বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


 

অডিয়ো ক্লিপ (অন্তিম পর্ব)

এরপর নীলাঞ্জন যা বলল তার জন্য দুবেজির মতো ধৃতিমান বা শ্রেয়া দু’জনেই তৈরি ছিল না।
—এক মিনিট মিস্টার দুবে! আপনিও একটা কথা জেনে যান, হ্যাঁ আমি কলকাতায় থাকার মতো মানসিক অবস্থায় নেই। কিন্তু সুচেতা খুনের কোনও সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি কলকাতা ছাড়ব না। আমি বুঝতেই পারছি না, আমার কলকাতা ছেড়ে যাওয়া নিয়ে আপনারা এতও ব্যতিব্যস্ত হচ্ছেন কেন? এত টাকা দিয়ে আপনারা যে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছেন সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার আছে।
—শুনুন মিস্টার রয়, বললাম তো আমরা আপনার সেফটি চাই!
—আমরা মানে কারা?
—ডোন্ট ইনসিস্ট মি টু বি ইনসেনসিটিভ অ্যান্ড রুড!
—ডোন্ট ট্রাই টু থ্রেট মি মিস্টার দুবে! আমায় ধমকে লাভ হবে না।
—সরি মিস্টার রয়। আই অ্যাম ভেরি সরি। আমি জানি ইউ আর স্ট্রেসড। চলি।
উত্তরে নীলাঞ্জনের কোনও কথা কানে এল না। দরজা বন্ধের শব্দ পাবার পরও কয়েকটা মূহুর্ত অপেক্ষা করে ধৃতিমান আর শ্রেয়া ভিতরের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। নীলাঞ্জন চুপ করে সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছে।

এর মধ্যে একটা সাঙ্ঘাতিক সূত্র পাওয়া গিয়েছে। শ্রেয়ার মোবাইলে মেসেজ মারফৎ জানা গেল, সেই ঘাতক লরি তাঁর ড্রাইভার ক্লিনার সমেত ধরা পড়েছে। ধরা পড়েছে ডানকুনিতে। তার মানে লরি নিয়ে ড্রাইভার ক্লিনার কোথাও পালায়নি। ডানকুনি পৌঁছে এতদিন লুকিয়ে ছিল। জায়গাটা ডানকুনি টপকে চাকুন্দি’র কাছে একটা পেট্রল পাম্পের পিছনে একটা গোডাউনের মধ্যে। গাড়ির আরএফআইডি কোডের সামান্য ছবি থেকে বিশেষ কারিগরি দক্ষতায় গাড়ির সমস্ত ডিটেইল খুঁজে পেতে বেশ সময় লেগেছে ঠিকই, কিন্তু গাড়িটাকে ভ্যানিশ করে দেওয়া যায়নি।

কিন্তু তদন্তের স্বার্থে এই খবর অত্যন্ত গোপনীয় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাই ইচ্ছে থাকলেও ভেঙে পড়া নীলাঞ্জনকে খবরটা দেওয়া গেল না। গোপনীয়তার স্বার্থে এই ড্রাইভার ক্লিনারকে জেরা করার জন্য এখনও সরাসরি গ্রেফতারি দেখানো হয়নি। তাদের গোপন ডেরায় নিয়ে গিয়ে জামাই আদর করার প্রস্তুতি চলছে। যেটা খুবই উৎসাহজনক খবর সেটা হল পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগের মুহূর্তে ড্রাইভার রাজু খান তার হাতের মোবাইল টয়লেটের ফ্ল্যাশট্যাঙ্কে ডুবিয়ে দেওয়ার আগেই টয়লেটের দরজা ভেঙ্গে পুলিশের দল তাকে গ্রেফতার করেন। আর এই দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন বালি থানার সেই শেখর সরখেল। তার মানে সুচেতা বিচার পাবে।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৬৩: বেলুড়মঠে শ্রীমায়ের অভিনন্দন

দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-৩৯: ভারতের বিপ্লবী মেয়েরা এবং অন্তরে রবীন্দ্রনাথ

শ্রেয়া ততক্ষণে মাইক খুলে নিয়েছে। হঠাৎ নীলাঞ্জন বলে উঠল—
—সে রকম তো কিছুই বলল না! আমি একটু রাগিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু তাতেও বিশেষ লাভ হল না।
নীলাঞ্জনকে দেখে বেশ অবাক লাগলো ধৃতিমানের। শ্রেয়া বলে উঠল—
—এই অডিয়ো ক্লিপ কীভাবে কখন কাজে লাগবে আমরা জানি না।
শ্রেয়া কথাটা খুব সহজভাবেই বলেছিল, কিন্তু শ্রেয়ার কোনও একটা কথা নীলাঞ্জনকে যেন কিছু সূত্র দিয়ে গেল।
নীলাঞ্জন দাঁড়িয়ে উঠে শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল—
—আপনি যে কথাটা বললেন আরেকবার বলবেন?
—রেকর্ডিং?
—না না, আপনার আপনার পুরো কথাটা রিপিট করুন প্লিজ, যা যা বলেছেন ডিটো। শ্রেয়া এতদিন সন্দেহভাজন অভিযুক্ত বা আসামিকে জেরা করতে অভ্যস্ত, কিন্তু নিজে এ ভাবে জেরার মুখে কখনও পড়েননি। শ্রেয়া চোখ বুজে একবার বলা কথাগুলো মনে ফিরিয়ে এনে বলে—
—এই অডিয়ো ক্লিপ কীভাবে কখন কাজে লাগবে আমরা জানি না।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫৯: শাসক বেকায়দায় পড়লেই প্রতিপক্ষকে সন্ধির প্রতিশ্রুতি দেয়, যদিও রাজনীতিতে সে সব মানা হয় না

