সিন্নি: পর্ব-৪
বাড়িতে টাকা-পয়সা বা গয়নাগাটি কিছু চুরি হয়েছে কিনা সেটা বলার জন্য তো কেউ আর বেঁচে নেই। নিয়মমাফিক তল্লাশি চালাতে গিয়ে শ্রেয়া জানালো ঘরের দুটো আলমারির দুটোই খোলা, লকার ভাঙা। খুব সম্ভবত বাড়িতে রাখা টাকা-পয়সা এবং গয়নাগাটি আর নেই। খুনের ক্ষেত্রে এই ধরনের রাহাজানির অ্যাঙ্গেল এসে গেলে খুনের মোটিভটা একটু দিকভ্রষ্ট হয়ে যায়, তদন্তের পক্ষে সেটা খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য দেয় না।
মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চলে গেল, গোটা ঘোষভিলা পুলিশের তরফ থেকে সিল করে দেওয়া হল। গাড়িতে অফিসে ফেরার সময় ভৈরব চক্রবর্তী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন—
—কি চ্যাম্প কি বুঝছেন ?
—সাহেব আপনি আমায় “চ্যাম্প” আর বলবেন না। সুষমা কর মার্ডার পাড়ার কেস ছিল। সেটা সলভ হয়ে গিয়েছে। লোকাল থানার বিপুল পাল আগে একেবারেই পাত্তা দিতেন না। এখন রাস্তায় ঘাটে দেখা হলে দাঁত বের করে হাসেন। আগে যেমন নানান ঠাট্টাবিদ্রূপ করতেন এখন আর সেটা করেন না। কিন্তু পরের কেস নিখিল সেন মার্ডার সেটা তো সলভ করতে পারলাম না।
—না পারা আর না করার মধ্যের ছোট্ট তফাৎটা বুঝতে পারি।
মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য চলে গেল, গোটা ঘোষভিলা পুলিশের তরফ থেকে সিল করে দেওয়া হল। গাড়িতে অফিসে ফেরার সময় ভৈরব চক্রবর্তী অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন—
—কি চ্যাম্প কি বুঝছেন ?
—সাহেব আপনি আমায় “চ্যাম্প” আর বলবেন না। সুষমা কর মার্ডার পাড়ার কেস ছিল। সেটা সলভ হয়ে গিয়েছে। লোকাল থানার বিপুল পাল আগে একেবারেই পাত্তা দিতেন না। এখন রাস্তায় ঘাটে দেখা হলে দাঁত বের করে হাসেন। আগে যেমন নানান ঠাট্টাবিদ্রূপ করতেন এখন আর সেটা করেন না। কিন্তু পরের কেস নিখিল সেন মার্ডার সেটা তো সলভ করতে পারলাম না।
—না পারা আর না করার মধ্যের ছোট্ট তফাৎটা বুঝতে পারি।
কথাটা শুনে ধৃতিমান বেশ চমকে উঠে তাকাতেই – চক্রবর্তী সাহেব আড়চোখে গাড়ির ড্রাইভারের দিকে দেখালেন – মানে এ প্রসঙ্গে আর আলোচনা নয় । কিন্তু আলোচনায় ইতি টানার পর তিনি যেটা বললেন সেটা শুনে ধৃতিমান বুঝতে পারল – কেন ভৈরব চক্রবর্তী গোয়েন্দা বিভাগের অবিসংবাদিত কর্তা । তারাতলা রোডের মুখে যানজট এড়াতে গিয়ে ড্রাইভারকে বললেন নিউ আলিপুর দুর্গাপুর ব্রিজ হয়ে যেতে – জেমস লং থেকে টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের মুখে পড়বার জন্য আমাদের গাড়ির ড্রাইভারকে যখন বহু গাড়ির প্যাঁ-পোঁ সামলাতে হচ্ছে – তখন ভৈরব চক্রবর্তী প্রায় কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন—
—কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের ফিশফ্রাই আর কফির দাম কি একটু বেড়েছে?
—কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের ফিশফ্রাই আর কফির দাম কি একটু বেড়েছে?
আরও পড়ুন:
রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-২৪: সত্যনারায়ণ পুজোর পরেই নৃশংস ভাবে আক্রমণ চালানো হয়
এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৪৩: সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ম্যানগ্রোভ
দুপুরবেলায় ঘরে পাইচারি করতে করতে ধৃতিমান ভাবছিল ভৈরব চক্রবর্তী কতটা জানেন। হয়তো তার কোন নিজস্ব লোক ধৃতিমানের ওপর নজর রাখছিল। কে তিনি? শ্রেয়া বসু? কিন্তু শ্রেয়ার সঙ্গে কথা বলে তো ধৃতিমান এই ধরনের কোনওকিছুরই ইঙ্গিত পায়নি। বুদ্ধিমত্তা অনুমান শক্তির সঙ্গে সঙ্গে হিউম্যান সাইকোলজিতে দখলটাও তো গোয়েন্দাগিরির একটা বড় অস্ত্র। তারমানে সংযুক্তা দেব বা শ্রুতি সেন এঁদের সঙ্গে কফি হাউসে দেখা করার ব্যাপারটা ভৈরব চক্রবর্তী জানেন? জানলেও কতটুকু জানেন? এযাবৎ কাল এই ধরনের একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ধৃতিমান পড়েনি। ভৈরব চক্রবর্তী সম্ভবত অন্তর্যামী না হলে ঠিক এখনই তিনি ফোন করবেন কেন?
