রবিবার ৬ অক্টোবর, ২০২৪


 

সিন্নি: পর্ব-১১

তবে পড়াশোনার সময় নষ্ট করে প্রেম করার মতো বুদ্ধিহীন মেয়ে রীনা নয়। সে জানত যে শুধু পড়াশোনাটাই সঙ্গে থাকবে। তাই কল্যাণের সঙ্গে তার ঘনিষ্টতা আর পাঁচটা তবলচি-গানের মাস্টার বা টিউশন স্যারের সঙ্গে ছাত্রীদের পড়ার বা গানের বন্ধঘরের নিষিদ্ধ লুকোচুরি সচরাচর প্রেম নয়। তাদের ঘনিষ্টতা বাড়ির বাইরে। চৌরঙ্গীপাড়ার রেস্তরাঁয়, ঠান্ডা সিনেমা হল-এর উষ্ণতায়। কিন্তু সেই ঘনিষ্টতাকে রীনা কখনওই দীঘা-পুরী- ডায়মন্ডহারবারের হোটেল বা গেস্টহাউসের বন্ধ-দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে দেয়নি। দাম্পত্যে বুভুক্ষু এক বিবাহিত মধ্যবয়সীকে খুব সাবধানে ব্যবহার করেছে। তার জন্য রেফারেন্স বই ঘেঁটে পাতার পর পাতার নোট তৈরি করিয়েছে, রাতের পর রাত বইপত্র ঘেঁটে রীনাকে তার সহপাঠীদের থেকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে রাখতে কল্যাণকে ব্যবহার করেছে রীনা। আর নিজে কল্যাণের ছোঁকছোঁকানি উপভোগ করেছে। পড়াশোনার ক্লান্তি ও মানসিক চাপ এ সবের স্ট্রেস কাটাতে মাঝবয়সী কল্যাণ ছিল রীনার প্রেম-বটিকা। তরতাজা চনমনে থেকে আরও বেশি করে পড়াশোনার এনার্জি টনিক।

মাঝে মাঝে টিভিতে দেখানো অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ছবি মৌচাক-এর একটি সংলাপ অনেকের মতো রীনারও খুব প্রিয়। “প্রেম করা ভালো। প্রেম করলে শরীর-মন দুই-ই ভালো থাকে।” আসলে উত্তমকুমারের মুখে এই সংলাপ বসানোর সময় চিত্রনাট্যকার অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এন্ডোরফিন ডোপামিন অক্সিটোসিন-এর অস্তিত্ব জানতেন কিনা জানি না। গুগলের কল্যাণে আজ আমরা সকলেই জানি এন্ডোরফিন হল সুখানুভূতির হরমোন। একরাশ খুশি, চনমনে উত্তেজনায় তৃপ্তিলাভের হরমোন হচ্ছে ডোপামিন। আর পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতায় মনের মানুষের কাছাকাছি থাকার আনন্দে এন্ডোরফিন ডোপামিনের মতোই আমাদের শরীরের হরমোন গ্রন্থি থেকে যে হরমোন রক্তে গিয়ে মেশে তার নাম হলো অক্সিটোসিন।
কিন্তু রীনার সম্পূর্ণ অজানা ছিল তারই দু’ ক্লাস উঁচুতে পড়তে থাকা পাড়ার ছেলে অধুনা জীবনযুদ্ধে পেছিয়ে পড়া প্রলয়ের কথা। রীনার প্রতি প্রলয়ের অনুভূতি ভালোলাগা প্রেম সবকিছু অনুচ্চারিত থেকে গিয়েছে। বাবার মৃত্যু তাকে যেদিন পাড়ার ইলেকট্রিক মিস্ত্রি প্রলয় করে দিল সেদিন থেকে সবকিছু মনের মধ্যে গিলে ফেলে নীলকণ্ঠ হয়েছিল প্রলয়। এমন ভাবেই দিন কেটে যেতে পারতো। যদি না সেদিন বাগরি মার্কেট থেকে দোকানের ছোটখাট কিছু জিনিস কিনে হাঁটাপথে সে নিউমার্কেট আসতো খানিকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে।

