রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


 

অডিয়ো ক্লিপ (পর্ব-৬)

কী অদ্ভুতকাণ্ড, ফোনটা মিস্টার সরখেল করলেন। ফোন করলেন অনেকটা রাতেই। সরখেল মানুষটি ব্যতিক্রমী। নিছক কর্তব্যপালন করেন না। একটা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে একজন সরকারি কর্মচারীর কাজ খাতায়-কলমে যেখানে শেষ হয় সেখান থেকে আরও এগিয়ে গিয়ে কিছু করার চেষ্টা করেন। ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্টের বড়কর্তা ভৈরব চক্রবর্তী নিশ্চয়ই এই মানুষটির চাকরির পদোন্নতি ঘটাবেন না। তিনি তদন্তের ব্যাপারে কিছু খুঁজে বার করলে হয়তো খুশি হতে পারেন, কিন্তু ভিকটিমের পরিবারের সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহারের কোনও ফায়দা উনি পাবেন না। লোকটির সম্বন্ধে কিছুই জানে না নীলাঞ্জন, কিন্তু যেন স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারে সরখেল কোনও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়েননি। জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় বসার কথাও ভাবেননি। হয়তো এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে কার্ড করা ছিল। একটা সময় পশ্চিমবাংলায় এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে স্বচ্ছভাবেই শিক্ষিত যুবক-যুবতীর চাকরি হত। হয়ত সেভাবেই পুলিশের চাকরি পেয়েছিলেন।

সরখেল ঘুষ নেন এ কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। নিশ্চয়ই নেন না। একজন সৎ মানুষ পুলিশে চাকরি করেন বলেই সিনেমার নিয়মে অসৎ হয়ে যাবেন, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ থাকতে পারে না। সরখেলের কাছে ঋষভ আর মৃদুলের মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল। কোনও ইমার্জেন্সি হলে ওরা নীলাঞ্জনের আগে পৌঁছবে। তাই ওদের নম্বর দেওয়া ছিল। ফোনটা করেই সরখেল বললেন—
—খুব অড সময়ে ফোন করলাম। আপনাকে একবার আসতে হবে। আপনার দুই বন্ধুকেও ফোন করেছি। ছাড়ছি।
আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭২: বনবাসজীবনে প্রকৃতির প্রভাব কি রামের দুঃখকে মুছে দিয়েছিল?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

তাড়াতাড়ি ফোন ছেড়ে দিলেন সরখেল। নীলাঞ্জন ভাবল মৃদুল বা ঋষভের সঙ্গে কথা বলবে কিনা। কিন্তু কথা বলে বা লাভ কি হবে? ওদের কাছেও তো এরকম এসএমএস-এর মতোই ফোন গিয়েছে। দ্রুত তৈরি হয়ে ফোন নিল। ক্যাশ টাকা যা হাতের কাছে ছিল টাকার রাখার মালিক তো বেডে শুয়ে আছে। সুচেতার কাছে যখন যা টাকা লাগত চাইত নীলাঞ্জন। জানেও না কোথায় টাকা রাখে সুচেতা। ক্রেডিট কার্ড নিল, চেকবই কোথায় রাখা থাকে তাও খবর রাখে না নীলাঞ্জন। গাড়ির চাবি নিতে গিয়েও রেখে দিল। এই মধ্যরাতে গাড়ি নিয়ে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না। তার চেয়ে মাঝরাতে চার্জ বেশি হলেও ওলা বা উবের নিয়ে যাওয়াটাই ঠিক!
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৬: নান্দনিক শিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন শ্রীমা

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৫০: পুত্রস্নেহে অন্ধ হলে পিতাকেও ধৃতরাষ্ট্রের মতো দুর্দশা ভোগ করতে হয়

নীলাঞ্জন সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এসেছে যদি সুচেতাকে শিফট করতে হয় তাহলে কোথায় নিয়ে যাবে? বেলভিউ, অ্যাপোলো নাকি উডল্যান্ডস! যদিও নিউজ টিভি ব্যবস্থা করবে বলেছে, কিন্তু তাদের ওপর তো নির্ভর করা যাবে না। ব্যবস্থা তো নীলাঞ্জনকেই করতে হবে, দায়িত্ব তো তারই!

