রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


 

অডিও ক্লিপ, পর্ব-৩

সুচেতার মাথার আঘাতটা সাংঘাতিক। পিছনের সিটে বসেছিল। নীলাঞ্জন ছাড়া কখনও কারও সঙ্গে সামনের সিটে বসে না। কিন্তু কিছু কিছু মানুষের কতগুলো বদ-অভ্যাস থাকে। সুচেতা কখনওই সিট বেল্ট লাগাতো না। বেল্ট লাগালে ওর নাকি ক্লস্টোফোবিক লাগে। সামনের সিটে বসে বেল্ট না লাগালে নীলাঞ্জনের আধুনিক গাড়ি কিঁক কিঁক শব্দে উষ্মা প্রকাশ করে বলে সুচেতা বেল্ট লাগাতে বাধ্য হত। কিন্তু পিছনের সিটে বসলে সিটবেল্ট কভি নেহি! ওটা নাকি জনগণমন শুনে দাঁড়িয়ে ওঠার মতো একটা বাধ্যবাধকতা। সামাজিক নিয়ম, তবে ব্যক্তিগতভাবে না মানলে ক্ষতি নেই। পাঁচজনের সামনে থাকলে উঠে দাঁড়াতে হয়। কিন্তু একা একা টেলিভিশনে জাতীয় সঙ্গীত শুনে একমাত্র নীলাঞ্জন ছাড়া আর পৃথিবীতে কেউ দাঁড়িয়ে ওঠে না।

ঋষভ আর মৃদুল ওকে তড়িঘড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল। তিনি বুঝিয়ে বলছিলেন, মাথাতে ঠিক কী রকম আঘাত লেগেছে। কিছুটা শোনার পর নীলাঞ্জনের মাথা আর কাজ করেনি। ডাক্তার কথা বলে যাচ্ছিলেন, নীলাঞ্জন চোখের সামনে তাঁর ঠোঁটনাড়া দেখতে পাচ্ছিল, কিন্তু কথা শুনতে পাচ্ছিল না। তার মাথার মধ্যে তখন ওই গাড়ির সিটবেল্ট ঘুরছিল। ডাক্তারের কাছ থেকে বেরিয়ে আসার পর ঋষভ ও মৃদুল নীলাঞ্জনকে পাশের চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল। দোকানের বেঞ্চে মাথা ঝুঁকিয়ে খানিকক্ষণ বসে থাকার পর ডাক্তারের বলা কথাগুলো আবার সেটটপ বক্সে রেকর্ড হয়ে থাকা সুচেতার ‘সাদারাস্তা কালোগাড়ি’ অনুষ্ঠানের মতো সময় পেয়ে বেজে উঠল।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩৬: নীলাঞ্জন ঘটনাস্থলে পৌঁছতেই দ্রুত ছুটে এলো ঋষভ-মৃদুল

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৫: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা— আমুর ও গোশিঙা

ডাক্তারি পরিভাষায় একে কনকাশন বলে। আচমকা ধাক্কা খেলে ব্রেনের মধ্যে এই জাতীয় আঘাত লাগে। শরীরের ভিতরে আঘাত লাগলে তা বাইরে থেকে চট করে আন্দাজ করা যায় না। আর ঈশ্বরের সবচেয়ে জটিল সৃষ্টি হল মানবমস্তিষ্ক। তাই সেই অঙ্গটি ওরকম একটি শক্তপোক্ত সেফটি ভল্ট বা হাড়ের কুঠুরির মধ্যে যত্ন করে রাখা থাকে। কিন্তু ব্যাংক লুঠের সময় যেমন ভল্টের মোটা ইস্পাতের দরজা বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয় তেমনি এ ধরনের সাংঘাতিক দুর্ঘটনায় আমাদের শক্তপোক্ত করোটিও মস্তিষ্ককে বাঁচাতে পারে না।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫৩: মহীয়সী গৃহস্তনারী মা সারদা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯৩: মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল কীসে?

