বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ঘোমটা (ক্রমশ)

লন্ড্রি থেকে ছেলেটা এসেছিল জামা কাপড় দিতে। তাকে দেখে হঠাৎ করে বাবু জিজ্ঞেস করল—
— আরিফ রোডের যে বুড়ো ইস্ত্রিওয়ালা ওকে চেনো?
— হ্যাঁ জরুর আমার মৌশাজি আছেন। মানে আমার মাসির হাসবেন্ড হলেন।
— ওখানে রোজ বসেন।
— হ্যাঁ একদম শুভে চার বাজে সে দশ বাজে। তারপর ওঁর ছেলে বসে।
— আজ তো কেউ বসেননি। বন্ধ ছিল।
— জানি মৌশাজির তবিয়ৎ ঠিক নেই। আজ সকালে গিয়েছিলেন কিন্তু পরে ফিরে গিয়েছেন।
— কেন?
ছেলেটা একটু ইতস্তত করে।
— না, মানে আমি ঠিক
— তুমি যদি কিছু জানো আমায় বলতে পারো
— যে মা-জি মারা গেছেন ওনাকে মৌশাজি ভোরের বেলা জানালায় দেখেছেন!
— তুমি তো বাড়ি চেনো। আমায় নিয়ে যাবে? আসছি আমি।
শ্যামলাল যাদব এখন ৬৯ বছরের প্রৌঢ়। সংসার চালানোর জন্য তাকে ভোরবেলায় উঠে ইস্ত্রি করতে হয় না। বড় ছেলে কর্পোরেশনে কাজ করে। মেজো ছেলের ইলেকট্রিক এর দোকান আছে। ছোট ছেলেটা বেলা থেকে দুপুর পেরিয়ে বিকেল পর্যন্ত ইস্ত্রি করে। শ্যামলাল যায় ভোরবেলা। শরীর ঠিক রাখার জন্য কাজ করে। ইস্ত্রি করতে শরীরের তাকৎ লাগে। তাতে রোজগারটাও হয়ে যায়। শ্যামলাল বলে বাড়িতে বসে গেলে রোগে ধরে নেবে। বাবার যুক্তিটা ছেলেরা মেনে নিয়েছে। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ওই ইস্ত্রির গুমটি চালাচ্ছে রামরাল যাদব। তারা বাধা দেয় না। দাওয়াই চৌকি পেতে বাবুকে বসিয়ে কথা বলছিলেন শ্যামলাল যাদব। কৌতূহল মেটাতে বাবু জিজ্ঞেস করল অত ভোরে কে আসে ইস্ত্রি করাতে? উত্তরের শ্যামলাল হাসে। এটা তো স্পেশাল সার্ভিস। কত লোকের কাজের চাপে জামা কাপড় ইস্ত্রি থাকে না। স্কুল আছে চাকরির ইন্টারভিউ আছে ব্যবসার কাজ আছে সকালবেলায় বেরোতে হবে। জামাকাপড় ইস্ত্রি নেই। আশপাশে সকলে জানে একদম কাকভোরে রামলালের দোকান খোলা আছে। পয়সা বেশি লাগবে কিন্তু কাজটা হয়ে যাবে।
আরও পড়ুন:

হ্যালো বাবু! পর্ব-৪: উষ্মা প্রকাশ করে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেল বিপুল পালের জিপগাড়ি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২১: শ্রীমার ঠাকুরের প্রতি যত্ন

