মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ : সৌমি দাসমণ্ডল।

উন্মেষা তার রুমে ফিরে ক্লান্ত শরীরে রুমে রাখা গদি আঁটা চেয়ারটায় গা এলিয়ে দিল। অঞ্জনও তার সঙ্গে সঙ্গেই রুমে ঢুকেছিল। সে বলল, “কী হল? ওরা কি তোমায় খুব হ্যারাস করেছে স্যুইটহার্ট?”
উন্মেষা জবাব দিল—না। সে ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল।
অঞ্জন বলল, “তুমি চিন্তা করো না। আমি আমার ল-ইয়ারের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বলেছেন, ব্যবস্থা করছেন। খুব তাড়াতাড়ি আমরা কলকাতায় ফিরে যাব। ওই পেটি গোয়েন্দা কিস্যু করতে পারবে না!”
উন্মেষা এ বার চোখ খুলল। বলল, “আমি কলকাতায় ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল, ঠিক কথা। কিন্তু তার কারণ এই নয় যে, ওই গোয়েন্দা অফিসার আমাকে হ্যারাস করেছেন! উনি তো ইন্টারোগেট করবেনই। অনিলের আনন্যাচারাল ডেথকেও তো মেনে নেওয়া যায় না, কী বলো?”
“সেটা ঠিক। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, অনিলকে কে হত্যা করলো? কালাদেও বলে যা বলা হচ্ছে, সে যদি থেকেও থাকে, তাহলে এত জনের মধ্যে অনিলকে কেন সে বেছে নিল?”
“ভুলে যাচ্ছ কেন? কেবল অনিল নয়, রিসর্টের একজন ওয়ার্কারও একই সঙ্গে খুন হয়েছেন!”
“তাকে আমরা চিনি না। সে আমাদের বন্ধুও নয়, কেন যে তার ডেথ নিয়ে আমি ভাবছি!” অঞ্জন বলল।
“আমরা তাকে চিনি। আমাদের রুমে পরশু যে পৌঁছে দিয়েছিল জিনিসপত্র। এমনকি ওয়াশরুমে গিজারটা কাজ করছিল না বলায়, দেখে ঠিক করে দিয়ে গিয়েছিল, এ সেই লোকটি। আমি খোঁজ নিয়েছি। তোমার মনে নেই, আমি তার নাম জিজ্ঞাসা করায়, সে বলেছিল, তার নাম সুবল। আজ যে ওয়ার্কার খুন হয়েছেন, সে ওই সুবলই!”
“ওহ্‌!” অঞ্জন কোনও আগ্রহ দেখাল না।
“অনিল আর সুবলের একই দিনে মৃত্যু পুলিশকে ভাবাচ্ছে। বুঝলে!”
“তাদের কাজই হল ওই নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা, তারা ভাবছে। কিন্তু তোমাকে কী প্রশ্ন করল, বললে না?”
“প্রশ্ন তো অনেক কিছুই করেছে। তোমাকেও করেছে, আমি কি জানতে চেয়েছি? আর ওই প্রশ্নোত্তর সেশন নিয়ে কথা না বলাই ভালো!”
“আমাকে তোমার আর আমার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন করছিল ওই ব্ল্যাডি অফিসার!”
“আমাকেও করেছে!”
“ওর সাহস কী করে হয় এইসব পারসোনাল ম্যাটার নিয়ে আস্ক করার?”
“দেখ, এই প্রশ্নটা উঠবেই। এই কারণে তোমার সঙ্গে এক রুম শেয়ার করতে আমি রাজি ছিলাম না। কিন্তু এখন যখন করেই ফেলেছি, তখন এই সমস্ত প্রশ্নকে ফেস করতেই হবে! আর উনি কেবল তোমার কথা আস্ক করেননি, আমার হাজব্যান্ডের কথাও জানতে চেয়েছিলেন। আমার যা বলার আমি বলেছি।”