খিদে পেয়েছিল। দোতলায় ফার্পো রেস্টুরেন্টে গিয়ে চাইনিজ চিবোচ্ছিল প্রলয়। হঠাৎ যেন খাবারটা গলায় দলা পাকিয়ে গেল। এটা কি দেখছে প্রলয়! একটু দূরে কোনাকুনি এক যুগল ঘনিষ্ঠভাবে পিছন ফিরে বসে আছে। এত ভালো করে এদের চেনে যে পিছন থেকেও তারা কে সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। আর বুঝতে পেরেই মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠলো। এতদিন যে না পাওয়াটাকে নিজের আর্থিক দুরবস্থার কারণ বলে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল, সেই আক্ষেপ যেন মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানের বারুদের স্তুপে আচমকা আগুন লাগিয়ে দিল। কোনওক্রমে খাওয়া শেষ করে প্রলয় তার সঙ্গে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বেরিয়ে নিচে অপেক্ষা করতে লাগলো।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: হ্যালো বাবু!, পর্ব-৩২: সেদিন রাতে ভয়ংকর অশান্তি হয় দীপিকা ও কল্যাণের মধ্যে

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫১: সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ও লৌকিক চিকিৎসা—পশুর, ধুধুল ও হাবল

খানিক পরে রেস্তরাঁ থেকে বেরিয়ে এল রীনা আর কল্যাণ ভট্টাচার্য। ওরা নিউমার্কেটের এ দোকান ও দোকান ঘোরাঘুরি করলো। রীনার জন্য টুকিটাকি জিনিস কিনল কল্যাণ। মাঝে মাঝে কল্যাণ আড়চোখে ঘড়ি দেখছিল। নিউমার্কেটের পাশেই কল্যাণের অফিস। কলকাতা কর্পোরেশনের বিখ্যাত লালবাড়ি। তবে কি অফিস ফেরার তাড়া? দূর থেকে নানান দোকানে ঝুলন্ত পশরার মাঝখান দিয়ে লক্ষ্য রাখছিল প্রলয়। না, অফিস না। গ্লোব সিনেমায় গিয়ে ঢুকলো ওরা দু’জন। জেমস বন্ডের পুরনো ছবি সেরকম কোনও ভিড় নেই। বেশি দাম দিয়ে পরে টিকিট কেটে ঢোকা প্রলয় ওদের বেশ কয়েকটা রো পরে জায়গা করে বসলো।

ব্যাস এই দিন থেকে প্রলয় বদলে গেল। বাড়ির বাইরে ওদের প্রতিটি দেখাশোনার দিন তারিখ ধরে ছবি তুলে রাখতে লাগলো। কল্যাণ এ বিষয়ে বিশেষ কিছু জানতো না। প্রলয় রীনাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। বলল এইসব ছবি ছাপিয়ে পাড়াতে পোস্টার করে লাগিয়ে দেবে। নিজের পরিবারের কাছে পাড়াতে ভদ্র ভালো মেয়ে। পড়াশোনায় মনোযোগী বলে রীনার একটা সুনাম ছিল। নিজেকে নিয়ে রীণার অনেক উচ্চাকাঙ্ক্ষাও ছিল। কল্যাণের মতো একজন বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে নিজের জীবন জড়ানোর কোনও স্বপ্নই সে কখনও দেখেনি। এই সম্পর্কটা নেহাতই টাইমপাস। আর নিজের পড়াশোনার জন্য কল্যাণকে পুরোপুরি ব্যবহার করা। প্রলয়ের অনুভূতি নিয়েও কোন মাথাব্যাথা ছিল না রীনার।
আরও পড়ুন:

মুভি রিভিউ: মহাভারতের প্রেক্ষাপটে তৈরি টানটান ক্রাইম সিরিজ মৎস্যকাণ্ড

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৯০: সাহেবের বেশ না-পরে ফিরেছিলেন সাহেবের দেশ থেকে