ছাতুর শরবতে চুমুক দিতে দিতে ধৃতিমান চৌধুরী ভাবে এই হল বিজনেস স্পেশালাইজেশন। তবে এই পুরো ভূমিকাটা আসল প্রশ্নটা করার জন্যে। শ্যামলালের সঙ্গে একটু ঘনিষ্ট হবার জন্য।
—আজ ভোর বেলায় কি আপনি সুষমা দেবীকে জানলায় দেখে ছিলেন?
ভয়ংকর চমকে ওঠে প্রৌঢ় শ্যামলাল। চাতুর শরবত খাওয়া কাঁসার গ্লাসটা হাতে ধরা ছিল ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ে গেল। অবস্থা দেখে বাবু একটু বিব্রত হয়ে পড়ল।
—না, মানে আমি।
শ্যামলালের স্ত্রী সেকেলে মানুষ তিনি সামনে আসেননি। কিন্তু এই ঘটনাটার পরেই ভেতর থেকে তার বড় পুত্রবধূকে ডেকে পাঠালেন । বউমারা বেশ আধুনিক। তারা কলকাতাতেই ছোট থেকে বড় হয়েছে স্পষ্ট ঝরঝরে বাংলা বলে। বড় পুত্রবধূ এসে বললেন—
—এ নিয়ে আপনি ওনাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করবেন না। বয়স্ক মানুষ এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে উনার শরীর খারাপ হয়েছে তাই আজ কাজ থেকে ফিরে এসেছেন। আমার শাশুড়ি মা মানা করছেন।
—আমি দুঃখিত।
কিন্তু পরে শ্যামলাল সবটা বললেন আর তার পরেই ধৃতিমানের মনে হলো রহস্যটা এবার ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। শ্রেয়া বাসুকে একটা বাঙলা টেক্সট করল সে। মাত্র একটাই লাইন। “ সুষমা করের মৃত্যুর সঠিক সময় জানাটা খুব জরুরি”।
বহুদিন একসঙ্গে কাজ করছে। তাই এই একটা লাইনের গুরুত্ব শ্রেয়া নিশ্চিত বুঝতে পারবেন।
বুবুকে ফল কেটে প্লেটে সাজিয়ে দিল। খাবার টেবিলে ওরা একসঙ্গেই খেতে বসে। তফাৎ একটাই। বাবুর চেয়ারে বসে টেবিলে প্লেট রেখে খায়। আর বুবুর প্লেটও টেবিলে থাকে কিন্তু বুবু টেবিলে বসেই খায়। বাবু খাওয়ার সময় কথা বলা পছন্দ করে না। বুবু খেতে খেতে অনবরত কথা বলে।
—বাবু!
এই “বাবু” কথাটা বলারও নানা রকমফের আছে। কখনও খুব তাড়াতাড়ি। কখনো একটু টেনে আদেশের সুরে। খাওয়ার সময় সেটাই শোনা যায়
—বাবু! খেয়ে নে! খেয়ে নে বাবু! খা খা খা! খেয়ে নে! ধরে ধরে খাও!
—আঃ বুবু! এত বকবক করছিস কেন?
বাবুর হালকা ধমকে কোনও কাজ হয় না, উলটে তাকেই শুনতে হলো
—চেঁচাচ্চিস কেন বাবু? চেঁচাচ্চিস কেন?
বাবু তাকাল। এতে বোধহয় কাজ হলো। বুবু খেতে খেতে বিড়বিড় শুরু করল
—বুবু খেয়ে নাও! খেয়ে নে বুবু! খেয়ে নে!
এতো নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫২: সব ঘরই ‘তাসের ঘর’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২৩: সুন্দরবনে কুমিরের দেবতা কালু রায়

গতকাল। মানে সুষমা করের মৃত্যুর আগের দিন। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। সুষমার ছেলের বউ বিউটি সকালবেলায় কাজে গিয়েছিল। বিউটি হাওড়া স্টেশনের খুব কাছে একটি কলেজের কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির অ্যাটেনডেন্ট-এর কাজ করে।নিয়মিত কাজে গেলেও কাজটা অস্থায়ী কর্মীর। মুচিবাজার থেকে হাওড়া স্টেশন যাওয়ার অনেক বাস। এসি নন এসি প্রাইভেট মিনিবাস। যাতায়াতের কোন অসুবিধা নেই। ছেলে পল্লবের রেন্টাল কারের বিজনেস। লেকটাউনে বিউটির বাপের বাড়ি। মাঝেমাঝেই যায়। সুষমা যেদিন ভোরে মারা যান তার আগের দিন বেশ একটু রাত করেই পল্লবের ব্যবসার গাড়ি নিয়ে ওরা বাগুইহাটি চলে গিয়েছিল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব ৪৭: শীতকালে দই খেতে নেই?

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১৫: দিল মেরা বানজারা!

রাতে খাওয়াদাওয়া করে গিয়েছিল। কাজের মাসি মলিনা রাতে বাড়িতে ছিল। বাইরে থেকে বাড়িতে আসার পুরনো দু’ পাল্লার সদরদরজার বদলে এক পাল্লার ডোর লক লাগানো দরজা হয়েছে। এত বছরে এই একটাই পরিবর্তন। সদর দরজা দিয়ে উঠোনে ঢুকে ওপরে ওঠার সিঁড়ির মুখে একটা কোলাপসিবল গেট তাতে চাবি দেওয়া। সদর দরজা আর ওই কোলাপসেবল গেটের তালার জোড়া চাবি। সে দুটো চাবি থাকে বিউটি আর পল্লবের কাছে। ভাড়ার গাড়ির হিসাবপত্র মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত্তির হয় পল্লবের। তখন কে গিয়ে কলাপসেবল গেট খুলে সদর দরজা খুলবে? তাই একটা চাবি পল্লবের কাছে। তার মানে চাবি দিয়ে দরজা এরা দু’জনেই খুলতে পারে। হাতের ছাপ থাকবে না। করোনার পর মুখঢাকা মাস্ক আর হাতঢাকা গ্লাভস এখনও ঘরে ঘরে জমা আছে।—চলবে।
* হ্যালো বাবু! (Hello Babu) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ২য় খণ্ড।

Skip to content