“এই কেসের সঙ্গে ওনার কী সম্পর্ক? উনি তো অনেকদিন হল গত হয়েছেন!” অবাক হয়ে প্রশ্ন করল অঞ্জন।
“এমনি কৌতূহল। আসলে ওঁরা হয়তো বুঝতে চাইছিলেন যে, তোমার সঙ্গে আমার অ্যাফেয়ারটা তার আগে থেকে কি না!”
“রাবিশ!”
“আচ্ছা অঞ্জন, তুমি ওঁকে বলেছ যে, আমিই কোন ব্লগ দেখে এই পিশাচ পাহাড় ট্যুরিস্ট স্পটের ব্যাপারে সবাইকে জানাই?”
“হ্যাঁ বলেছিলাম। কেন তাতে অন্যায় হয়েছে?”
“অন্যায় বলতে তুমি ভুল তথ্য দিয়েছিলে। ওঁরা বিভ্রান্ত হতে পারতেন। তবে আমি সামলে নিয়েছি। তুমি সম্ভবত জানো না, ওই ব্লগের লেখাটির ব্যাপারে অনিলই আমাকে ফার্স্ট জানায়। যদিও তখন তোমার ব্যাপারে সে বা আর কেউ ভাবেনি। সবাই চেয়েছিল ওল্ড ফ্রেন্ডসরা মিলে একটা রি-ইউনিয়ন করতে, পরে তুমি ইনক্লুড হও! আমি সেটাই বললাম। এই আর কী!”
“স্যরি। হতে পারে এটাই ঘটেছিল। কিন্তু আমি ঠিক জানতাম না। আমার যেন মনে ছিল, তুমিই এখানকার ব্যাপারে সবাইকে ইনফো দাও! স্যরি স্যুইটহার্ট, অ্যা’য়াম এক্সট্রিমলি স্যরি!”
“ইট’স্‌ ওকে! আমাকে একটু একা থাকতে দাও অঞ্জন। আমি অনিলের ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না!”
“তোমার শরীর খারাপ লাগছে? ডাক্তারকে কল করতে হবে? তাহলে কাপাডিয়াকে বলবো। সে নিশ্চয়ই লোকাল ডক্টরকে কল করে আনতে পারবে!”
“নাহ্‌! ডক্টর ডাকার মতো নয়। একটু একা থাকি, তাহলেই ঠিক হয়ে যাব। অনিলের এই ভাবে চলে যাওয়া একটা ধাক্কা তো!”
“ঠিক আছে। অ্যাজ ইউ উইশ্‌। তুমি রেস্ট নাও। আমি একটু বাইরের বাগানে গিয়ে বসি। মাথায় চুরুটের ধোঁয়া না দিলে মাথা কাজ করবে না!”
“হুম্‌!” আনমনে বলল উন্মেষা। অন্যসময় হলে অঞ্জনকে এই সব কড়া হাভানা চুরুট না খাওয়ার জন্য বকাঝকা করত কিংবা উপদেশ দিত, এখন কিছু বলল না। অঞ্জন অবশ্য অবাক হল না, অনিলের মৃত্যু নিয়ে আপসেট আছে উন্মেষা। এই অবস্থায় স্বাভাবিক ব্যাপারগুলি তার মনে না-থাকারই কথা। সে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল।
উন্মেষা চোখ বন্ধ করে ইন্টারোগেশনের কথা ভাবছিল। অনেককাল পরে কেউ হিরণ্ময়ের কথা জানতে চাইল তার কাছে। হিরণ্ময়! হিরণ্ময়! তার জীবনের সত্যিকারের প্রেম। পুরুষের কামুক মুগ্ধতা দিয়ে নয়, যে তার ভিতরটাকে ভালোবেসেছিল। তখন সে ছিল বিপর্যস্ত। জীবনের সেই বিভীষিকাময় রাতটির কথা সে কখনও ভুলতে পারবে না। অনিল, আর্য, অরণ্য, আর একজন ছিল—তারা চার জনে মিলে পার্টিতে তাকে মাদক মেশানো পানীয় খাইয়ে সারা রাত ধর্ষণ করেছিল।

