সোমবার ৮ জুলাই, ২০২৪


 

অডিয়ো ক্লিপ, পর্ব-১

সুচেতা মুখোপাধ্যায় নিউজ টিভির অত্যন্ত সাহসী টেলিভিশন সঞ্চালিকা। ‘সাদা রাস্তা কালো গাড়ি’ নামের প্রাইম টাইম অনুষ্ঠান এখন সকলের মুখে মুখে। এত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান যে সব চ্যানেলের গণ্ডি টপকে এটা এখন সন্ধেবেলা আপামর বাঙ্গালির একমাত্র কমন বিনোদন। এক-কামরার বস্তির থেকে চার-কামরার আকাশছোঁয়া বহুতল, পাব রেস্তরাঁ, নামী অভিজাত ক্লাব থেকে পাড়ার মোড়ের মাথার ভাইভাই সংঘ সব জায়গায় আধঘণ্টা কোন কথা হবে না বস! বাসে-মিনিবাসে, ট্যাক্সিতে বসে লোকে কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইলে শোনে। কন্ডাক্টর উঁকি দিয়ে দেখে, ক্যাব ড্রাইভার চোখবাঁধা চিনির বলদের মতো সামনের রাস্তায় চোখ রেখে জেনে নেয় সে-দিন সুচেতা কোন দূর্নীতির পর্দা ফাঁস করছেন।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় উপন্যাস কালোরাস্তা সাদাবাড়ি থেকেই সাদারাস্তা কালোগাড়ি’র নামকরণ। সমাজের সহজ সরল সাদা রাস্তায় পরিশ্রমী সমাজজীবনের মধ্যে কালো গাড়িতে লুকিয়ে থাকা দুর্নীতি টেনে বের করার উদ্দেশ্য নিয়েই সুচেতার সৃষ্টি এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ধৃতিমান নিজেও এই একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক। কখনও কাজের চাপে দেখা না হলে, সে রাতেই ইউটিউব দেখে নেয়। আর ধৃতিমানের আরও পছন্দ এই অনুষ্ঠানের মজাদার টাইটেল গ্রাফিক্স। বেশ একটা জেমস বন্ড মার্কা সাসপেন্স মিউজিকের সঙ্গে অ্যানিমেশনে সাদা রাস্তার ওপর এঁকে বেঁকে সশব্দে ভীষণ স্পিডে ছুটে যায় একটা কালো রঙের বড় গাড়ি। তাকে ধাওয়া করে এসে ওভারটেক করে দাঁড়ায় সাদারাস্তা কালোগাড়ি লেখা একটা নিউজ চ্যানেলের ওবি-ভ্যান। গাড়ি থেকে ক্যামেরা আর বুম নিয়ে দু’জন কালো গাড়ির দিকে এগিয়ে যান। নিউজ ওবি-ভ্যানের গায়ে লেখা সাদারাস্তা কালোগাড়ি লেখাটা গাড়ির থেকে উঠে এসে গোটাপর্দায় ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সেদিনের বিষয়বস্তু নিয়ে পর্দায় আসেন সুচেতা মুখোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩৪: প্রেমিকা রীনার জন্য সারাটা জীবন নষ্ট হয়ে গেল প্রলয়ের

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫৩: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—খলসি ও করঞ্জা

সুচেতা সুন্দরী। সাহসী। তার সাংবাদিক সত্তা ছাড়াও সুচেতা সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ পরিচিত মুখ। সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার। সমাজে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। যে চ্যানেলে সে ডেপুটি এডিটর, শুধু সেই টিভি চ্যানেল নয়, শহরের নানান সংস্থা সাংবাদিকতায় উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য সুচেতা বহু পুরস্কার পেয়েছে।

সুচেতা বিবাহিতা। স্বামী নীলাঞ্জন রায় বড়সড় বিজ্ঞাপন সংস্থার হোমরাচোমরা কর্তা। দু’জনেই সামাজিকভাবে যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী অথচ দু’জনের বহু পুরুষবন্ধু এবং মহিলাবান্ধবী থাকা সত্ত্বেও সুচেতা ও নীলাঞ্জন-এর বিয়েটা কিন্তু একেবারে পারিবারিকভাবে সম্বন্ধ করে পাঁজি দেখে কপিবুক বাঙালি বিয়ে। তবে হ্যাঁ, দু’ বাড়ির সম্মতি, ছবি দেখে দু’জনে দু’জনকে পছন্দ হওয়ার পর একটা গোটা সপ্তাহ নিজেদের জানার জন্য সময় নিয়েছিল ওরা। দু’জনের ব্যস্ততার বাইরে একান্ত সময় বের করতে গিয়ে কখনও কোন রেস্তঁরায় ব্রেকফাস্ট সারতে সারতে বা কখনও দু’জনের কাজের শেষে মধ্যরাতের খানিক আগে কোন রুফটপ রেস্তঁরায় ডিনার করতে করতে আলাপ সেরেছে। পরিচিতির জন্য টেলিভিশনে সুচেতা মুখোপাধ্যায় থাকলেও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা পাসপোর্টে নামটা সুচেতা মুখোপাধ্যায় রায়।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৭০: পাভেল কোথায়?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৫১: জয়রামবাটির যথার্থ রক্ষয়িত্রী