—হ্যাঁ, সাহেব বলুন?
—কী আর বলবো! আপনি তো মশাই এই কেসটায় কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। নানারকমের সম্ভাবনার কথা ভেবে মগজাস্ত্রের ধার কমিয়ে ফেলছেন। শুনুন, আপনি তো জানেন যে খুনেবজ্জাতের ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয়ানক সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। অবশ্যই ভালো সিনেমা। যে সূত্রে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা, আর খুব ভালোবাসি নানা ধরনের বই পড়তে। তাই কাজের মধ্যে সুযোগ-সুবিধে ফাঁকফোকর পেলেই আমি কলেজ স্ট্রিটে চলে যাই। সেদিন এটা বিশেষ বইয়ের খোঁজে গিয়েছিলাম মণিকুন্তলা সেনের “সেদিনের কথা”।
—হ্যাঁ, সাহেব বলুন?
—কী আর বলবো! আপনি তো মশাই এই কেসটায় কোনও গুরুত্বই দিচ্ছেন না। নানারকমের সম্ভাবনার কথা ভেবে মগজাস্ত্রের ধার কমিয়ে ফেলছেন। শুনুন, আপনি তো জানেন যে খুনেবজ্জাতের ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমি ভয়ানক সিনেমা দেখতে ভালোবাসি। অবশ্যই ভালো সিনেমা। যে সূত্রে আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং ঘনিষ্ঠতা, আর খুব ভালোবাসি নানা ধরনের বই পড়তে। তাই কাজের মধ্যে সুযোগ-সুবিধে ফাঁকফোকর পেলেই আমি কলেজ স্ট্রিটে চলে যাই। সেদিন এটা বিশেষ বইয়ের খোঁজে গিয়েছিলাম মণিকুন্তলা সেনের “সেদিনের কথা”।
আরও পড়ুন:
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৯: কামিনী রায়, জনৈক বঙ্গমহিলা
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪১: মা সারদার অন্তরঙ্গ সেবক শরৎ মহারাজ
ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা প্রামান্য বই। ইনি হলেন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একজন প্রথম দিকের সদস্যা। ওঁর স্বামী ছিলেন এক কাশ্মীরি ভদ্রলোক তিনিও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য জলি কউল। তো বইয়ের দোকানের ভদ্রলোক বললেন যে একটু অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বইটা কোথায় পাওয়া যাবে জানেন। আনিয়ে দিচ্ছেন। অবশ্য আপনার সঙ্গে কথা বলছি বলেই এই বইটা নিয়ে এত কথা বললাম অন্যদের এসব বললে অরণ্যে রোদন করা হতো। যাই হোক , অগত্যা কফি হাউস সেখানেই আবিষ্কার করলাম দু’জন সুন্দরী মহিলার সঙ্গে আপনি ফিশ ফ্রাই আর কফি খাচ্ছেন। একজন পরিচিত নিখিল সেনের স্ত্রী শ্রুতি সেন। অন্যজনকে চিনি না। সঙ্গত কারণেই সেদিন আপনাকে বিরক্ত করিনি। আর রহস্য সমাধান আপনি চেষ্টা করলে করতে পারবেন না এটা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু এটা হতে পারে এই নিখিল সেন নিজেই খুব দুষ্টু লোক। তার খুনের সুবিচার করতে আপনি আর খাটাখাটনি করতে চাননি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এই ধরনের একটা বজ্জাত হার্ট অ্যাটাকে না মরে যদি খুনই হয় তাতে দেশের বা দশের উপকারই হয়েছে। চেয়ারে বসে তো এসব মনের কথা বলতে পারি না।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮৪: নোবেল পাওয়ায় বন্ধু দিয়েছিলেন লজ্জাবতীর চারা
মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৫৮: যুগান্তরেও রামচন্দ্র, পুরুষোত্তমরূপে প্রসিদ্ধ কেন?
দেখুন এখন ফোন করে এতগুলো কথা বলার একটাই উদ্দেশ্য আপনি ঘুণাক্ষরেও যেন ভেবে বসবেন না যে আমার সবচেয়ে প্রিয় একজন সত্যানুসন্ধানীর পিছনে আমি একজন টিকটিকি লাগিয়ে দিয়েছি। মনে হচ্ছে তো এটা আমি অনুমান করলাম কীভাবে? খুব সোজা। বেহালার কেসটায় যদি আপনি গুরুত্ব দিতেন তাহলে এতক্ষণে আমার কাছে অন্তত দুটো ফোন করতেন! এই চার চারটে খুনের জন্যে খুব চাপে আছি মশাই কিছু একটা পথ বাতলান – ভাবুন ভাবুন আরও ভাবুন!! আপনাকে তো আর ভাবা প্র্যাকটিশ করুন বলা যায় না। —চলবে।
ঘোষ পরিবার হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী ১৮ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার
>* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।