পরের দিন সকালে নিজেকে সে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল হোটেলের সেই শূন্য রুমে। ও সবাইকে কল করেছিল, কেউ ফোন ধরেনি। লজ্জায় কাউকে সে-কথা বলতে পারেনি। কোনওরকমে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে সে সোজা চেনা এক ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। তাঁকেও যে সব সত্য বলেছিল তা নয়। তিনি ভেবেছিলেন, অতিরিক্ত উত্তেজনাবশত রাতারাতি কয়েকবার সঙ্গমের ফলে এই অবস্থা। তিনি অবশ্য ডাক্তারি এথিকস্‌ মেনেই তার বাড়িতে কিছু জানাননি। তবে তাকে উপদেশ দিয়েছিলেন, ইন ফিউচার এইরকম এক্সপেরিমেন্ট না করতে। ভ্যাজাইনা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তার। বাড়ি ফিরে শাওয়ারের তলায় নিজেকে ধুয়ে ফেলতে চাইছিল সে। নিজের শরীরকেই তখন ঘেন্না করছিল তার।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৪৮: আদিম অরণ্যের আগন্তুক

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩১: সুন্দরবনের ঐতিহ্য গঙ্গাসাগরমেলা ও কপিল মুনির আশ্রম

মা যে জিজ্ঞাসা করছিলেন, কাল সারারাত সে ফেরেনি কেন, আজ এত বেলাই বা হল কেন—সে সব প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় সে ছিল না। আর জবাবটাই বা কী দিত? তার এতকালের চেনা ব্যাচমেটরা সকলে মিলে তাকে গ্যাংরেপ করেছে—এটাই বলত? একবার সে ভেবেছিল, ওদের সকলের বাড়ি গিয়ে চার্জ করতে, কিন্তু নিজেই ভয়ে সে পিছিয়ে গিয়েছিল। ওদের অ্যাকিউজ করা মানেই তো থানা-পুলিশ, কোর্ট কাছারি। তার চেয়েও বেশি সমাজের থেকে জোটা অপমান! উন্মেষা চিরকালই একটু রিজার্ভড্‌। কখনও বন্ধুদের কারও বাড়ি যায়নি। আর আজ এই অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াতে তার লজ্জা করছিল। আসলে এই সুযোগটাই পুরুষেরা নেয় চিরকাল। মেয়েদের লজ্জা! সমাজ সব শুনবে, তারপর কলঙ্ক যা দেওয়ার দেবে নারীকেই। পুরুষ যত বড় অপরাধই করুক না কেন, ধর্ষণের লজ্জা নারীকেই সহ্য করতে হয়, তাদের গায়ে ছিটেটিও লাগে না।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২৭: তার লাগি পথ চেয়ে আছি পথেই যে জন ভাসায়

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-১০: ভালোবাসার অবুদাদু

যন্ত্রণার এই সময়ে হঠাৎ যেন দেবদূত হয়ে দেখা দিয়েছিল হিরণ্ময়। মুখচোরা-লাজুক ছেলেটি তার কাছে এসেছিল একটা ব্যাপারে। সেই সময়েই সে বুঝে যায়, উন্মেষা ঠিক স্বাভাবিক নেই। নাহ্‌, সে জোর করেনি, কেবল তার দুঃখটা শেয়ার করে নিতে চেয়েছিল। আস্তে আস্তে তাকেই সবটা বলে উন্মেষা। সে ভেবেছিল, এ সব শোনার পরে হিরণ্ময় তাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু না, বরং সে কেয়ারিং অনুভবী প্রকৃত বন্ধুর ভূমিকায় দেখা দিয়েছিল। আস্তে আস্তে তার মনের ক্ষত সারিয়ে তুলেছিল। তারপর কেটে গিয়েছে অনেকগুলি বছর। ওই ঘটনার পরে অনিল, অরণ্য এদের সঙ্গে বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল তার। ওরা অবশ্য এসেছিল কথা বলতে। লোক দেখানো ক্ষমাও চেয়েছিল। বলেছিল, ওটা একটা ফান ধরে নিয়ে ভুলে যেতে, কিন্তু সব ক্ষতের কি শুশ্রূষা হয়? এও তেমনই এক নিরাময়হীন ক্ষত। হৃদয়ের গভীরে জেগে থাকে, বাইরে থেকে কেবল বুঝতে পারা যায় না।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল উন্মেষা। হিরণ্ময় তাকে তড়িঘড়ি বিয়ে করে নিয়েছিল। বাড়িতেও ব্যাপারটায় অবাক হয়েছিল সবাই। যে মেয়ে বিয়ের চেয়ে কেরিয়ার নিয়ে আগ্রহী ছিল, সে হঠাৎ নিজে থেকে বিবাহ করতে চাইলে অবাক তো হবেনই সকলে। তবে মা খুশি হয়েছিলেন। দুই দাদাও। বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে মানে তাদের লাইন ক্লিয়ার। আর তাছাড়া হিরণ্ময় ক্যাম্পাসিংয়ে ভালো জবের অফার পেয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া প্রায় ঠিক। এমন শাঁসালো জামাই, তার উপর যে কি না বলেছে কোন পণ নেবে না, রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করবে কেবল, তাতে বাড়ির সকলে আরও খুশি হয়েছিল। মেয়ের বিয়ের খরচ বেঁচে যাওয়ায় মা-ও কম খুশি হননি। হিরণ্ময়ের মা হিরণ্ময়ের ছোটবেলাতেই গত হয়েছিলেন। হিরণ্ময়ের বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। তবে ছেলের কোনও কিছুতেই তাঁর কোন আপত্তি ছিল না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৯: আবার পুরী ভ্রমণ