দু’বছর বিয়ে হয়েছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে দু’জনে ভীষণই ব্যস্ত। এখন দু’জনেরই আরও উন্নতির সুযোগ আছে। তাই ওরা দু’জনে মিলে সচেতন সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেরিয়ারটা ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়ে আরও বছর দু’য়েক পর নিশ্চিন্তে সংসারের পরিধি বাড়াবে।

দু’জনেই কাজ পাগল। তবে পাগলামির নিরিখে নীলাঞ্জন বেশি পাগল। অসম্ভব ভুলোমন। গাড়ির চাবি, বাড়ির চাবি, পার্স, মোবাইল হরদম হারায়। সুচেতা সেই দিক থেকে অনেকটা নির্ভরযোগ্য। নীলাঞ্জনকে পার্স নেওয়া বন্ধ করিয়েছে সুচেতা। তার বদলে তার কাছে খুচরো টাকা থাকে। টাকা থাকে অফিসে আর গাড়িতে রাখা ওয়ালেটে। নতুন গাড়িতে চাবি লাগে না, ইগ্নিশন সুইচে অন করা যায়। বেলটে লাগানো থাকে গাড়ির চাবি। বাড়িতে চাবি নেই। খরচা করে গোদরেজের ক্যাকটাস কানেক্ট ডিজিটাল লক লাগিয়েছে। ফাইভ ইন ওয়ান অ্যাক্সেস। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ওয়াইফাই, টাচ কার্ড, পিন আর সাবেকি চাবি। পাঁচরকমের উপায়ে বাড়িতে ঢোকা যায়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৩৪: পুণ্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে

রবিবারটা ওদের নিজস্ব উই-টাইম। সেদিন সুচেতা নিজে হাতে রান্না করে আর নীলাঞ্জন কফি খেতে খেতে সোফার আদরে আধশোয়া হয়ে সেটটপ বক্সে অটোমেটিক্যালি রেকর্ড হয়ে থাকা বউয়ের সারা সপ্তাহের সাড়াজাগানো ‘সাদা রাস্তা কালো বাড়ি’ দেখে। মোবাইলের ছোটপর্দায় ছবি সিরিজ নিউজ প্রোগ্রাম কোনওটাই দেখতে চায় না নীলাঞ্জন। বলে সে মোবাইলে মন বসাতে পারে না। প্রতি রবিবার বন্ধুবান্ধবের আসা বা তাদের বাড়ি যাওয়া না থাকলে তারা নতুন ছবি দেখতে যায়।

নীলাঞ্জনের অফিসে সকলেরই এত চাপ, অন্যান্য অফিস কাছারি বা স্কুল কলেজের টিচার্স রুমের মতো সামাজিক মাধ্যমের খবরাখবর নিয়ে গসিপ করার সুযোগ থাকে না। করপোরেট ওয়ার্ল্ড-এ লুকোনো দাঁত নখ নিয়ে সারভাইভাল অফ দ্য ফিটেস্ট-এর লড়াই চলছে প্রতিমুহূর্তের লড়াই। প্রতিটা ঘণ্টা-মিনিট-সেকেন্ডের ডেডলাইন ছুঁয়ে প্রতিযোগিতার লিকলিকে সরু তারের উপর পা রেখে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অবশ্যম্ভাবী ছোটখাট ফেলিয়রের টাল সামলে এক টার্গেট থেকে অন্য টার্গেটে পৌঁছতে হচ্ছে। তবে প্রোগ্রামের পর কফি নিয়ে রিল্যাক্স করতে করতে সুচেতা নীলাঞ্জনের পাঠানো নতুন বিজ্ঞাপন জিঙ্গল এ সব প্রায়ই রোজই দেখে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯২: মহর্ষিদেব নাতজামাইকে দিয়েছিলেন সোনার কলম

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৬৭: পাঞ্চালদেশে যাত্রাপথে পাণ্ডবদের বিচিত্র অভিজ্ঞতায় কিসের ইঙ্গিত?

কিন্তু এত ভালোরও বোধহয় একটা অপ্রত্যাশিত ইতি ঘটে যায়। সেদিন আশ্চর্যভাবে নীলাঞ্জন বেশ তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিল। সুচেতার জন্য পাস্তা বানাচ্ছিল নীলাঞ্জন। সুচেতা নীলাঞ্জনকে চা-কফি আর পাস্তাতে ডিলিট দিয়েছে। বাড়ির ফোনটা বেজে উঠেছিল। অচেনা কণ্ঠস্বর।
—কে বলছেন?
—আপনি?
—আমি হাওড়া সিটি পুলিশ বালি থানা থেকে বলছি।
—আমি নীলাঞ্জন রায়।
—এখানে একজন মহিলার সিরিয়াস অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। নিউজ টিভির গাড়ি, ড্রাইভার স্পট ডেড। ওঁর হ্যান্ডব্যাগে ফোন তো লকড কিন্তু আপনার ভিজিটিং কার্ড পেলাম। তিনটে নম্বরে চেষ্টা করতে গিয়ে থার্ড নম্বরে আপনাকে পেয়ে গেলাম। মাথায় চোট আপনি তাড়াতাড়ি বেলুড় স্টেট জেনারেল হাসপাতালে চলে আসুন।—চলবে।
 

সুচেতা মুখোপাধ্যায় হত্যারহস্য পরবর্তী পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ২০ জুন, ২০২৪।

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content