ঈশ্বর শরীরের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশকে রক্ষা করার জন্য এক রক্ষাকবচ দিয়েছেন। মস্তিষ্কজনিত আঘাতে সচরাচর মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতাকে বন্ধ করে দেওয়ার সেফটিডিভাইস আছে। নার্ভসার্কিটের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে তখন শুধু হৃদপিণ্ড আর রক্তপ্রবাহ চালু রাখার ন্যূনতম পরিষেবা চালু রাখে মস্তিষ্ক। ওই মোবাইলে চার্জ একেবারে কমে গেলে যা হয় আর কি! শুধু মোবাইলটুকু চালু থাকে সময় চলতে থাকে বাকি সব অ্যাপ বন্ধ হয়ে যায়। ঈশ্বরও আঘাতের পরে মস্তিষ্ককে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রেখেছেন। এই অজ্ঞান অবস্থার সময়টা আঘাতের গুরুত্ব অনুযায়ী বদলে যায়। মানবমস্তিষ্কের এই চোটজনিত ঘুম ভাঙতে সপ্তাহ মাস বা বছর গড়িয়ে যেতে পারে, আবার এই ঘুমই চিরকালীন হয়ে যেতে পারে। সুচেতার শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ।
আরও পড়ুন:

বিখ্যাতদের বিবাহ-বিচিত্রা, পর্ব-১: টলস্টয় ও সোফিয়া—প্রেম ও বিবাহ/১

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৫: কী যে করি করি ভেবে মরি মরি

যত্ন করে গাড়ির আর বাড়ির দুটো ফোনই সঙ্গে নিয়ে এসেছে নীলাঞ্জন। অফিসের ফোনটা তো অফিসেই পড়ে থাকে। ইচ্ছে করে কোনও ফোন থেকে অন্য ফোনে কলডাইভার্ট করে রাখেনি নীলাঞ্জন। তাহলে বাড়ির ফোনটা সর্বক্ষণ ব্যস্ত থাকবে। ঠিক এই মুহূর্তে বাড়ির ফোনেই একটা অচেনা মোবাইল নম্বর থেকে ফোন এলো। এখন চেনাঅচেনা ফোন নম্বর বাছার সময় নয়।
—হ্যালো।
—আমি সরখেল বলছি, বালিথানা আপনাকে ফোন করেছিলাম। আপনি
এখন কোথায় আছেন?
—আপনি যেমন বলেছিলেন বেলুড় স্টেট জেনারেল হাসপাতালে, সেখানেই আছি।
—আরে আমি তো ওখানেই আছি, আপনি কোথায়?
নীলাঞ্জন মুখটা তুলে আশপাশে দেখার চেষ্টা করে। না, কাউকে দেখে সরখেল বলে মনে হচ্ছে না। না, সরখেলকে সে চেনে না। কিন্তু কাউকে সেই মুহূর্তে ফোনে কথা বলতে দেখলো না নীলাঞ্জন।
—আঁজ্ঞে হাসপাতাল গেটের উল্টোদিকে যে ছোট চায়ের স্টলটা, ওখানে আছি।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৮: সর্বত্র জ্ঞান প্রয়োগ করলে বাস্তবে হিতে বিপরীত হয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৬৩: বাবু ডাক্তার ও ‘ডাক্তারবাবু’

মিস্টার সরখেলের মোবাইলে সুচেতাদের দুর্ঘটনাগ্রস্থ গাড়িটার ভয়ঙ্কর ছবি দেখার পর নীলাঞ্জনের মাথাটা টলে গিয়েছিল। ভাগ্যিস মৃদুল পাশে ছিল, সে নীলাঞ্জনকে শক্ত করে ধরে ফেলে। গাড়ির এই অবস্থা হলে মানুষগুলোর কি অবস্থা হয়েছিল। গাড়ির চালক কেন তৎক্ষণাৎ মারা গিয়েছেন সেটাও স্পষ্ট হয়ে যায় ছবিটা দেখলে। সুচেতার কথা ভাবলে বুকের মধ্যে মাথার মধ্যে একটা অস্বস্তি হচ্ছে।
—এই জন্যই আপনাকে মোবাইলে ছবিটা পাঠাইনি। গাড়ির ভিতরে আমরা এই ব্যাগটা পেয়েছি।
খুব শখ করে প্যারিস বেড়াতে যাবার সময় সুচেতার কেনা এই দামি হ্যান্ডব্যাগটা। সেটি দুমড়েমুচড়ে রক্তাক্ত হয়ে থাকা সত্ত্বেও চিনতে অসুবিধা হল না। আর ঠিক তখনই মিস্টার সরখেল একটা সাংঘাতিক কথা বললেন—
—আমাদের সন্দেহ হচ্ছে এটা কোনও সাধারণ দুর্ঘটনা নয়।
—মানে?
—এখনই নিশ্চিত নই, তবে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারও হতে পারে! —চলবে।
 

সুচেতা মুখোপাধ্যায় হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ১১ জুলাই, ২০২৪।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content