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৪৬: যুগান্তরেও সম্মানিতা হন সীতা, তাঁর বনবাস গমনের সিদ্ধান্তে কী তার কোনও প্রভাব আছে?

হিরণ্ময়ের বাবা বেসরকারি চাকুরি করতেন মোটা মাইনের। সারা জীবন নিজেই ছেলের মা এবং বাবার ভূমিকা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন। ছেলের বিবাহে তিনি খুশিই হয়েছিলেন। বাবা-ছেলের সংসারে তৃতীয় একজন আসছে—তা-ও আবার উন্মেষার মতো সুন্দরী বৌমা—তিনি আপত্তি করবেনই বা কেন? তবে উন্মেষার বিয়ের পর বেশিদিন বাঁচেননি তিনি। হঠাৎ করেই সিভিয়ার হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তারবাবু আসার আগেই তিনি চলে যান। চলে যাওয়ার আগে যথেষ্ট ব্যাঙ্ক ব্যালান্স রেখে গিয়েছিলেন ছেলের জন্য। অবশ্য হিরণ্ময় লেখাপড়ায় বরাবরই ভালো ছেলে। বাবার টাকা না থাকলেও সে নিজেকে ভালোভাবেই চালিয়ে নিতে পারত তখন। বৌকে কলকাতায় রেখে সে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল। কথা ছিল, ওখানে জব জয়েন করে গুছিয়ে নিয়ে তারপর উন্মেষাকে নিয়ে যাবে। তার আগে নিজের ও বাবার সমস্ত টাকাকড়ি উন্মেষার নামে আলাদা অ্যাকাউন্ট খুলে সেখানে ট্রান্সফার করেছিল ভাগ্যিস। তা না হলে, আজ কী হত উন্মেষা ভাবতেই পারছে না। প্লেন ক্রাশের খবর পেয়ে সে একেবারে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর সে যে কীভাবে আজকের উন্মেষা হয়ে উঠল, তা এক ইতিহাস।

কোনওদিন ভাবেনি অনিলদের সঙ্গে আর সে কথা বলবে। কিন্তু…! নাহ্‌, এখন সে এসব আর ভাবতেও চায় না। এখন তাকে নিজেকে সামলে চলতে হবে। উঠে পড়েছিল সে। চোখে মুখে জল দেবে কিংবা শাওয়ারের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। পাপ-পুণ্য সব জলে ধুয়ে যায়— সে বিশ্বাস করে।

এমন সময় ফোন বাজল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সে। চেনা মানুষের ফোন। রোজ আসে নিয়ম করে। সে ফোনটা ধরল। তার মুখে তৃপ্তির হাসি। আপনজনের ফোন পেলে মনের ভিতরটা এক নিমেষে বদলে যায়। —চলবে।
* ধারাবাহিক উপন্যাস (novel): পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক (Pishach paharer atanka) : কিশলয় জানা (Kisalaya Jana) বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজ।

Skip to content