হাসপাতালের সামনে দেখল বেশ কয়েকটা গাড়ি! এত রাতে এখানে এতও গাড়ি কেন? ক্যাবটা একটু আগেই ছেড়ে দিল নীলাঞ্জন। হঠাৎ নজরে এল নিউজ টিভি ওবি ভ্যান, সুচেতার অফিসের লোকেরা কি রাতে ডিউটির পর এসেছে? পুলিশের দুটো গাড়ি হয়তো সুচেতার কেসটা প্রশাসন হাই প্রোফাইল কেস হিসেবে দেখছে। আর সুচেতা তো নিঃসন্দেহে সেলিব্রিটি মৃদুল বা ঋষভকে দেখতে পাচ্ছে না সরখেলবাবুকেও।
হঠাৎ ধৃতিমান এগিয়ে এসে কাঁধে হাত রাখলেন। ধৃতিমানকে এই সময়ে দেখে খুব আশ্চর্য হল নীলাঞ্জন।
—আপনি এত রাতে?
আরও পড়ুন:

গীতা: সম্ভবামি যুগে যুগে, পর্ব-৩: কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-৩: টলস্টয় ও সোফিয়া—সে কি কেবলই যাতনাময়…/৩

সঙ্গে সঙ্গে আরও দু-একটা মিডিয়ার গাড়ি এল এলেন পুলিশের কোনও বড়কর্তা দু’ তিনজনকে নীলাঞ্জন ক্যামেরা আর বুম নিয়ে ছুটে আসতে দেখল। নীলাঞ্জন পিছনে ফিরে দেখতে যাচ্ছিল হয়ত কোনও সেলিব্রিটি এসেছেন তাই মিডিয়ার লোকজন—
—আপনি ভিতরে চলুন এখানে ভিড় হয়ে যাবে।
—কেন কী হয়েছে?
এতক্ষণ নীলাঞ্জন সত্যি সত্যি জীবনের ভয়ঙ্কর সত্যিটা আন্দাজ করতে পারেনি দু’ একজন অন-ক্যামেরা নিউজ-ইন্ট্রো শুরু করেছে। সেখান থেকে কয়েকটা কথা বুলেটের মতো নীলাঞ্জনের মস্তিষ্কে বিদ্ধ করল।

“অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি” …”সব চিকিৎসা ব্যর্থ করে…” কিছক্ষণ আগে আমাদের প্রিয় সহকর্মী” … নিজের সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলে নীলাঞ্জন।

যখন অন্ধকার কেটে আবার চোখে আলো পড়ল তখন সে হাসপাতালে বোধহয় ক্লিনিকের বেডে শুয়ে, আশেপাশে অনেকগুলো উৎকণ্ঠিত মুখ। ধীরে ধীরে উঠে বসল নীলাঞ্জন। বুঝতে পারল এই মূহূর্ত থেকে জীবনটা পাল্টে গেল। মৃদুল জানাল ধৃতিমান ধরে ফেলেছিল না হলে নীলাঞ্জনের চোট লাগতে পারতো।
মৃদুলরা ভিতরের দুমড়ে যাওয়া রক্তাক্ত ক্ষত দেখতে পাচ্ছে না!
—আমি সুচেতার কাছে যাবো।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৮: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— বাবুর ও বন জুঁই

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৬: স্রোতস্বিনী পদ্মায় লাফিয়ে কবির কটকি চটি-উদ্ধার

সুচেতাকে বাড়ি নিয়ে এসেছিল নীলাঞ্জন। সুচেতার দিদি শিলিগুড়ি থাকেন। বাগডোগরা থেকে সকালের ফ্লাইট নিয়ে গোলপার্কে দুপুরের আগে পোঁছে গিয়েছিলেন। পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী ওঁদের আপ্যায়ন করে বসিয়েছিলেন। ততক্ষণে গোটা দেশ জেনে গিয়েছে নিউজ অ্যাঙ্কর সুচেতা মুখোপাধ্যায় আর নেই। মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলেন, গতরাতে চলে গেলেন সকলকে ছেড়ে, চিরকালের মতো।

পুলিশের তরফ থেকে সঙ্গত কারণেই ষড়যন্ত্রের দিকটা গোপন রাখা হয়েছে। সুচেতাকে নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ার আগে ধৃতিমানের সঙ্গে আবার দেখা। ধৃতিমান মুখ কিছু বললেন না, গভীরভাবে আলিঙ্গন করে ফিসফিস করে বললেন—
—সান্ত্বনা দেওয়ার কোনও ভাষা নেই। তবে ন্যায়বিচার দেওয়ার চেষ্টা করব।
নীলাঞ্জন হঠাৎ বলে উঠল—
—সুচেতা চলে যাবার পর কেসটা আরও স্ট্রং হল বলুন? ধারা ৩০২
তাই না?
ধৃতিমান ভাবল, আইপিসি ৩০২, না কি হাতেহাতে পাতে গরম বিএনএস ১০৩?—চলবে।
 

সুচেতা মুখোপাধ্যায় হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ৮ আগস্ট, ২০২৪।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content