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৪৭: দুবেজি যে রুষ্ট, তাঁর কথাতেই স্পষ্ট

নীলাঞ্জন উদ্ভ্রান্তের মতো তাকায় তারপর ‘অডিয়ো ক্লিপ’ শব্দটা বারবার বলতে থাকে, ধৃতিমান বা শ্রেয়া দু’জনেই হতভম্ব। নীলাঞ্জন বেডরুমে ছুটে গিয়ে ড্রয়ার খুলে চাবি নেয়, তারপর কী ভেবে দেওয়ালে বইয়ের দুটো র‍্যাক দুহাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। বইয়ের র‍্যাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে দেওয়ালে লাগানো ডিজিটাল লকার। একবারও ভুল না করে দ্রুত হাতে কি পাসওয়ার্ড বসিয়ে দেয়। ভিতর থেকে বের করে গয়নার বাক্স। শ্রেয়ার ধৈর্য বরাবরই কম, সে বলে উঠল—

—এক্সাক্টলি কি দেখাতে চাইছেন বলুন তো?
—দেখাতে নয়, শোনাতে। সুচেতার অডিয়ো ক্লিপ। এই হার্ড ড্রাইভে। আমি যখন শ্রেয়াকে বলতাম এ তোমার কাজটা খুব রিস্কি। যে কোনও সময় যে কোনও লোক তোমাকে আদালতে টেনে নিয়ে যেতে পারে। শ্রেয়া তখন এই অডিয়ো ক্লিপের কথা বলতো। ওর সমস্ত ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের ব্লু প্রিন্ট-এর অডিয়ো ক্লিপ রয়েছে এই হার্ড ড্রাইভে। পাসওয়ার্ড আছে আমার কাছে।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৮: জোসেফ কনরাড ও জেসি কনরাড—আমি রূপে তোমায় ভোলাব না…/৩

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৬৬: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—ছাগল ক্ষুরি ও ধানি ঘাস

যতটা জটিলভাবে গোটা দুর্ভাগ্যজনক রোমহর্ষক ঘটনাটা ঘটেছিল তার সমাধান যে সুচেতা এ ভাবে করে গিয়েছেন সেটা কেউই ভাবতে পারেননি। কোন কোন রহস্যের সমাধান খুঁজে বের করতে হয়, সুচেতা হত্যা রহস্যের সমাধান সুচেতাই করে গিয়েছেন।

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সরল এবং একমূখী। ড্রাইভার ক্লিনারের জবানবন্দি এবং তাদের মোবাইল থেকে এই খুনের মূল মাথার হদিস পাওয়া গেল। সুচেতার অডিয়ো ক্লিপ থেকে সাদা রাস্তা কালো বাড়ি সিরিজের প্রতিটি অনুসন্ধানের ডিটেলস পর্ব ধরে ধরে সাজানো ছিল। একেবারে শেষে ছিল এই ভয়ংকর খুনের কারণ ও হদিশ।

নিউজ টিভি কলকাতার সর্বময় কর্তা ববি সিং ধীলোঁ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী দুবেজির সাহায্যে নারীপাচারের চক্র চালাতেন। তাঁরা কল্পনাও করতে পারেননি যে, তাদের নিউজ টিভির সব থেকে জনপ্রিয় উপস্থাপিকা সুচেতা মুখোপাধ্যায় এই নারীপাচার চক্রের হদিশ পেয়ে যাবেন। পাকা গোয়েন্দার মতো সুচেতাও তার মালিকদের এমনকি স্বামী নীলাঞ্জনকেও ঘুণাক্ষরে বুঝতে দেয়নি যে, সে এক ভয়ংকর চক্রান্তের হদিশ পেয়ে গিয়েছে। কিন্তু শেষবিন্দুতে পৌঁছতে পারেনি সুচেতা। তাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছেন ববি সিং ধীলোঁ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী দুবেজি। সুচেতাকে সরিয়ে দিয়ে তারপর তারাই তদন্ত নিয়ে চাপ দিয়ে অন্যায়ের দায় ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৮২: খটকা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৭: কী করে গল্প লিখতে হয়, ছোটদের শিখিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ

সেই রাতেই কোনওরকম রাজনৈতিক প্রশাসনিক ঢালের আড়ালে যাবার আগেই ববি সিং ধীলোঁ তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী দুবেজিকে গ্রেফতার করা হল। সুচেতার অডিয়ো ক্লিপের সূত্র ধরে প্রায় ৪৫টি নানান কিশোরী যুবতীকে ডানকুনি হুগলি দক্ষিণেশ্বরের নানা জায়গা থেকে উদ্ধার করা হল।

গোয়েন্দা বিভাগের কর্তা বিভূতি চক্রবর্তী তাঁর বন্ধু বলে পরিচিত ববি সিং ধীলোঁর জন্য যথেষ্ট বিব্রত হয়েছেন। নীলাঞ্জন রায় সিদ্ধান্ত বদল করে কলকাতায় থেকে গিয়েছিলেন। চাকরি ছেড়ে গোলপার্কের বাড়ি বিক্রি করে শহরতলিতে একটা এক কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকতেন, আর জমানো সব টাকাপয়সা দিয়ে পথশিশুদের জন্য কাজ শুরু করলেন করপোরেট জগতের নীলাঞ্জন রায়। তাঁর সংস্থার নাম? আন্দাজ করুন! ঠিক ধরেছেন, ‘সুচেতার স্বপ্ন’।—চলবে।
 

আগামী পর্বে শুরু হচ্ছে নতুন রোমহর্ষক গল্পের টান টান সিরিজ ‘বাথটাব’। ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। ‘বুমেরাং’ চলচ্চিত্রের কাহিনিকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content