কল্যাণের সঙ্গে সব কথা বলার পর যখন প্রলয়কে জেরা করা হল তখন শ্রেয়া এবং আমাদের সকলের সামনে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। রীনা কল্যাণকে প্রলয়ের বিষয়ে কিছুই জানায়নি। শুধু বলেছিল এখন আর বাইরে দেখা করা যাবে না। কোনওভাবে বাবার কানে ব্যাপারটা গেলে দু’জনের পক্ষেই তা সম্মানের হবে না। বয়সে অনেক বড় হলেও কল্যাণের সেই ব্যক্তিত্ব ছিল না। উল্টে সে হাঁটুর বয়সী রীনাকে সমীহ করত। আদেখলা হ্যাংলা পুরুষ মানুষেরা যেমন করে। রীনা ভেবেছিল প্রলয়কে সে স্ট্র্যাটিজিক্যালি ম্যানেজ করে নেবে। আগের থেকে সে প্রলয়ের প্রতি একটু বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছিল। উল্টে যেটাতে প্রলয় সম্পর্কটা ভুল বুঝতে শুরু করেছিল। খুব স্বাভাবিকভাবে সহজ সরল প্রলয় মাঝবয়সী কল্যাণকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেছিল। তাই একদিন সে বলেই বসলো কল্যাণের সঙ্গে রীনার সম্পর্কটা ঠিক কতটা ঘনিষ্ঠ। রীনা বলেছিল বড় দাদার মতো। কল্যাণ আর দীপিকা নাকি তার কাছে বড় দাদা বৌদির মতোই সম্মানীয়।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪৬: রাজার নিয়ন্ত্রণহীন অনুচরেদের কুকর্মের দায় রাজাকেই নিতে হয়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪৯: রসিক স্বভাব মা সারদা

সহজ সরল প্রলয় কাঁদতে কাঁদতে তার অকপট স্বীকারোক্তিতে এই কথাগুলো জানিয়েছিল শ্রেয়াকে। রীনা আসল উদ্দেশ্য ছিল প্রলয়ের তোলা ছবিগুলো আর তার নেগেটিভ প্রলয়ের থেকে নিয়ে নেওয়া।

আর সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতেই রীনা প্রলয়ের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় শুরু করেছিল। অথচ এই অভিনয়কে সত্যি মনে করে নিয়ে বোকার মতো প্রলয় অনেক দূর ভেবে ফেলল। সত্যনারায়ণ পুজো ও হোমের পর বাড়ির সবাইকে ঘুমের ওষুধ মেশানো সিন্নি খাইয়ে অচেতন করে রীনাকে নিয়ে প্রলয় পালিয়ে যাবে পুরীতে। সেখানে জগন্নাথ মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করবে দু’জনে। সিনেমা গল্পের মতো ভেবে নিয়েছিল একবার বিয়ে হয়ে গেলে শেষ দৃশ্যে বাড়িতে সবাই সবকিছু মেনে নেবেন।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৬৮: অন্ধ অতীত

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭১: হৃদয়ে প্রভুর দর্শন করলে যেমন মনে সংশয় থাকে না, তেমন অপ্রাপ্তিও থাকে না

এ বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে প্রলয় জানত যে সিন্নি মেখে পুজো করলেও কল্যাণ ভট্টাচার্য নিজে কখনও সিন্নি খান না। মাথায় ছুঁইয়ে রেখে দেন। কথা দিয়েছিল ছবি এবং নেগেটিভ সবকিছু সেদিন রীনার সামনে নিজের হাতে পুড়িয়ে দেবে। কল্যাণ ভট্টাচার্যের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার পর প্রলয় শালপাতার বাটিতে বাড়ির আর সকলকে সিন্নি দিলেও নিজে খায়নি বা রীনাকেও দেয়নি। বলেছিল, কাজটা হয়ে যাবার পর দু’জনে একসঙ্গে খাবে। ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে সেই প্রথম আর শেষবারের মতো প্রলয় রীনাকে চুমু খেয়েছিল। কল্যাণের সঙ্গে তোলা ছবি আর তার নেগেটিভ পাওয়ার জন্য রীনা তখন মরিয়া। তাই এর পরেই প্রলয়ের থেকে ছবি আর নেগেটিভ নিয়ে নিজের হাতে জ্বালিয়ে দিয়েছিল সেগুলো। প্রলয় তখন জানিয়েছিল যে সে রীনাকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে বিয়ে করতে চায়।—চলবে।
 

ঘোষ পরিবার হত্যারহস্য: অন্তিম পর্ব আগামী বৃহস্পতিবার ১৩ জুন ২০২৪

* জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’। এখন লিখছেন বসুন্ধরা এবং…এর ৩য় খণ্ড।

Skip to content