জন্মেও দেখিনি, এমনকি মরে যাওয়ার পরেও দেখিনি, তাদের জন্য সিমপ্যাথেটিক হতে যাব কেন?”
“সেটাই!” কপট রাগে রিমিতা মুখ বন্ধ করল। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না এখন পূষণের সঙ্গে। তখনই পূষণ জিজ্ঞাসা করল তাকে, “হ্যান্ডু গোয়েন্দা কী জিজ্ঞাসা করল তোমায় গো?”
রিমিতা জবাব দিল না। সে ভেবেছিল, মামার খাতিরে গোয়েন্দা লোকটি তাকে কিছু জিজ্ঞাসা না করেই ছেড়ে দেবে। কিন্তু তা হয়নি দেখে অবাক হয়েছিল। আরও অবাক হয়েছিল যখন সারা ইন্টারোগেশন সেশনে একবারও গোয়েন্দাটি তার মামার নাম জিজ্ঞাসা করেনি। মামার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন, তাও জানতে চায়নি। বরং তারা কখন রওনা হয়েছিল, কোথায় ট্রেন লেট করেছিল, স্টেশনে কখন পৌঁছেছিল—এই সব জানতে চেয়েছিল প্রথমে। তারপর বাসরুটের ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন করল। সে অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে যে, যেহেতু আগাগোড়া সে বাসেই বসেছিল, অতএব কী ঘটেছে বা অকুস্থলে কারা কারা ডেডবডির পাশে ছিল সে জানে না। তবে পুলিশ তাকে খুব হ্যারাস করেছিল কাল, তখনই সে মামাকে টেক্সট মেসেজ করে। তার কিছুক্ষণ পরেই পুলিশের ব্যবহার বদলে যায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫০: পূষণের কথা

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-১৫: নীলাঞ্জনা চায় সামাজিক স্বীকৃতি

শাক্য বলল, “আচ্ছা, আপনাদের যখন পুলিশ এখানে পৌঁছে দেয়, তখন নীচে একটা পার্টি চলছিল, নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন?”
“তেমন করে নয়। কিছু একটা চলছিল। তবে পার্টি বলে মনে হচ্ছিল না। কেমন যেন শ্মশানের স্তব্ধতা ছিল চারিদিকে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। তবে যেহেতু কাউকেই চিনি না, কারও সম্পর্কেই আলাদা করে কিছু বলতে পারবো না।”
“অনিলকে আপনি চিনতেন না, ওদের কাউকেই চিনতেন না, ফলে আলাদা করে ওদের ব্যাপারে আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাও করবো না। কিন্তু সুবল, তাকে চিনতে ?”
“কে সুবল?”
“এই রিসর্টের রুম-অ্যাটেন্ডেন্ট। নতুন যারা আসে, তাদের এবং তাদের লাগেজকে রুমে এউমে পৌঁছে দেওয়াই তার কাজ। বিনিময়ে টিপস্‌-ফিপস পায় বলেই তার আগ্রহ ছিল। আজ অনিল ছাড়া দ্বিতীয় যে ব্যক্তি ব্রুটালি মার্ডার হয়েছে, সেই হল সুবল।”
“তাহলে হয়তো দেখেছি। একজন আমাদের রুমে পৌঁছে দিয়েছিল। ওয়াশরুমে জল ঠিক্টহাক আসছে কি না চেক করে দিয়েছিল, আমাদের জন্য বারণ সত্ত্বেও পর্যাপ্ত খাবার দিয়ে গিয়েছিল। সেই সুবল হলে ভারি কাজের লোক বলতে হবে। মানবিকও। না হলে অমন থালা ভরে খাবার রেখে তা ঢেকে রেখে যেত না সে! আহা, ভারি খারাপ লাগছে এখন! আচ্ছা কী করে মারা গেল?”
“কেন আপনি শোনেননি?”
“নাহ্‌!”
“কালাদেও মেরেছে!” কথাটা বলে শাক্য রিমিতার প্রতিক্রিয়া দেখতে চাইছিল। কিন্তু তার মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়াই ছিল না।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬১: ‘বন্ধু’ তোমার পথের সাথী

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৮: রামায়ণে বনবাসযাপন সিদ্ধান্তে অনমনীয়া সীতার কণ্ঠে কী আধুনিকতার সুর?

রিমিতা বলল, “কাল পূষণ একটা গল্প শোনাচ্ছিল বটে। সেই কালাদেওই না কি বাস রাস্তায় সেই লোকটিকে মেরেছে। সে না কি উপড় হয়ে শুয়ে শুয়ে লোকটির মাথা চিবুচ্ছিল, এই অবস্থায় বাসটি গিয়ে পড়ে। তবে এখানে জঙ্গল এলাকা তো, ফলে রাতে অদ্ভুত আওয়াজও শুনেছিলাম। কোনও বুনো জন্তু হতে পারে। তবে খুব টায়ার্ড ছিলাম বলে সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারেন!”
“ঘুমের ঘোরে কোনও আওয়াজ বা অদ্ভুত কোনও শব্দ শোনেননি?”
“নাহ্‌। বললাম না, এত টায়ার্ড ছিলাম যে চোখ খোলা রাখতে পারছিলাম না চেষ্টা করেও।”
“আচ্ছা, একটা কথা বলুন, কাল যখন বাসে আসছিলেন, তখন বাসটি কি হেডলাইট অন করে চলছিল?”
“খেয়াল করিনি। তবে অন করার কথা নয়। চারপাশে আলো ছিল ভালোই। পাখিরা বাসায় ফিরছিল। জঙ্গল জুড়ে তাদের কিচিরমিচির শুনছিলাম। এই অবস্থায় কেউ কেন হেডলাইট জ্বালবে?
“তা ঠিক। কিন্তু যখন ঘটনাটি ঘটে, তখন তো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল?”
“মনে হয় না, হেডলাইট জ্বলছিল কারণ, ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমার এখন খেয়াল পড়ছে যে, বাসের ভিতরের আলোও তখনও জ্বালানো হয়নি!”
“অথচ সেই অবস্থাতেই খালাসি কীভাবে যে কালাদেওকে দেখতে পেল!” আপনমনেই বলল শাক্য।
“আচ্ছা, ওই লোকটি কে তা জানতে পারা গেল?”
“পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসুক। তারপর ভালো করে তত্ত্বতালাশ করতে হবে। ওদের গ্রুপে আর্য বলে একজন নিরুদ্দেশ, তার লাশও হতে পারে। দেখা যাক, আজ তো শুনলাম ওনাদের মর্গে গিয়ে সনাক্ত করার কথা!”
সুদীপ্ত বলল, “সাতসকালে পুরানা মোকামের জঙ্গলে যেতে গিয়ে স্যার কোনও কিছুই হল না আজ!”
“হবে। আফটার ইন্টারোগেশন সেশন, ওদের কাউকে কাউকে নিয়ে গিয়ে ওই কাজটা করে ফেলতে হবে। ভিকটিমের পরিচয় জানতে পারলেই কেস অনেকটা সলভ্‌ হয়ে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস!”
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১৭: শোকস্তব্ধ কবি সারারাত ছাদে পায়চারি করেছিলেন

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩১: শ্রীমার পঞ্চতপা ব্রতানুষ্ঠান

রিমিতা বলল, “আমাকে আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?
“ওই যে, এক্ষুনি যেটা জিজ্ঞাসা করলাম, তেমন কিছু জানা থাকলে বলতে পারেন, নতুবা নয়। আপনি কি কাল কোণ আনন্যাচারাল সাউন্ড, কথাবার্তা ইত্যাদি শুনেছেন যা এই কেসে কাজে আসতে পারে?”
“নাহ্‌!”
“কারও কোনও ব্যক্তিগত কথা কিংবা কথা-কাটাকাটি?”
“এসব শুনতে হলে যে সময় দরকার তা কোথায় পাবো? কাল যা বিধ্বস্ত অবস্থায় পৌঁছেছি!”
“আচ্ছা। ঠিক আছে। আপনি আসতে পারেন।”
‘ধন্যবাদ’ জানিয়ে উঠে পড়েছিল রিমিতা। বেরিয়ে যাবে রুম থেকে, এমন সময় হঠাৎ কী মনে পড়ায় ঘুরে এল, শাক্যর সামনে নীচু হয়ে টেবিলে দু’-হাত রেখে বলল, “একটা কথা। অবশ্য কোন কাজের কথা নয়। ওই যে আপনি বললেন, কারও কোনও ব্যক্তিগত কথা শুনে ফেলেছি কি না, তাহলে বলি, কাল ওই সুবল বা আর কেউ রুমে নিয়ে যাচ্ছিল যখন, তখন সিঁড়ি অন্ধকার ছিল। লোডশেডিং চলছি। তা সুবল মোবাইলে টর্চ জ্বেলে উপরে উপরে উঠছে, তারপরে পূষণ, শেষে আমি। ওরা উঠে গিয়েছে, আমি আস্তে আস্তে উঠছিলাম, এমন সময় কানে এল কেউ যেন কাউকে বলছে, ‘দিতে তো চাই, কিন্তু তোমার সময় হলে তো? সেই শুনে আর একজন কেউ বলল, বেশ, আজকেই তবে দিও!’ ব্যস আর কিছু শুনিনি!”
“মহিলা না পুরুষ কণ্ঠ?”
“আমার ঠিক স্মরণ নেই!”
“আচ্ছা আসুন, আমি আপনার মামাকে জানিয়ে দেবো কিংবা আপনিও জানাতে পারেন!”
“হুঁম্‌” বলে রিমিতা বেরিয়ে যায়।—চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content